দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে আরো বেশ কিছুটা সময়, আরো দুই বছর। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই হিসাবে নতুন সংবিধান অনুযায়ী ২০১৩ সালের শেষের দিকে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু নির্বাচন ইস্যুতে জাতি আবারও বিভক্ত হয়েছে। খালেদা জিয়া দাবি করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন হতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন হবে এবং ১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, বিএনপিকে এই নির্বাচনে আসতেই হবে। আমি এটা বুঝতে অক্ষম, প্রধানমন্ত্রী কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেবেই।
পরিস্থিতি যে খুব ভালো তা বলা যাবে না। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশকে আবার এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে নির্বাচনটি দুই বছর পর হতে যাচ্ছে, তা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হবে, নাকি দলীয় সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হবে? যদি সংবিধান অনুসরণ করি, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন আর সংবিধানে নেই। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের আওতায়। কিন্তু বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে দলীয় সরকারের সময় যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না। অতীতে মাগুরা উপনির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মহাজোট সরকারের সময় ভোলায় যে উপনির্বাচন হয়েছে, তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু নিজ দলীয় কর্তৃত্বের আওতায় সেই গণতন্ত্রকে দেখতে চাই। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে নেই বটে, কিন্তু তার পরও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, এ দেশে গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি একটি বড় দল। এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দলটির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এবং এই ভূমিকা আগামীতেও থাকবে। দলটিকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। তাদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু দলটিকে কোনো অবস্থায়ই অবজ্ঞা করা যায় না। সেটা শোভন নয়। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া বিশাল সমাবেশে হরতালের কর্মসূচি দিলে আমি অবাক হতাম না। কিন্তু হরতাল না দিয়ে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। হরতালে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। অর্থনীতির ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট হন। এ ক্ষেত্রে 'রোডমার্চ'-এর কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি পরোক্ষভাবে সরকারের ওপর একটি 'চাপ' সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তথা চার দল কম আসন পেয়েছে। কিন্তু মাত্র ৩০টি আসনের এই দলটিকে গ্রহণযোগ্যতায় না নেওয়া ঠিক হবে না। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তারা ভোট পেয়েছে ৩২ দশমিক ৪৫ ভাগ (আওয়ামী লীগ ৪৮ দশমিক ০৬ ভাগ)। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নিয়ে দলটিকে বিচার করতে হবে। বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে বিএনপির অবস্থান অনেকটা এ রকম : পঞ্চম জাতীয় সংসদে ১৪১ আসন (ভোটপ্রাপ্তি ৩০.৮১ ভাগ), সপ্তম জাতীয় সংসদে ১১৬ আসন (প্রাপ্ত ভোট ৩৩ দশমিক ৬১ ভাগ), অষ্টম জাতীয় সংসদে ১৯৩ আসন (প্রাপ্ত ভোট ৪০ দশমিক ৯৭ ভাগ)। এর আগে ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করলাম না। কেননা ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আর ১৯৭৯ সালের নির্বাচন হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের আওতায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচন দেশে আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে এবং ওই সংসদে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ আবার সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসে। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর প্রতিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং কখনো বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে, কখনো বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। আজকে সংসদীয় রাজনীতিতে বিএনপির যে অবস্থান, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল অনেকটা তেমনই। যদিও আসনসংখ্যা বেশি ছিল ৬২ (৪০ দশমিক ১৩ ভাগ ভোট)। এ ক্ষেত্রে এ দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে যেমন বাদ দেওয়া যাবে না, ঠিক তেমনই বাদ দেওয়া যাবে না বিএনপিকে। এই দুটি দলের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় রাজনীতি আরো শক্তিশালী হবে। আস্থার ঘাটতি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। 'ওয়ান-ইলেভেন' এর বড় প্রমাণ।
এখন সৈয়দ আশরাফ নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলছেন। যদি আস্থার ঘাটতি থাকে, তাহলে পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার দিয়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করা যাবে না। প্রশ্ন আরো আছে। যেখানে দুজন কমিশনারেরই কাজ নেই, সেখানে বাড়তি আরো দুজন কমিশনার কী কাজ করবেন আমি বুঝতে পারছি না। সপ্তাহখানেক আগে একটি গবেষণার কাজে আমি নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। বসার জায়গা নেই, গাড়ির ব্যবস্থা নেই_এমতাবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী আরো দুজন কমিশনার নিয়োগ দিলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমনকি এই পাঁচজনের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে মতের যে মিল থাকবে, তার গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারে না। তাহলে আমরা লাভবান হলাম কতটুকু? বিষয়টি ভাবনার। উপরন্তু আরো যে সমস্যা রয়ে গেছে, তা হচ্ছে বিরোধী দলের সঙ্গে শলাপরামর্শ না করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিলে তাতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতি প্রয়োজন। এ পদ্ধতির ব্যাপারটি নিয়েও বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলা যায়। কেননা নির্বাচন কমিশনাররা সব বিতর্কের ঊধর্ে্ব থাকবেন_এটাই কাম্য। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাঁরাই পরিচালনা করবেন। ওই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করেছেন খালেদা জিয়া। তবে তত্ত্বাবধায়ক না বলে একটি 'নিরপেক্ষ সরকার'-এর অধীনে নির্বাচন তো হতে পারে। তাতে ক্ষতি কী? উচ্চ আদালত যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছিলেন, তাতে তো একটা পর্যবেক্ষণ ছিল। ওই পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করেই তো একটি 'দলনিরপেক্ষ' সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যায়। এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটি ফর্মুলা বের করা সম্ভব। এটা সংবিধানের অংশ হবে না। কিন্তু তারা দু-দুটি নির্বাচন পরিচালনা করবে। বাংলাদেশে এখনো অনেক গুণী ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তাঁরা জাতির অভিভাবক। আমরা তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারি। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোগটা কে নেবে? বিরোধী দল তো কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না। উদ্যোগটা তো নিতে হবে সরকারকেই। কিন্তু সরকার যদি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তাতে বরং জটিলতা বাড়বেই।
তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা যায়। এটা করা জাতির জন্যই মঙ্গল। তা না হলে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে, দেশে ও বিদেশে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। দ্বিতীয়ত, বিএনপির নির্বাচন বয়কট দেশকে আবার ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তৃতীয়ত, রাজনীতিতে সংঘাত বৃদ্ধি পাবে এবং অসাংবিধানিক শক্তিগুলো এ থেকে ফায়দা নিতে পারে। দেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এক চরম ঝুঁকির মুখে থাকবে। চতুর্থত, অর্থনীতিতে এর যে প্রভাব পড়বে, সরকারের পক্ষে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। পঞ্চমত, দাতাগোষ্ঠী বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। তারা সব সময়ই একটি সমঝোতার কথা বলে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে দাতারা সরকারের ওপর থেকে আস্থা তুলে নিতে পারে। ষষ্ঠত, সরকার জাতীয় পার্টিকে নিয়ে একটা 'স্বপ্ন' দেখলেও জাতীয় পার্টি যে পক্ষ ত্যাগ করবে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। অতীতে এরশাদ আওয়ামী লীগকে নিয়ে নির্বাচন করলেও (১৯৮৬) ক্ষমতা নিয়মসিদ্ধ করতে পারেননি। আবার আ স ম আবদুর রবকে (১৯৮৮) বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়েও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। বাস্তবতাই হচ্ছে, এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভূমিকা ব্যাপক। এ দুই দলের একটিকে বাদ দিলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। এখন তাই তত্ত্বাবধায়ক না হোক, একটি 'নিরপেক্ষ সরকারের' আওতায় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে উচ্চ আদালতের রায়, যার একটি অংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়েছে, কিন্তু অপর অংশে পরবর্তী দুটি নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় করার কথা বলা হয়েছে।পুরো লেখাটি ই পেপার আকারে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন।
মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর ২০১১, দৈনিক কালের কন্ঠ।ড. তারেক শামসুর রেহমান, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
পরিস্থিতি যে খুব ভালো তা বলা যাবে না। প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশকে আবার এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে নির্বাচনটি দুই বছর পর হতে যাচ্ছে, তা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় হবে, নাকি দলীয় সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হবে? যদি সংবিধান অনুসরণ করি, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন আর সংবিধানে নেই। নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের আওতায়। কিন্তু বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে দলীয় সরকারের সময় যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না। অতীতে মাগুরা উপনির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মহাজোট সরকারের সময় ভোলায় যে উপনির্বাচন হয়েছে, তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু নিজ দলীয় কর্তৃত্বের আওতায় সেই গণতন্ত্রকে দেখতে চাই। সুতরাং দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে নেই বটে, কিন্তু তার পরও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, এ দেশে গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি একটি বড় দল। এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দলটির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে এবং এই ভূমিকা আগামীতেও থাকবে। দলটিকে অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। তাদের নীতি ও আদর্শ নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু দলটিকে কোনো অবস্থায়ই অবজ্ঞা করা যায় না। সেটা শোভন নয়। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া বিশাল সমাবেশে হরতালের কর্মসূচি দিলে আমি অবাক হতাম না। কিন্তু হরতাল না দিয়ে তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। হরতালে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। অর্থনীতির ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট হন। এ ক্ষেত্রে 'রোডমার্চ'-এর কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি পরোক্ষভাবে সরকারের ওপর একটি 'চাপ' সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তথা চার দল কম আসন পেয়েছে। কিন্তু মাত্র ৩০টি আসনের এই দলটিকে গ্রহণযোগ্যতায় না নেওয়া ঠিক হবে না। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে তারা ভোট পেয়েছে ৩২ দশমিক ৪৫ ভাগ (আওয়ামী লীগ ৪৮ দশমিক ০৬ ভাগ)। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান নিয়ে দলটিকে বিচার করতে হবে। বিগত সংসদ নির্বাচনগুলোতে বিএনপির অবস্থান অনেকটা এ রকম : পঞ্চম জাতীয় সংসদে ১৪১ আসন (ভোটপ্রাপ্তি ৩০.৮১ ভাগ), সপ্তম জাতীয় সংসদে ১১৬ আসন (প্রাপ্ত ভোট ৩৩ দশমিক ৬১ ভাগ), অষ্টম জাতীয় সংসদে ১৯৩ আসন (প্রাপ্ত ভোট ৪০ দশমিক ৯৭ ভাগ)। এর আগে ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করলাম না। কেননা ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আর ১৯৭৯ সালের নির্বাচন হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের আওতায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচন দেশে আবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে এবং ওই সংসদে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ আবার সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসে। এ ক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর প্রতিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং কখনো বিএনপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে, কখনো বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। আজকে সংসদীয় রাজনীতিতে বিএনপির যে অবস্থান, ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল অনেকটা তেমনই। যদিও আসনসংখ্যা বেশি ছিল ৬২ (৪০ দশমিক ১৩ ভাগ ভোট)। এ ক্ষেত্রে এ দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে যেমন বাদ দেওয়া যাবে না, ঠিক তেমনই বাদ দেওয়া যাবে না বিএনপিকে। এই দুটি দলের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় রাজনীতি আরো শক্তিশালী হবে। আস্থার ঘাটতি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। 'ওয়ান-ইলেভেন' এর বড় প্রমাণ।
