বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে এ মুহূর্তে আলোচিত বিষয় দুটি- একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা এবং নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা। নিউইয়র্কে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং ২৭ সেপ্টেম্বর গণজমায়েতে বেগম জিয়ার বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে কেউ আবারও ‘ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি’র (?) আশংকা করতে পারেন। বেগম জিয়া যখন বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া তিনি নির্বাচনে যাবেন না, তখন সৈয়দ আশরাফ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি কোন ‘সমাধান’? না, এটা কোন সমাধান নয়। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে সরকার যখন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে, তখন দলীয় বিবেচনাটা মাথায় থাকে বেশি। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার ঘোষণা ফাঁকাবুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। অতীতে চারদলীয় জোট সরকার যাদের নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন দিয়েছিল, তারা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। এমনকি নির্বাচন কমিশনারদের সংখ্যা বাড়িয়েও তখন সমস্যার সমাধান করা যায়নি। সুতরাং আজ যখন ‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন’ গঠনের কথা বলা হয়, তখন তা চলমান রাজনীতিতে সংকট বাড়াবে মাত্র। কিন্তু কোন সমাধান বয়ে আনবে না। প্রথমত, সিইসিসহ দু’জন নির্বাচন কমিশনারের টার্ম শেষ হয়ে যাবে ফেব্রুয়ারিতে। তখন ‘সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি ফর্মুলা’ বের না করে যাদেরই মনোনয়ন দেয়া হবে, তারাই বিতর্কিত হবেন এবং তা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি ‘ফর্মুলা’ উদ্ভাবন করা জরুরি এবং এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের একটি সম্মতি প্রয়োজন। সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও একেবারে মন্দ নয়। সর্বজন গ্রহণযোগ্য তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে (বিতর্কিত সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে) দায়িত্বটি দেয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সরকার অতি দ্রুত আরও দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে যাচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। একজন উপদেষ্টা কথাটি আমাদের জানিয়েছেন। সংশোধিত সংবিধানে ৫ জন নির্বাচন কমিশনারের (সিইসিসহ) কথা বলা হয়েছে সত্য। তবে এই মুহূর্তে অতিরিক্ত দু’জনকে নিয়োগ না দেয়াই মঙ্গল। এতে সংবিধানের ধারাবাহিকতাও লংঘিত হবে না। সংবিধানে পাঁচজনের কথা বলা আছে সত্য, কিন্তু সরকার যদি মনে করে এই মুহূর্তে (যখন দেশে কোন নির্বাচন নেই) নির্বাচন কমিশনে পাঁচজন কমিশনারের প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রে সংবিধান লংঘিত হবে না। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন কমিশনে এই মুহূর্তে আরও দু’জনের বসার জায়গা নেই। গাড়ি নেই। জনবল নেই। কমিশনারদের কাজও তেমন নেই। নির্বাচন কমিশনাররা ব্যস্ত থাকেন ‘বিদেশ সফর’ নিয়ে। যেখানে বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে সরকারের খরচ না বাড়ানোই শ্রেয়।
‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোন সমাধান দেবে না। বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছেন। সংবিধান এখন কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেয় না। কিন্তু সরকার যদি চায়, তাহলে সমাধান একটা আছে। সরকার উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, সেই রায়ের দ্বিতীয় অংশে, যেখানে আরও দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মত দেয়া হয়েছে, এই অংশটুকু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এ ক্ষেত্রে মহাজোটের শরিকদের (যারা এখনও চাচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন) কাউকে দিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করানো যেতে পারে এবং সরকার পরোক্ষভাবে তা সমর্থন করতে পারে। ওই প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে ‘নিরপেক্ষ সরকার’ কথাটা বলা যেতে পারে, যাদের কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। ওই নিরপেক্ষ সরকারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিন সদস্যের একটি যৌথ কাউন্সিল থাকবে। এককভাবে কারও কোন ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তিন সদস্যের ওই কাউন্সিলে কারা কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।
ইভিএম মেশিনের সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। এ ব্যাপারে সিইসির অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকাতে খবর বেরিয়েছে, নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেবে। এটা একটা হাস্যকর বিষয়। শহরের মানুষ হয়তো ওই মেশিনের ব্যবহার জানবে। কিন্তু গ্রামে? যেখানে এখনও মানুষ অশিক্ষিত, সেখানে সিইসি এই মেশিন ব্যবহার করাবে কীভাবে? দেখা গেল ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত কর্মকর্তাদের (যারা নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন) সহযোগিতা চাইছেন ভোটাররা। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ওই কর্মকর্তার কথায় প্রভাবিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত হবে। ঢাকায় বসে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের মেশিন ‘বিক্রি’ করার লোকের অভাব নেই। কন্সালটেন্সি করার লোকেরও অভাব নেই। তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। বুয়েটের জনৈক ‘বিশেষজ্ঞ’ এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু ইভিএম মেশিনের যে খারাপ দিকও আছে, তা সেমিনার করে আমাদের জানিয়ে দিলেন আরেক ‘বিশেষজ্ঞ’।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা নিয়ে কোন ধরনের পরীক্ষায় যেতে চাই না। ইভিএম মেশিন খোদ আমেরিকাতেও সর্বত্র ব্যবহার হয় না। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে *** শীর্ষক প্রজেক্টের আওতায় আমাদের ক’জন শিক্ষককে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইলেকশন কমিশনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন মিস ডোনা রয়সন, যিনি কমিশনের সহকারী নির্বাহী পরিচালক। সেখানেই ভোট মেশিনের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। ডোনা আমাদের জানিয়েছিলেন, এই মেশিন নিয়ে সমস্যা আছে। সর্বত্র তা ব্যবহৃতও হয় না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে ভোট মেশিন যখন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেখানে সিইসির অতি উৎসাহ প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। তত্ত্বগতভাবে ভোট মেশিন ভালো। কিন্তু আমাদের শিক্ষা, পরিবেশ, সমাজ সেই পর্যায়ে এখনও উন্নীত হয়নি যে, আমরা এখনই ভোটার মেশিন ব্যবহার করব। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হলে, সহনশীলতা আরও বাড়লে এবং পরস্পরের প্রতি আস্থার একটা ভিত্তি যদি দাঁড় করাতে পারি তাহলেই আমরা ভোটার মেশিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এর আগে নয় এবং এটা চালু করা উচিতও হবে না।
সিইসিসহ দু’জন নির্বাচন কমিশনারই সাবেক আমলা। দু’জন বেসামরিক, একজন সামরিক। জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনও নেই। জনগণের পালস তারা বুঝতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী কিংবা ইভিএম মেশিন ব্যবহারের আগে যা দরকার, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিরোধী দলকে ‘আঘাত’ করে নয় বরং আস্থায় নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিলে জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেও বিএনপি তা ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় (বিএনপি ২৭৮টি আসন অন্যরা ২২টি) ওই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ ভোটারদের মাঝে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে, তা দেশকে শুধু একটি সংকটের মাঝেই ঠেলে দেবে না বরং বহির্বিশ্বে আওয়ামী লীগ একটি ইমেজ সংকটের মুখে পড়তে পারে। তাই যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা এবং এর জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। নির্বাচনের এখনও অনেক বাকি। কিন্তু চারদলীয় জোটের ২৭ সেপ্টেম্বরের জনসমাবেশ ও কর্মসূচি আমাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে যে, চারদলীয় জোট সরকার পতনের আন্দোলনে যাচ্ছে। আমরা আতংকিত এ কারণে, দেশের অর্থনীতি আদৌ ভালো নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব খুব শিগগিরই আমরা অনুভব করব। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার গত ৭৫ দিনে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা, গড়ে প্রতিমাসে ১০৫ কোটি টাকা। এর প্রতিক্রিয়া কী হবে এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য তথা আমদানিকৃত দ্রবাদির মূল্য ক্রয়সীমার বাইরে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিতে অস্থিরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে বাধ্য। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সংলাপ হোক। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করুক। পাল্টা কর্মসূচি দিলেই সংকটের গভীরতা বাড়বে, যা কারও জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না।
দ্বিতীয়ত, সরকার অতি দ্রুত আরও দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে যাচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। একজন উপদেষ্টা কথাটি আমাদের জানিয়েছেন। সংশোধিত সংবিধানে ৫ জন নির্বাচন কমিশনারের (সিইসিসহ) কথা বলা হয়েছে সত্য। তবে এই মুহূর্তে অতিরিক্ত দু’জনকে নিয়োগ না দেয়াই মঙ্গল। এতে সংবিধানের ধারাবাহিকতাও লংঘিত হবে না। সংবিধানে পাঁচজনের কথা বলা আছে সত্য, কিন্তু সরকার যদি মনে করে এই মুহূর্তে (যখন দেশে কোন নির্বাচন নেই) নির্বাচন কমিশনে পাঁচজন কমিশনারের প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রে সংবিধান লংঘিত হবে না। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন কমিশনে এই মুহূর্তে আরও দু’জনের বসার জায়গা নেই। গাড়ি নেই। জনবল নেই। কমিশনারদের কাজও তেমন নেই। নির্বাচন কমিশনাররা ব্যস্ত থাকেন ‘বিদেশ সফর’ নিয়ে। যেখানে বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে সরকারের খরচ না বাড়ানোই শ্রেয়।
‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোন সমাধান দেবে না। বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছেন। সংবিধান এখন কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেয় না। কিন্তু সরকার যদি চায়, তাহলে সমাধান একটা আছে। সরকার উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, সেই রায়ের দ্বিতীয় অংশে, যেখানে আরও দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মত দেয়া হয়েছে, এই অংশটুকু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এ ক্ষেত্রে মহাজোটের শরিকদের (যারা এখনও চাচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন) কাউকে দিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করানো যেতে পারে এবং সরকার পরোক্ষভাবে তা সমর্থন করতে পারে। ওই প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে ‘নিরপেক্ষ সরকার’ কথাটা বলা যেতে পারে, যাদের কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। ওই নিরপেক্ষ সরকারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিন সদস্যের একটি যৌথ কাউন্সিল থাকবে। এককভাবে কারও কোন ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তিন সদস্যের ওই কাউন্সিলে কারা কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে।
ইভিএম মেশিনের সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। এ ব্যাপারে সিইসির অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকাতে খবর বেরিয়েছে, নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেবে। এটা একটা হাস্যকর বিষয়। শহরের মানুষ হয়তো ওই মেশিনের ব্যবহার জানবে। কিন্তু গ্রামে? যেখানে এখনও মানুষ অশিক্ষিত, সেখানে সিইসি এই মেশিন ব্যবহার করাবে কীভাবে? দেখা গেল ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত কর্মকর্তাদের (যারা নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন) সহযোগিতা চাইছেন ভোটাররা। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ওই কর্মকর্তার কথায় প্রভাবিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত হবে। ঢাকায় বসে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের মেশিন ‘বিক্রি’ করার লোকের অভাব নেই। কন্সালটেন্সি করার লোকেরও অভাব নেই। তার প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি। বুয়েটের জনৈক ‘বিশেষজ্ঞ’ এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু ইভিএম মেশিনের যে খারাপ দিকও আছে, তা সেমিনার করে আমাদের জানিয়ে দিলেন আরেক ‘বিশেষজ্ঞ’।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা নিয়ে কোন ধরনের পরীক্ষায় যেতে চাই না। ইভিএম মেশিন খোদ আমেরিকাতেও সর্বত্র ব্যবহার হয় না। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে *** শীর্ষক প্রজেক্টের আওতায় আমাদের ক’জন শিক্ষককে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইলেকশন কমিশনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন মিস ডোনা রয়সন, যিনি কমিশনের সহকারী নির্বাহী পরিচালক। সেখানেই ভোট মেশিনের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। ডোনা আমাদের জানিয়েছিলেন, এই মেশিন নিয়ে সমস্যা আছে। সর্বত্র তা ব্যবহৃতও হয় না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে ভোট মেশিন যখন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেখানে সিইসির অতি উৎসাহ প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। তত্ত্বগতভাবে ভোট মেশিন ভালো। কিন্তু আমাদের শিক্ষা, পরিবেশ, সমাজ সেই পর্যায়ে এখনও উন্নীত হয়নি যে, আমরা এখনই ভোটার মেশিন ব্যবহার করব। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও শক্তিশালী হলে, সহনশীলতা আরও বাড়লে এবং পরস্পরের প্রতি আস্থার একটা ভিত্তি যদি দাঁড় করাতে পারি তাহলেই আমরা ভোটার মেশিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এর আগে নয় এবং এটা চালু করা উচিতও হবে না।
সিইসিসহ দু’জন নির্বাচন কমিশনারই সাবেক আমলা। দু’জন বেসামরিক, একজন সামরিক। জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনও নেই। জনগণের পালস তারা বুঝতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী কিংবা ইভিএম মেশিন ব্যবহারের আগে যা দরকার, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিরোধী দলকে ‘আঘাত’ করে নয় বরং আস্থায় নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিলে জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেও বিএনপি তা ধরে রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় (বিএনপি ২৭৮টি আসন অন্যরা ২২টি) ওই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ ভোটারদের মাঝে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে, তা দেশকে শুধু একটি সংকটের মাঝেই ঠেলে দেবে না বরং বহির্বিশ্বে আওয়ামী লীগ একটি ইমেজ সংকটের মুখে পড়তে পারে। তাই যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা এবং এর জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। নির্বাচনের এখনও অনেক বাকি। কিন্তু চারদলীয় জোটের ২৭ সেপ্টেম্বরের জনসমাবেশ ও কর্মসূচি আমাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে যে, চারদলীয় জোট সরকার পতনের আন্দোলনে যাচ্ছে। আমরা আতংকিত এ কারণে, দেশের অর্থনীতি আদৌ ভালো নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব খুব শিগগিরই আমরা অনুভব করব। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার গত ৭৫ দিনে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা, গড়ে প্রতিমাসে ১০৫ কোটি টাকা। এর প্রতিক্রিয়া কী হবে এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য তথা আমদানিকৃত দ্রবাদির মূল্য ক্রয়সীমার বাইরে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিতে অস্থিরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে বাধ্য। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সংলাপ হোক। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করুক। পাল্টা কর্মসূচি দিলেই সংকটের গভীরতা বাড়বে, যা কারও জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment