রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই

নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সাথে কোনো ধরনের সংলাপ না করার ইচ্ছা, আর বিরোধী দল নেত্রী বেগম জিয়ার ২৭ সেপ্টেম্বরের রোড মার্চের ঘোষণার পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে দুই পক্ষের মাঝে একটি সমঝোতা ছাড়া কি কোনো বিকল্প আছে? বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া তিনি নির্বাচনে যাবেন না। আর সৈয়দ আশরাফ পরদিনই জানিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এর অর্থ কী? দুই শক্তি পরস্পর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। এই যে 'অবস্থান', এই 'অবস্থান' রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়াবে মাত্র।
সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচন করা যাবে না, এটা সত্য। কিন্তু কখনো কখনো সরকারকে নমনীয় হতে হয়। পৃথিবীর ইতিহাস বলে দেশের স্বার্থে ক্ষমতাসীনরা বিরোধী পক্ষের সাথেও হাত মিলিয়েছেন, একটা সমাধান বের করেছেন। যুদ্ধের মাঝে যারা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, তারাও এক সময় হাতে হাত মিলিয়েছেন। এ দৃষ্টান্ত প্রচুর রয়েছে। এখন সৈয়দ আশরাফের ঘোষণা সব ধরনের আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দিল কিনা, তা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু আমি খুশি হতাম যদি সৈয়দ আশরাফ বেগম জিয়ার কাছে জানতে চাইতেন কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামোয় নির্বাচন হবে? সংবিধানে তো এ সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির একটি প্রস্তাব থাকতে পারে এবং ওই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি সমাধান বের করা সম্ভব। না হলে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হবে, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।
বিএনপি প্রধান বিরোধী দল। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দলটির একটি ভূমিকা আছে এবং আগামীতেও থাকবে। দলটিকে আমরা বাদ দেই কীভাবে? তাদের প্রণীত নীতি কিংবা কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু দলটিকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে করে বিএনপি আবার হরতালের কর্মসূচি দিলে আমি অবাক হতাম না। কিন্তু হরতাল না দিয়ে বেগম জিয়া দুরদৃষ্টিতার পরিচয় দিয়েছেন। হরতালে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট হন। এক্ষেত্রে 'রোড মার্চ' এর কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি পরোক্ষভাবে সরকারের ওপর একটি 'চাপ' সৃষ্টি করতে চাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তথা চারদল কম আসন পেয়েছে। কিন্তু মাত্র ৩০টি আসনের এই দলটিকে গ্রহণযোগ্যতায় না নেয়া ঠিক হবে না। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তারা ভোট পেয়েছে ৩২ দশমিক ৪৫ ভাগ (আওয়ামী লীগ ৪৮ দশমিক ০৬ ভাগ)। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নিয়ে দলটিকে বিচার করতে হবে। বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে বিএনপির অবস্থান অনেকটা এরকম: ৫ম জাতীয় সংসদে ১৪১ আসন (ভোট ব্যাপ্তি ৩০.৮১ ভাগ), ৭ম জাতীয় সংসদে ১১৬ আসন (প্রাপ্ত ভোট ৩৩ দশমিক ৬১), ৮ম জাতীয় সংসদে ১৯৩ আসন (প্রাপ্ত ভোট ৪০ দশমিক ৯৭)। এর আগে ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করলাম না। কেননা ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আর ১৯৭৯ সালের নির্বাচন হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের আওতায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচন দেশে পুনরায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে এবং ওই সংসদে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ পুনরায় সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসে। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর প্রতিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং কখনো বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে, কখনো বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। আজকে সংসদীয় রাজনীতিতে বিএনপির যে অবস্থান, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল অনেকটা তেমনি। যদিও আসন সংখ্যা বেশি ছিল ৬২ (৪০ দশমিক ১৩ ভাগ ভোট)। এ ক্ষেত্রে এ দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে যেমনি বাদ দেয়া যাবে না, ঠিক তেমনি বাদ দেয়া যাবে না বিএনপিকে। এই দুটো দলের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় রাজনীতি আরো শক্তিশালী হবে। আস্থার ঘাটতি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। ওয়ান-ইলেভেন এর বড় প্রমাণ।
তখন সৈয়দ আশরাফ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। যদি আস্থার ঘাটতি থাকে, তাহলে ৫ জন নির্বাচন কমিশনারকে দিয়েও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যাবে না। প্রশ্ন আরো আছে। যেখানে দু'জন কমিশনারেরই কাজ নেই, সেখানে বাড়তি আরো দু'জন কমিশনার কী কাজ করবেন, আমি বুঝতে পারছি না। সপ্তাহ খানেক আগে একটি গবেষণার কাজে আমি নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু কথা-বার্তা আমার কানে এসেছে। বসার জায়গা নেই, গাড়ির ব্যবস্থা নেই- এমতাবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী আরো দু'জন কমিশনার নিয়োগ দিলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমনকি এই পাঁচজনের মাঝে সর্বক্ষেত্রে মতের যে মিল থাকবে, তার গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারে না। তাহলে আমরা লাভবান হলাম কতটুকু? বিষয়টি ভাববার। উপরন্তু আরো যে সমস্যা রয়ে গেছে, তা হচ্ছে বিরোধী দলের সাথে শলা-পরামর্শ না করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিলে, তাতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতি প্রয়োজন। এই পদ্ধতির ব্যাপারটি নিয়েও বিরোধী দলের সাথে কথা বলা যায়। কেননা নির্বাচন কমিশনাররা সব বিতর্কের ঊধর্ে্ব থাকবেন, এটাই কাম্য। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এরাই পরিচালনা করবেন। ওই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করেছেন বেগম জিয়া। তবে তত্ত্বাবধায়ক না হলে একটি নিরপেক্ষ সরকার এর অধীনে নির্বাচন তো হতে পারে। তাতে ক্ষতি কী? উচ্চ আদালত যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছিল, তাতে তো একটা পর্যবেক্ষক ছিল। ওই পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করেই তো একটি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যায়। এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটি ফর্মুলা বের করা সম্ভব। এটা সংবিধানের অংশ হবে না। কিন্তু তারা দু'দুটো নির্বাচন পরিচালনা করবেন। বাংলাদেশে তখনও অনেক গুণী ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। এরা জাতির অভিভাবক। আমরা এদের ওপর আস্থা রাখতে পারি।
প্রশ্ন হচ্ছে উদ্যোগটা কে নেবে? বিরোধীদল তো কোন উদ্যোগ নিতে পারে না। উদ্যোগ তো নিতে হবে সরকারকেই। কিন্তু সরকার যদি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তাতে বরং জটিলতা বাড়বেই।
এ মুহূর্তে দেশের সমস্যা অনেক। এ নিয়ে সংবাদপত্রগুলো সোচ্চার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ আজ অসহায়। শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্রকে কোনো মতেই ভাঙা যাচ্ছে না। মুদ্রাস্ফীতি এখন শতকরা ১১ ভাগে। বিগত ৭৫ দিনে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা, গড়ে প্রতিমাসে ১০৫ কোটি টাকার সমান। এই হিসাবটা পহেলা জুলাই থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (সংবাদ, ২৯ সেপ্টেম্বর) ঋণের এই পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে, তা সহজেই অনুমেয়। আমদানিকৃত দ্রব্যাদিই নয়, বরং নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যাদির দাম আরো এক দফা বাড়বে। ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে এ দেশের মানুষ। বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ভালো নয়। বিশ্বব্যাপী যেখানে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে আমরা হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। আর ওইসব প্রকল্পে যারা কাজ পাচ্ছেন, তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দাতারা। হাজার হাজার তরুণের চাকরির কোনো সংস্থান নেই। অথচ প্রতিবছরই বাড়ছে গ্র্যাজুয়েট আর মাস্টার্স ডিক্রিধারীদের সংখ্যা। এসব বিষয় নিয়ে বিরোধীদলের সঙ্গে কথাবার্তা বলা প্রয়োজন। কৌশল নির্ধারণে তাদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এ কথাটাই শেখায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় আসার আগে কথা বলেছিলেন বিরোধী দলের সঙ্গে। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সব বিরোধী দলের সঙ্গে একটি গোলটেবিল বৈঠক করেছেন কৌশল নির্ধারণের জন্য।
সারা বিশ্ব যেখানে সরকার আর বিরোধী দলের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, সেখানে আমরা এই ধারার বাইরে থাকি কীভাবে? তাই সংলাপটা জরুরি। তত্ত্বাবধায়ক না হোক, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। মহাজোটের শরিক কোনো দল সংসদে এ প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন এবং সংসদে তা গৃহীতও হতে পারে। তবে প্রয়োজন এখানে সরকারের আন্তরিকতার।
দৈনিক যায় যায় দিন, ৫ অক্টোবর, ২০১০,

ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment