রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

পৌর নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি

আগামী ৩০ ডিসেম্বর পৌর নির্বাচনকে সামনে রেখে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে? ‘কিংবা সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি জাতীয় নির্বাচনের যে দাবি, এই পৌর নির্বাচন কি সেই পথ প্রশস্ত করবে? ৫ জানুয়ারির (২০১৪) জাতীয় সংসদের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। এরপর তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও মাঝপথে নির্বাচন বয়কট করেছিল। উপজেলা নির্বাচন যেমন সুষ্ঠু হয়নি, ঠিক তেমনি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। ফলে আগামী বুধবারের পৌর নির্বাচন একটি বড় আশংকার জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এইচএম এরশাদ গত ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন কমিশনকে তিনি মেরুদণ্ডহীন হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। এইচএম এরশাদ সরকারের শরিক এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি। দীর্ঘদিন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছেন। একজন শীর্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যখন বলেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, তখন বিষয়টিকে আমরা হালকাভাবে নিতে পারি না। এই নির্বাচনের যথেষ্ট গুরুত্ব থাকলেও ৯ ডিসেম্বরের পর থেকে (যখন থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারণায় যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি। সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বটি বর্তায় নির্বাচন কমিশনের ওপর। কিন্তু দুঃভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ করলাম নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব। একজন কমিশনার তো প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাইলেন। বললেন, ‘সরকারপ্রধানের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আচরণবিধি লংঘনের বিষয়টি তিনি যেন দেখেন।’ প্রধানমন্ত্রী দেখবেন! এই দায়িত্বটি কি প্রধানমন্ত্রীর? মন্ত্রীরা, এমপিরা আচরণবিধি লংঘন করেছেন। ইসি নোটিশ করলেও তাদের আবার দায়মুক্তিও দিয়েছে। আসলে নির্বাচন কমিশনের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, তা তারা পূরণ করতে পারেনি। অতীতে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময়ও ইসির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এখন একটা সুযোগ এসেছিল ইসির জন্য তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করার। কিন্তু তারা সেটি পেরেছে, তা বলতে পারছি না। সংবাদপত্রগুলো গত দু’সপ্তাহে আমাদের যেসব সংবাদ পরিবেশন করেছে, তা আমাদের জন্য কোনো আশার কথা বলে না। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ওপর হামলায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি ইসি। ইসির সতর্কতার পরও নির্লিপ্ত মাঠ প্রশাসন। বাড়ছে সহিংসতা- এমন খবরই দিয়েছে একটি সংবাদপত্র। অন্য একটি দৈনিকের প্রথম পাতার ভাষ্য, ক্ষমতাসীনদের দৌরাত্ম্য বাড়ছেই। সাভারে বিএনপি প্রার্থীর বাড়িতে হামলা, ৯ পৌরসভায় আচরণবিধি লংঘন, তানোরে শিক্ষকদের নিয়ে এমপির ‘নির্বাচনী সভা’- এমন খবর একটি জাতীয় দৈনিকের। পৌর নির্বাচনে সেনা মোতায়েন চেয়েছিলেন খালেদা জিয়া- এমন খবরও দিয়েছে সংবাদপত্রগুলো। আবার সিইসি খালেদা জিয়ার এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন- এমন খবরও আছে সংবাদপত্রে। ফলে পৌর নির্বাচন নিয়ে একটা শংকা থেকেই গেল। অথচ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এই নির্বাচনটির গুরুত্ব অনেক। প্রথমত, এই প্রথম দুটি বড় দল তাদের দলীয় মার্কা নিয়েই (নৌকা ও ধানের শীষ) মেয়র নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। অর্থাৎ মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকছে দুটি বড় দলের মাঝে। জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটা সুযোগও তৈরি হয়েছে। যদি নির্বাচনটি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে এই জনপ্রিয়তা প্রমাণের সুযোগ আর থাকবে না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের জন্যও এ ‘বিষয়টি’ কোনো শুভ সংবাদ বয়ে আনবে না।দ্বিতীয়ত, পৌর নির্বাচনে সব ধরনের ‘অনিয়ম’ যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে জাতীয় পর্যায়ে তথা জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই ‘প্রবণতা’ বন্ধ না হলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ‘মৃত্যু’ ঘটবে বাংলাদেশে।তৃতীয়ত, পৌর নির্বাচনে মোট ৬ জন মেয়র প্রার্থী এবং ১৩৪ জন সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়েছেন! অভিযোগ আছে, জোরজবরদস্তি করে বিরোধী দলের অনেক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি। ফেনী জেলার অন্তর্ভুক্ত ফেনী, পরশুরাম, দাগনভূঞা পৌরসভা নির্বাচনে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের ৪৮টিতে ৪৪ জন প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হওয়ার নজির কোনো ভালো কথা বলে না। এ প্রবণতা বন্ধ না হলে তা জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে।চতুর্থত, পরিসংখ্যান বলছে, ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ২২৯ জনের নামে বর্তমানে ও ৩২১ জনের নামে অতীতে মামলা ছিল। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২২১ জন মেয়র প্রার্থীর ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের (২০৬ জন) মধ্যে ৯৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। যুক্তি হিসেবে ধরে নেই, বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, তা হয়রানিমূলক। কিন্তু আওয়ামী লীগের ৩৩ জনের বিরুদ্ধে (মেয়র প্রার্থী) যে মামলা রয়েছে, তা নিশ্চয়ই হয়রানিমূলক নয়! আওয়ামী লীগের নেতারা জেনেশুনে কেন এসব প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলেন? স্থানীয় পর্যায়ে ভালো ও সৎ প্রার্থী না দিলে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না। সরকারি দলের মেয়র প্রার্থীদের ৩৩ জন কোনো না কোনোভাবে মামলায় জড়িয়ে গেছেন। দল তাদের বদলে সৎ প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে পারত। এটা হলে ভালো হতো। আওয়ামী লীগ একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করত। সৎ প্রার্থী না হলে স্থানীয় পর্যায়ে সৎ রাজনীতি উপহার দেয়া যায় না। বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। আওয়ামী লীগ এ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। উপরন্তু যে ৬টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে কী ধরনের ‘পরিস্থিতি’ বিরাজ করছে, তা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের জানার কথা। ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ বিজয়ী হওয়ার ঘটনা দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য যথেষ্ট নয়।পঞ্চমত, মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ‘ব্যবসায়ী প্রার্থীর’ সংখ্যা বেশি। ৯০৪ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ৬৫২ জন ব্যবসায়ী, অর্থাৎ শতকরা ৭২ দশমিক ১২ ভাগ ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেই ব্যবসায়ীদের আধিক্য। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের ১৬৫ জন (শতকরা ৭৪ দশমিক ৬৬ ভাগ), আর বিএনপির ১৬২ জন (শতকরা ৭৮ দশমিক ৬৪ ভাগ) ব্যবসায়ী (সূত্র : সুজন)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা যখন মেয়র হন, তখন তারা কি ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে, নিরপেক্ষভাবে স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা করতে পারেন? পৌরসভায় কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি এ ধরনের মেয়র পাওয়া সম্ভব, যিনি ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকবেন? বাস্তবতা বলে, এটা সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়।ষষ্ঠত, আরও একটা কারণে এই নির্বাচন গুরুত্ব বহন করে। দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী তাদের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে নির্বাচন করতে পারছে না। তবে জামায়াতের প্রার্থীরা মাঠে আছেন। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপির হাইকমান্ড এটি জানে। লিখিতভাবে অথবা প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে বিএনপি দুটি আসনে দিয়েছে জোটভুক্ত এলডিপি ও জাতীয় পার্টিকে (জাফর)। এর বাইরে ধারণা করছি, প্রায় ২৬টি আসন বিএনপি জামায়াতকে ছাড় দিয়েছে। ইসিতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর্যায়ে রয়েছে। সরকার সম্ভবত আইনি প্রক্রিয়াতেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চায়। অতীত ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়েও জামায়াতের কর্মকাণ্ড নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে জামায়াত সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের পরিচয় স্থানীয়ভাবে ভোটাররা জানে। ওইসব আসনে বিএনপি প্রার্থী দেয়নি। ফলে এই নির্বাচন প্রমাণ করবে জামায়াতের প্রতি জনসমর্থন কতটুকু আছে। ওই জনসমর্থন নিয়ে জামায়াত হয়তো ভবিষ্যতে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে (অনেকটা তুরস্কের মডেলে), যদি জামায়াতকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই পৌর নির্বাচন প্রমাণ করল বিএনপি জামায়াতকে যেমন ছাড়বে না, ঠিক তেমনি জামায়াতও বিএনপিকে ছাড়বে না। এই দুটি রাজনৈতিক শক্তির মাঝে একটা ‘বিভক্তির’ উদ্যোগ নেয়া হলেও তা কোনো ‘কাজ’ দেয়নি। পৌর নির্বাচন আমাদের বলে দিচ্ছে, বিএনপি-জামায়াত সখ্য ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বহাল থাকবে। তবে নিঃসন্দেহে তা জামায়াত নামে নয়, বরং অন্য কোনো নামে। জামায়াতের তরুণ প্রজন্ম এমনটাই চাচ্ছে।নির্বাচনী প্রচারণায় মন্ত্রী-এমপিরা যেতে পারছেন না। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে বিএনপির নেতাদের যাওয়ার কথা। কিন্তু ক’জন গেছেন? কেউ কেউ জেলে। অনেকে আবার অসুস্থ। বিএনপি দুটি কাজ করতে পারত। এক. খালেদা জিয়া প্রতিটি বিভাগীয় শহরে জনসভা করতে পারতেন। যদিও ধারণা করছি, তিনি পুরোপুরিভাবে সুস্থ নন। এমন অবস্থায় তার পক্ষে ঢাকার বাইরে যাওয়াও কঠিন। তবে তার যাওয়া দরকার। এক কঠিন সময় পার করছে বিএনপি। অর্থ আÍসাতের অভিযোগে তার সাজা হয়ে যাওয়া, তারেক রহমানের দেশে আসতে না পারা, বিএনপিতে বিকল্প নেতৃত্ব না থাকা বিএনপিকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। অস্তিত্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বিএনপিকে এখন বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দলে ফিরিয়ে নিয়ে তাকে কার্যকরী সভাপতি করা যেতে পারে। দুই. বিএনপির তরুণ নেতৃত্বকে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে পাঠানো যেতে পারে। এই তরুণ নেতৃত্ব এখন ঢাকায়, এখন তাদের ব্যস্ততা টকশোকেন্দ্রিক। রিজভী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের মধ্যে তার কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এতে করে জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দিকনির্দেশনাহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। বিএনপিকে নতুন রাজনীতি আর নতুন নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বিএনপির গবেষণা সেলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। গবেষণা সেল ছাড়া বিএনপি আগামী দিনের রাজনীতি উপস্থাপন করতে পারবে না।বিএনপির জন্য সুযোগ এসেছে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। বিএনপির টার্গেট থাকা উচিত ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন। পৌর নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না-ও হয়, তারপরও বিএনপিকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হবে। দল গোছাতে হবে। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে হবে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি কোনো সুবিধাই ঘরে তুলতে পারেনি। সরকার সর্বক্ষেত্রে তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সংসদে বিএনপির অনুপস্থিতিতে। নির্বাচন বয়কটের পেছনে যুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের অনুপস্থিতিতে যে সুযোগটি তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে। ‘ফাঁকা মাঠে কোনো দলকেই গোল’ করতে দেয়া উচিত নয় বিএনপির।বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। একটিকে বাদ দিয়ে যেমন গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না, ঠিক তেমনি এই দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্কই অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণের আশংকা রোধ করতে পারে। তাই পৌর নির্বাচনটিকে গুরুত্বহীন ভাবলে আমাদের চলবে না। এই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে সরকারের পতন ঘটবে না সত্য; কিন্তু ভবিষ্যৎ রাজনীতির একটা রূপরেখা আমরা পাব। Daily Jugantor 28.12.15

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কি পরিবর্তন আসছে

অতি সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোটে যোগ দেয়ায় যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ কি তার সনাতন নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের ৪৪ বছরের রাজনীতিতে কখনো কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ব্রেজনেভ তার ‘যৌথ নিরাপত্তা’ চুক্তিতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানালেও বাংলাদেশ তাতে শরিক হয়নি। পরবর্তীতে পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এলেও বাংলাদেশ কখনো কোনো জোটে যোগ দেয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। এখন বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশ এই নীতি থেকে সরে এলো কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। উপরন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫তম অনুচ্ছেদ ‘আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, সংহতি ও উন্নয়নের’ কথা বলা হয়েছে। অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথাও বলা হয়েছে এই অনুচ্ছেদে। তাই জোটে যোগ দিয়ে আগামীতে ‘অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ করবে কিনা, ‘শক্তি প্রয়োগে’ অংশ নেবে কিনা, এ প্রশ্ন থাকলই। যদিও জোটের পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা কী হবে তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই জোটের উদ্যোগে রিয়াদে একটি কেন্দ্র হবে এবং এই কেন্দ্র সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে।’ তবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ আমাদের জানাচ্ছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামরিক অভিযান সমন্বয় ও তাতে সহায়তা করতে সৌদি নেতৃত্বাধীন এ জোট গঠন করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ আরো যুক্তি দেখিয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির অংশ হিসেবে অন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ এই কেন্দ্রে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তত্ত্বগতভাবে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে তথ্য বিনিময় আমাদের অনেক সাহায্য করবে। বাংলাদেশে আইএসের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক আছে। আইএস আছে কী নেই, এ নিয়ে সংশয় আছে। ঝওঞঊ ইনটেলিজেন্সের পক্ষ থেকে আইএসের অস্তিত্ব এবং বেশ কটি হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে আইএসের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও বাংলাদেশ সরকার তা অস্বীকার করেছে। এখন যদি আগামীতে এই জোট আইএসের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, তাহলে বাংলাদেশ আইএসের টার্গেটে পরিণত হতে পারে। এতে বাংলাদেশে আইএসের হুমকি আরো বাড়বে। আল কায়েদা এ অঞ্চলে (অর্থাৎ ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমারে) তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগের খবর আমরা জানি না। তবে স্থানীয় জঙ্গিরা যে আল কায়েদা ও আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে এ খবর গোয়েন্দারা আমাদের জানিয়েছে। তখন একটা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল যে, বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে, সে ব্যাপারে এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এক সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। সংবিধানের এই ধারাটি এখন আর নেই। বাতিল করা হয়েছে। ফলে সৌদি জোটে যোগদান আমাদের জন্য কোনো প্রয়োজন ছিল না। ভারত কোনো জোটেই যোগ দেয়নি। ওমানও যোগ দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ দিল। এই জোটে অন্য যেসব দেশ রয়েছে সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে সবাই দুর্বল। বিশ্বে বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্ব যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছে। এখন সৌদি আরব বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে অথচ সৌদি আরব এখনো বাংলাদেশের শ্রমবাজার উš§ুক্ত করে দেয়নি। ফলে জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবেÑএ প্রশ্ন থাকবেই। তবে এই জোটের ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। জোটের অন্যতম শরিক পাকিস্তান কিছুটা অবাকই হয়েছে এই জোট গঠনে এবং জোটে পাকিস্তানের নাম থাকায়। পাকিস্তানের বক্তব্য পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ না করেই এই জোটের ঘোষণা দেয়া হয়। আমি নিশ্চিত নই এই জোট গঠনে বাংলাদেশের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আদৌ হয়েছিল কিনা। সৌদি আরব এ ধরনের একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছে কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রারম্ভিক আলোচনা হয়েছে এটাও আমাদের অনেকের জানা নেই। ফলে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যখন গত ১৫ ডিসেম্বর এই জোট প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন তখন বিষয়টি আমাদের অবাকই করেছে। এমন হয়েছে কিনাÑসৌদি আরব একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে তা জোটবদ্ধ দেশগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে শুধু? এটা যদি সত্য হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। জোট নিয়ে পাকিস্তানের প্রশ্ন তোলা এই সম্ভাবনাটাকেই সামনে চলে এলো।
এখানে আরো একটা কথা বলা দরকার। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, যাদের নাগরিকদের প্রায় সবাই মুসলমান। ওই অঞ্চলের একটি দেশও জোটে যোগ দেয়নি। তাজকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, কিরগিজস্তান এই দেশগুলো এক সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে গেলে এই দেশগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ’ যদি অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে থাকে জোটে যোগ দেয়ার ব্যাপারে। তাহলে মুসলমান প্রধান এই দেশগুলো যোগ দিল না কেন? ইন্দোনেশিয়া বড় মুসলিম দেশ। এই দেশটিও নেই কেন? পাঠক, লক্ষ্য করুন কোন দেশগুলো যোগ দিয়েছে? বেনিন, সাঁদ, টোগো, জিবুতি, সুদান, সিয়েরা লিওন, গ্যাবন, সোমালিয়া, কমোবোয়া, মালদ্বীপ এই দেশগুলোর সন্ত্রাস দমনে আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই এবং জাতিসংঘ এই দেশগুলোকে কখনো বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে আমন্ত্রণও জানায়নি। শুধু তাই নয়, সুদান, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, গিনি ইতোমধ্যে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব দেশে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারও নেই। তাহলে এই দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানাল হলো কেন? দেশগুলো গরিব। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। ধনী দেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতার ওপর দেশগুলো নির্ভরশীল। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই কি দেশগুলোকে সৌদি আরব তার জোটে রেখেছে?
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জোটে ৩৪ দেশ যোগ দিয়েছে। এই জোটকে বলা হচ্ছে ‘ইসলামিক মিলিটারির অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেররিজম’ (আইএসএএফটি)। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই এই জোটের জš§! এখানে কোনো একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কথা বলা হয়নি। সম্প্রতি সিরিয়া ইরাকে জš§ নেয়া ইসলামিক স্টেট বা দায়েশ (আরবি নাম) এর বিরুদ্ধে আলাদা আলাদাভাবে বিমান হামলা পরিচালনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ও রাশিয়া। অনেক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি জোট ‘দ্য গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল।’ এখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, আইএসআইএল তথা ইসলামিক স্টেটের কথা। ৬৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের মূল টার্গেট ইসলামিক স্টেট। এখন এর পাশাপাশি গঠিত হলো আইএসএএফটি। একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরটি নেতৃত্বে সৌদি আরব। উভয় জোটের স্বার্থ কি এক? অর্থাৎ উভয় জোটই কি ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হবে? বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জোটে বাংলাদেশকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়নি। এখন সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশ যোগ দিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিল না কেন? নাকি ওই জোটে যোগ দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগে সৌদি জোটে যোগ দিল? মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা আমাকে বলতে চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এক টিভি টক শোতে তিনি আমাকে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন। তবে জানিয়েছিলেন, ‘অসামরিক ও জাতিসংঘের উদ্যোগে যে কোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।’ অর্থাৎ আমি ধরে নিয়েছি যদি কোনো ধরনের ‘মানবিক বিপর্যয়ের’ ঘটনা ঘটে সিরিয়ায়, তাহলে বাংলাদেশ মার্কিন জোটকে সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনে জোটে যোগ দেবে। এখন সৌদি জোটে যার চরিত্র অনেকটা সামরিক, বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিল। ফলে জোটে যোগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার বেশ কিছু দেশ রয়েছে, যে দেশগুলো উভয় জোটেই আছে (জর্দান, আরব আমিরাত, বাহরাইন, তুরস্ক, কুয়েত ইত্যাদি)। সৌদি আরব মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটেও আছে।
এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। এক. সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। দুই. সৌদি আরব পারস্যীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংক বহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে; কিন্তু আমিরের সম্মানে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনেসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনেসিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। তিন. সৌদি আরবের নীতি-নির্ধারকদের একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। প্যারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে। চার. এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতার্দশ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতার্দশ। এক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতি-নির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই। সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