এখন সৈয়দ আশরাফ নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার কথা বলছেন। যদি আস্থার ঘাটতি থাকে, তাহলে পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার দিয়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করা যাবে না। প্রশ্ন আরো আছে। যেখানে দুজন কমিশনারেরই কাজ নেই, সেখানে বাড়তি আরো দুজন কমিশনার কী কাজ করবেন আমি বুঝতে পারছি না। সপ্তাহখানেক আগে একটি গবেষণার কাজে আমি নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু কথাবার্তা আমার কানে এসেছে। বসার জায়গা নেই, গাড়ির ব্যবস্থা নেই_এমতাবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী আরো দুজন কমিশনার নিয়োগ দিলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমনকি এই পাঁচজনের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে মতের যে মিল থাকবে, তার গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারে না। তাহলে আমরা লাভবান হলাম কতটুকু? বিষয়টি ভাবনার। উপরন্তু আরো যে সমস্যা রয়ে গেছে, তা হচ্ছে বিরোধী দলের সঙ্গে শলাপরামর্শ না করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিলে তাতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতি প্রয়োজন। এ পদ্ধতির ব্যাপারটি নিয়েও বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলা যায়। কেননা নির্বাচন কমিশনাররা সব বিতর্কের ঊধর্ে্ব থাকবেন_এটাই কাম্য। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাঁরাই পরিচালনা করবেন। ওই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করেছেন খালেদা জিয়া। তবে তত্ত্বাবধায়ক না বলে একটি 'নিরপেক্ষ সরকার'-এর অধীনে নির্বাচন তো হতে পারে। তাতে ক্ষতি কী? উচ্চ আদালত যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছিলেন, তাতে তো একটা পর্যবেক্ষণ ছিল। ওই পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করেই তো একটি 'দলনিরপেক্ষ' সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যায়। এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটি ফর্মুলা বের করা সম্ভব। এটা সংবিধানের অংশ হবে না। কিন্তু তারা দু-দুটি নির্বাচন পরিচালনা করবে। বাংলাদেশে এখনো অনেক গুণী ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তাঁরা জাতির অভিভাবক। আমরা তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারি। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোগটা কে নেবে? বিরোধী দল তো কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না। উদ্যোগটা তো নিতে হবে সরকারকেই। কিন্তু সরকার যদি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তাতে বরং জটিলতা বাড়বেই।
তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা যায়। এটা করা জাতির জন্যই মঙ্গল। তা না হলে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে, দেশে ও বিদেশে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। দ্বিতীয়ত, বিএনপির নির্বাচন বয়কট দেশকে আবার ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তৃতীয়ত, রাজনীতিতে সংঘাত বৃদ্ধি পাবে এবং অসাংবিধানিক শক্তিগুলো এ থেকে ফায়দা নিতে পারে। দেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এক চরম ঝুঁকির মুখে থাকবে। চতুর্থত, অর্থনীতিতে এর যে প্রভাব পড়বে, সরকারের পক্ষে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। পঞ্চমত, দাতাগোষ্ঠী বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর। তারা সব সময়ই একটি সমঝোতার কথা বলে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে দাতারা সরকারের ওপর থেকে আস্থা তুলে নিতে পারে। ষষ্ঠত, সরকার জাতীয় পার্টিকে নিয়ে একটা 'স্বপ্ন' দেখলেও জাতীয় পার্টি যে পক্ষ ত্যাগ করবে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। অতীতে এরশাদ আওয়ামী লীগকে নিয়ে নির্বাচন করলেও (১৯৮৬) ক্ষমতা নিয়মসিদ্ধ করতে পারেননি। আবার আ স ম আবদুর রবকে (১৯৮৮) বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়েও ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। বাস্তবতাই হচ্ছে, এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভূমিকা ব্যাপক। এ দুই দলের একটিকে বাদ দিলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। এখন তাই তত্ত্বাবধায়ক না হোক, একটি 'নিরপেক্ষ সরকারের' আওতায় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে উচ্চ আদালতের রায়, যার একটি অংশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়েছে, কিন্তু অপর অংশে পরবর্তী দুটি নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় করার কথা বলা হয়েছে।পুরো লেখাটি ই পেপার আকারে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন।
মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর ২০১১, দৈনিক কালের কন্ঠ।ড. তারেক শামসুর রেহমান, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment