রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত ৮২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির বিষয়টি এখনও ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ে তাদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এই সিদ্ধান্তটি নেয়। হাইকোর্টের রায় সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। বিষয়টি এখন আপিল বিভাগের বিচারাধীন। সুতরাং আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিষয়টিতে কোনো কোনো মহল থেকে 'রাজনীতি' টেনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাবেক জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এই ৮২১ জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, সবাই হননি। অভিযোগ উঠেছে সরকারি দলের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের বরখাস্ত করা হয়নি। চাকরিচ্যুতদের অনেকেরই শিশু সন্তান রয়েছে, যারা স্কুলে যায়। শিশুদের বাবা কিংবা মায়ের চাকরি চলে যাওয়ায়, শিশুদের ভবিষ্যৎ সঙ্গত কারণেই একটি প্রশ্নের মুখে থাকল। এটি একটি মানবিক দিক। অনেকেরই সরকারি চাকরি করার বয়স নেই। সুতরাং তাদের পক্ষে চাকরি পাওয়া খুব সহজ হবে না। বিরোধী দলীয় নেত্রীও চাকরিচ্যুতদের ব্যাপারে একটি মন্তব্য করেছেন। সুতরাং বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ারও কোনো সুযোগ নেই।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়টির অনেকগুলো দিক রয়েছে। আইনগত দিকের বাইরেও রয়েছে মানবিক ও রাজনৈতিক দিক। কিন্তু যে বিষয়টি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। এভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে কি না, সে ব্যাপারে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলকে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানাই। যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন, তাদের জায়গায় যদি নতুন লোক নিয়োগ করা হয়, তাহলে বিতর্ক আরও বাড়বে। কেননা দেখা গেছে, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দলীয় আনুগত্যকে প্রধান্য দেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে প্রায়শই সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। উপাচার্য মহোদয়রা এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় তথা আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এ কারণেই আমি শঙ্কিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হতে পারে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে জতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজগুলোতে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কলেজগুলোতে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। কিন্তু অনার্স পড়ানোর যোগ্য শিক্ষক সেখানে নেই। আমি পিরোজপুর কলেজের একসময় ছাত্র ছিলাম। সেখানে এখন বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স রয়েছে। শিক্ষকরা সেখানে ক্লাস নেন না। ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করেন কোচিং করতে। ব্যাচে ব্যাচে ছাত্রছাত্রীরা কোচিং করে। ইংরেজির মতো বিষয়ে অনার্স রয়েছে। শিক্ষক মাত্র ১ জন। তিনি আদৌ ক্লাস নেন না। অথচ ওই কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শাখা আছে। ডিগ্রিও রয়েছে। তারপর অনার্স। একজন শিক্ষক যদি আদৌ ক্লাস না নেন, তাহলে ছাত্রছাত্রীরাই বা কী করবে? তাদের ভরসা ঢাকার নিলক্ষেতের গাইড বই। যখন এই নিবন্ধটি লিখছি তখন চোখ আটকে গেল একটি প্রতিবেদনের ওপর। একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে উলিপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের কথা। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ও ১৯৮৭ সালে জাতীয়করণকৃত এই কলেজটিতে শিক্ষক মাত্র ৮ জন। ইংরেজি, গণিত, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিজ্ঞান বিষয়ে কোনো শিক্ষক নেই। উলিপুর কলেজের এই চিত্র পাওয়া যায় অন্যত্রও। শিক্ষক নেই; অথচ অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। ছাত্রদের ভরসা ওই গাইড বই। এভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ অনার্স গ্রাজুয়েট আমরা তৈরি করছি। অথচ এই সমাজে এত অনার্স গ্রাজুয়েটের আদৌ প্রয়োজন নেই। এ বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবেন না।
 
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্য প্রয়াত আফতাব আহমেদ এক তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু 'শিক্ষক' নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু যিনি শিক্ষক, তিনি তো ছাত্র পড়াবেন। না, যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'শিক্ষক' তারা ছাত্র পড়ান না। তাদের কাজ হচ্ছে ডিগ্রি, অর্নাস (৪ পার্ট) ও মাস্টার্সের প্রশ্নপত্র তৈরি করা, শত শত উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন কলেজে যাওয়া। শুধু প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের মধ্যে দিয়ে একজন শিক্ষক কী তার দায়িত্ব শেষ করতে পারেন! বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্যোগী হয়েছিলাম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন উপাচার্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তথাকতি 'শিক্ষকদের' দিয়ে বিভিন্ন কলেজে অনার্স পর্যায়ে পাঠদান। শিক্ষকরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল তারা 'বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক', কলেজে কেন যাবেন? তারা কলেজের ছাত্রদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে রাজি (কেননা এর সঙ্গে সম্মানীর প্রশ্ন জড়িত), ক্লাস নিতে রাজি নন। ওই উপাচার্য মহোদয় আমাকে তার অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছিলেন। আজ মাননীয় আদালত ওই শিক্ষকদের কাউকে কাউকে যদি চাকরিচ্যুতির আদেশ দেয়, তাহলে যুক্তি হিসেবে সেটাই কী সঠিক নয়? যিনি ছাত্র পড়াবেন না, তিনি শিক্ষক হতে পারেন না। শুধু উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন নেই।
আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানাই। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তার পক্ষে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। সিদ্ধান্তটি নিতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিবেচনায় নিতে পারেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো ভেঙে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। এখানে সরকারের তেমন বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে না। কেননা বিভাগীয় শহরে অবস্থিত ৭টি পুরনো কলেজকে সামনে রেখেই, ওইসব কলেজকে কেন্দ্র করেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অবকাঠামো রয়েছে। ল্যাবও রয়েছে। পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকও রয়েছেন। সুতরাং কিছু কিছু বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা সম্ভব। প্রয়োজনে এক একজন জাতীয় নেতার নামে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবকাঠামো রয়েছে, সেখানে পূর্ণাঙ্গ একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা। সেখানে পোস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের পোস্ট গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামো ভেঙে দিলেও, সেখানে কর্মরত শিক্ষক তথা কর্মচারীদের চাকরি হারানোর ভয় থাকবে না। কেননা তাদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আত্তীকরণ ঘটবে। সুতরাং অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই।
আজ সময় এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা করার। আমার দুঃখ লাগে, যারাই মঞ্জুরি কমিশনে চেয়ারম্যান কিংবা সদস্য হয়ে আসেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মনোন্নয়ন নিয়ে কেউ ভাবেন না। শক্ত হাতে কেউ একটা সিদ্ধান্ত নেন না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট আস্থাভাজন। তিনি পারতেন একটি সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু সুবিধাভোগীদের চাপের সুখে তিনি নতি স্বীকার করেছিলেন। এখন উচ্চ আদালতের একটি রায়ের আলোকে তিনি বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন। আজ আমাদের সিন্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে শুধু একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্র হিসেবে রেখে দেব, নাকি সত্যিকার অর্থেই জ্ঞান ও মেধা চর্চার একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করব। এটা করতে হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো ভেঙে দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে মনে রাখতে হবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা নিয়মিত বাড়ছে। এবারও প্রচুর ছাত্রছাত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা মেডিকেল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার কোনো সুযোগ পাবে না। এদের কথা বিবেচনায় রেখেই ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। প্রধানমন্ত্রী তো একবার বলেছিলেন প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। সেটা না করে বিভাগীয় শহরগুলোতে পুরনো কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতদের সেখানে নিয়োগ দেয়া যায়। শিক্ষকদেরও সেখানে পাঠানো যায়। একশ কোটি টাকার উপরে রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড। সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনো ফান্ড দেয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে থাকা টাকা একটি বড় ফ্যাক্টর। অনেকের দৃষ্টি এদিকে। হাইকোর্টের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভেঙে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। এর ফলে একদিকে শিক্ষার মানের উন্নতি ঘটবে, অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com


0 comments:

Post a Comment