সৌদি জোট গঠন করার কথা বলা হয়েছে মাত্র। জোট এখনো তার যাত্রা শুরু করেনি। তার কমান্ডও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই জোটের সম্পর্ক কী হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। সুতরাং জোট গঠনের কথা ঘোষণা করলেও জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। Daily Manob Kontho 27.12.15

পৌর নির্বাচন : আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করবে


আগামী বুধবার ৩০ ডিসেম্বর দেশে পৌর নির্বাচন। মোট ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন ছয় জন। এটা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। প্রথমবারের মতো এই মেয়র নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হলেও ইতোমধ্যে এই নির্বাচন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা কিংবা এই নির্বাচন কতটুকু সরকারি প্রভাবমুক্ত থাকবে, এ প্রশ্ন উঠেছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেনের ওপর হামলা কিংবা বেগম জিয়ার সেনা মোতায়েনের দাবি প্রত্যাখ্যান করার পর খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্নটি উঠেছে যে, শেষ পর্যন্ত পৌর নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণভাবে নাও অনুষ্ঠিত হতে পারে! নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে একাধিক ঘটনায়। এমনকি একজন নির্বাচন কমিশনার যখন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহযোগিতা চান, তখন তিনি শুধু নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্বই প্রকাশ করেন না, বরং নির্বাচনটি যে নিরপেক্ষ হবে নাÑ এমন একটা আশঙ্কারও জন্ম দেন। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী একাধিক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও এই প্রবণতা রোধে ইসি কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, আচরণবিধি লঙ্ঘন করার পরও দুজন মন্ত্রী ও তিনজন এমপিকে দায়মুক্তি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ফলে এই নির্বাচনটি একটি বড় ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও জনমানসে নির্বাচনটি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। পৌর নির্বাচনটি আমাদের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। এই নির্বাচন প্রমাণ করবে ২০১৯ সালে দেশে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে কিনা! তাই যে কোনো বিবেচনায় এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা পৌর নির্বাচন হলেও এর ওপর ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, যদি স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীদের দৌরাত্ম্য, ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারার প্রবণতা রোধ করা না যায়, তাহলে প্রমাণিত হবে সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক নয়। ইতোমধ্যেই অনেকগুলো কারণ সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। প্রথম কারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের নিয়ে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন মাঠ প্রশাসনে কর্মরত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। এমনকি মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল মীমাংসার জন্য গঠিত আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬২ জন জেলা কর্তৃপক্ষকে। অথচ এসব কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত নিজস্ব জনবল রয়েছে। তাদের দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেত। এখন সরকারি কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় এই নির্বাচন কতটুকু ‘সরকারের প্রভাবমুক্ত’ থাকবেÑ এটা একটা মূল প্রশ্ন এখন। আইন নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিলেও কমিশনারদের ভূমিকা দেখে আমার মনে হয়েছে, তারা যেন এখনো অনেকটা ‘সরকারি কর্মচারীদের’ মতো ভূমিকা পালন করছেন! তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বলে অনেকেরই ধারণা। কেননা প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় সরকারদলীয় প্রার্থী, সমর্থকরা যখন নির্বাচনবিধি লঙ্ঘন করছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তখন শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচন কিংবা আরও আগে উপজেলা নির্বাচনের সময় ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপির সংবাদ গণমাধ্যমে এলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, তা দেখা যায়নি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনকি দায়মুক্তিও দিয়েছে ইসি।
একটা কথা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উঠেছে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ অর্থাৎ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হোক যাতে সব পক্ষের মানুষ নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে। পুলিশ হয়রানি বাড়ছে। তারা সঠিকভাবে মাঠে থাকতে পারছেন না। অনেক সময় দেখা গেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় তাদের বাধা দেওয়া হয়েছিল। কোথাও কোথাও বিএনপি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় অথবা তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় সরকারদলীয় প্রার্থীকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সরকারি জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থীও মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যতটা না নির্দেশ ছিল, স্থানীয় সরকারদলীয় প্রার্থী ও সমর্থকদের ভূমিকা ছিল বেশি। ফলে শঙ্কা তো থাকলই যে নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকছে না। নারী কাউন্সিলরদের প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও যা ঘটেছে, তা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের জন্য প্রতীক রাখা হয়েছিল চুড়ি, চকোলেট, পুতুল, ফ্রক, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি। এটা কী ধরনের মানসিকতা? এ ধরনের প্রতীক মহিলাদের জন্য রেখে পুরো নির্বাচন কমিশন তাদের মূর্খতা ও অযোগ্যতাই প্রমাণ করল না, বরং এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রমাণ রাখল। তারা যে কত অবিবেচক, এটা তারা আবারও প্রমাণ করলেন। তাই অনেকগুলো ‘প্রশ্ন’ ও ‘সম্ভাবনা’কে সামনে রেখে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
আজ নির্বাচন কমিশনের জন্য সুযোগ এসেছিল তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। নির্বাচনে অনিয়ম রোধ, স্থানীয় মাস্তানদের নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠে সমঅবস্থানের সুযোগ করে দেওয়া, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে কঠোর হওয়াÑ নির্বাচন কমিশন এই কাজগুলো যদি নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে এ দেশে ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’ নতুন একটি রূপ পেত। এটা না পারার ব্যর্থতার দায়টা এখন সরকারের চেয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর বেশি বর্তাবে। আমরা এক ‘অদৃশ্য অরাজনৈতিক সংস্কৃতি’তে আটকে আছি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে বহুমত বিকশিত হয়, ব্যক্তি তার অধিকার নির্বিঘেœ প্রয়োগ করতে পারে, প্রশাসন যেখানে থাকে নিরপেক্ষ, এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এখানে বিলুপ্ত হচ্ছে! বহুমতকে এখানে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব বাড়ছে। যেনতেন প্রকারেই হোক ক্ষমতা ধরে রাখাই হচ্ছে মুখ্য। আমরা যদি এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। এ নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করতে পারি। কিন্তু তাতে করে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। মূল ধারার রাজনীতিতে যদি বড় দলগুলো বাইরে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সংকটের মাত্রা বাড়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন ও পরে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন (মেয়র ও কাউন্সিলর) একটা ‘সম্ভাবনা’ তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি অতি উৎসাহীদের অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য। বুথ-কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে সিল মারা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এসব ঘটনার যে দৃশ্য জাতি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে দেখেছে, তা কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ভালো খবর নয়। এখন শুধু বিএনপিই বলছে না, বরং সরকারের ‘মিত্র’ এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও অনেকটা হতাশার সুরে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র চর্চার কোনো সুযোগ নেই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে দৃশ্য আমরা দেখেছি, সেই দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না। পৌর নির্বাচনে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হোক, এটা আমরা কেউই চাই না। কিন্তু ইসি আমাদের সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। পৌরসভা নির্বাচন সরকারের জন্যও একটা প্লাস পয়েন্ট। এই নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিয়েছেÑ এতে ‘সকল দলের অংশগ্রহণের’ যে সংস্কৃতি, তা নিশ্চিত করে সরকার তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে, সরকারি প্রভাব থাকলে, সরকারের ভূমিকা দুর্বল হবে। বহির্বিশ্বে সরকারের ভূমিকা নিয়ে আরও ‘প্রশ্ন’ উঠবে। বিদেশি বন্ধুদের কাছে সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা আরও হারাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কী পরিবর্তন আসে সেটাই দেখার বিষয়।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গত ২২ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির অনুষ্ঠানে বলেছেন, পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন কমিশনকে তিনি ‘মেরুদ-হীন’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। জনাব এরশাদের এই বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা তিনি এখনো মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’। সরকার থেকে তিনি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। ফলে তার বক্তব্য ‘সরকারের একটা অংশের’ বক্তব্য বলে মানুষ ভুল করতে পারে! জনাব এরশাদ নিজে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে পদত্যাগ করেননি। জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা এখনো মন্ত্রিপরিষদে আছেন। তিনি এ ধরনের বক্তব্য না দিলেও পারতেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সাধারণ মানুষ চায় নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। নিরপেক্ষ হোক। এই নির্বাচন সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে পারে। পৌর নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য তা হবে এক ‘অশনিসংকেত’। এবং ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচনে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত না হওয়ায় যে ‘রাজনৈতিক সংকটের’ জন্ম হয়েছিল, সেই ‘সংকট’ থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে পারব না। তাই সুস্থ গণতন্ত্রের স্বার্থে পৌর নির্বাচনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সহিংসমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। 
Daily Amader Somoy
27.12.15

প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে কী পেল বিশ্ব



ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলন (যা কপ-২১ নামে পরিচিত) শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এই ‘সমঝোতা’ কি আদৌ কার্যকর হবে? নাকি ১৯৯৭ সালে জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়োটোতে বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে আবারও! বলা ভালো, বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে কিয়োটো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল- বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলো সামগ্রিকভাবে বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ১৯৯০ সালের তুলনায় শতকরা ৫ দশমিক ২ ভাগ হারে হ্রাস করবে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, দেশটি হ্রাস করবে শতকরা ৭ ভাগ, ইইউর দেশগুলো করবে ৮ ভাগ, জাপান ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। ফলে কিয়োটো চুক্তি অকার্যকর হয়ে যায়। এরপর একের পর এক বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্যারিসে শেষ পর্যন্ত একটি সমঝোতা হলো বটে, এবং ফ্রান্সের এটা ছিল একটা ‘কূটনৈতিক অভ্যুত্থান’ কিন্তু সমঝোতাটি ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বলা হচ্ছেÑ এটা একটা ‘জগাখিচুড়ি সমঝোতা’। এটা কোনো চুক্তি নয়। চুক্তি হবে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিলের মধ্যে। ওই সময় জাতিসংঘের মহাসচিব নিউইয়র্কে একটি সম্মেলন ডাকবেন। এবং জাতিসংঘের অন্তর্র্ভুক্ত দেশগুলো চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। শতকরা ৫৫ ভাগ দেশ যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে (যার মাঝে আবার শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মাঝে ৫৫ ভাগ দেশ অন্তর্র্ভুক্ত থাকতে হবে) তাহলেই চুক্তিটি কার্যকর হবে। প্রশ্ন সেখানেই। বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো প্যারিসে উপস্থিত থেকে একটি সমঝোতা চুক্তির ব্যাপারে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী সংস্থাগুলোর চাপ, করপোরেট হাউসগুলোর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ইত্যাদি নানা কারণে বড় কিছু দেশ মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিপাবলিকানদের পেছনে বড় অর্থলগ্নি করেছে আন্তর্জাতিক তেল উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো। সুতরাং প্যারিসে ওবামা একটি সমঝোতার ব্যাপারে তার সমর্থন ব্যক্ত করলেও ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র নিউইয়র্কে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করবে কিনা সে প্রশ্ন থাকলই। চিন ও ভারত বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। কার্বন হ্রাসের ব্যাপারে এই দেশ দুটির যুক্তি হচ্ছেÑ কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করলে তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। চিন ও ভারত কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর এই কয়লা পোড়ানোর ফলে বায়ুম-লে প্রচুর কার্বন ড্রাইঅক্সাইড নির্গমন হয়, যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। ফলে দেশ দুটোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলই।
বিশ্বের ১৯৫টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রায় সবাই প্যারিস সম্মেলনে যোগ দিয়ে এই সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতির (যাদের একটা বড় অংশ আবার এনজিও প্রতিনিধি) ফলে সেখানে কত টন কার্বন নিঃসরণ হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কিন্তু কোপেনহেগেনে (২০০৯ সালের ডিসেম্বর) যে কপ-১৫ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার একটি পরিসংখ্যান আছে। প্রায় ১৫ হাজার প্রতিনিধি ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আর খরচ হয়েছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার। আর জাতিসংঘের মতে, এসব প্রতিনিধিকে আনা, নেওয়া, গাড়ি ব্যবহারের কারণে তারা বায়ুম-লে ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করেছিল। পাঠক, এ থেকে ধারণা করতে পারেন এবার কত টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুম-লে নিঃসরণ হয়েছে। কিন্তু ফল কী? একটি সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি হবে কয়েক মাস পর। চুক্তি মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বলা হচ্ছেÑ ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে। এর জন্য বায়ুম-লে কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হবে। প্রশ্ন এখানেইÑ কে কতটুকু হ্রাস করবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনকে কি একই কাতারে আমরা দেখব? কিংবা রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো কতটুকু কমাবে? এ ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। সমঝোতায় আছে উন্নত বিশ্ব জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার সাহায্য দেবে। এটা শুনতে ভালোই শোনায়। কিন্তু এই অর্থ কে দেবে? কোন দেশ কতটুকু দেবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত (ভালনারেবল ২০, রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন ইত্যাদি)। এই দেশগুলোর মাঝে অর্থ বণ্টনের ভিত্তি কী হবে? তৃতীয়ত, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই অর্থ কীভাবে ম্যানেজ করবে? কেননা উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত। বাংলাদেশে জলবায়ু ফান্ডে প্রাপ্ত টাকা বরাদ্দ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। এক সময় কথা হয়েছিল প্রাপ্ত টাকা বিলি-বণ্টনের বিষয়টি দেখভাল করবে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু এক সময় বিশ্বব্যাংক এখান থেকে সরে যায়। বিষয়টি যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়, বরং উন্নয়নশীল বিশ্বেরও। বিশেষ করে সাগরপাড়ের অনেক দেশ নিয়ে এ রকম সমস্যা আছে। সমঝোতা স্মারকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ দেখা হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও অত কঠোর নয়। অর্থাৎ সাগরপাড়ের দেশগুলো, যারা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে, সাগর-মহাসগরে পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে, তাদের বিশাল এলাকা সাগরগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কোনো ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারবে না। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসবে তাদের মর্জিমাফিকের ওপর।
একটা সমঝোতা স্মারকে দেশগুলো স্বাক্ষর করেছে। এর প্রয়োজন ছিল। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা যে বেড়ে যাচ্ছে, সাগর উত্তপ্ত হচ্ছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছেÑ এ সবই বাস্তব। এ ব্যাপারে কারও কোনো বক্তব্য নেই। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, গ্রিনল্যান্ড ও এনটার্কটিকায় বরফ গলছে। এর জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া প্রয়োজন ছিল। এটা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু কর্মপরিকল্পনাটা কী, কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে তার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্যারিস সম্মেলনে নেওয়া হয়নি। এটা বলা যাচ্ছে বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বায়ুম-লে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ শিল্পে, কলকারখানায়, যানবাহনে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে বায়ুম-লে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু এই জ্বালানির ব্যবহার আমরা কমাব কীভাবে? জ্বালানি ব্যবহারের সাথে উন্নয়নের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। জীবাশ্ম জ্বালানি কম ব্যবহার করলে কার্বন নিঃসরণ কম হবে, এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বের কাছে কি বিশাল জ্বালানি আছে? উন্নয়নশীল বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বের কাছে ‘নয়া প্রযুক্তি’ থাকলেও তাদের অনীহা রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই প্রযুক্তি সরবরাহে। সোলার এনার্জির একটা বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে এই এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে না। বাংলাদেশে যে পরিমাণে এর ব্যবহার বাড়ানো উচিত ছিল তা কিন্তু হয়নি। কেননা এর জন্য যে খুচরা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, তা বিদেশ থেকে আনতে হয়। খরচ অনেক বেশি পড়ে, যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে পড়ে না। এ সেক্টরে যতদিন পর্যন্ত না বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে, ততদিন বিকশিত হবে না। আর এই সেক্টর বিকশিত না হলে মানুষ জ্বালানির জন্য নির্ভরশীল থাকবে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় মানুষের নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এমনকি সাগরপাড়ের দেশগুলোর জ্বালানি দরকার। তারা বিকল্প জ্বালানি অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্ভাবন করতে পারেনি। ফলে তাদের পক্ষে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করাও সম্ভব হবে না।
ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল যে, প্যারিস চুক্তি শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে? মার্কিন তথা বাংলাদেশীয় সংস্থাগুলোর স্বার্থ এখানে বেশি। জ্বালানি একটা বিশাল ‘ব্যবসা’। এই ‘ব্যবসা’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা কখনই চাইবে না বাংলাদেশীয় সংস্থাগুলো। প্যারিসে একটি সমঝোতা হয়েছে। এর প্রয়োজন ছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওসিসটেমের অধ্যাপক মাইলেস এলেন তাই ইতোমধ্যে প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ৩৫০ অঙ্গসংগঠনটির প্রধান বিল মেকিব্বেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনের সাথে জড়িত বড় বড় ব্যবসায়িক তথা বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কারণে এই ‘সমঝোতা’ শেষ পর্যন্ত ভ-ুল হয়ে যাবে। দাতব্য সংস্থা অক্সফামও তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ফলে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। যারা অনলাইনে নিয়মিত বিভিন্ন জার্নাল পাঠ করেন, তারা দেখবেন প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ করার সংখ্যাই বেশি। তারপরও একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এতগুলো দেশ এক সাথে প্যারিসে মিলিত হয়েছিল। বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই সেখানে গিয়েছিলেন। এবং তারা সবাই এক বাক্যে একটি চুক্তির কথা বলেছেন।
বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধি প্যারিসে পাঠানো হয়েছিল। বন ও পরিবেশমন্ত্রী সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বাংলাদেশ প্যারিস সমঝোতাকে স্বাগত জানালেও প্রতিনিধি দলের কোনো কোনো সদস্য স্বীকার করেছেন সমঝোতা স্মারকে অনেক বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে। এমনকি শিল্পোন্নত দেশগুলো যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বা আইএনডিসি জমা দিয়েছে তা রিভিউ করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন ডিগ্রির বেশি বাড়বে। অথচ চুক্তিতে ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ বছর পর কার্বন নিঃসরণ কমানোর পর্যালোচনায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর লক্ষ্যমাত্রা পুনঃনির্ধারণ প্রয়োজন। সমঝোতা স্মারকে দুর্বলতা থাকলেও একটি ঐকমত্য হয়েছে, এটাই বড় কথা। শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের ‘কমিটমেন্ট’ এবার রক্ষা করবে, এটাই সবাই আশা করে
Daily Amader Somoy
20.12.15

সন্ত্রাসবিরোধী জোটে বাংলাদেশ : অনেক প্রশ্ন

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জোটে বাংলাদেশু যোগ দিয়েছে। এই জোটকে বলা হচ্ছে ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজম’ (আইএমএএফটি)। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই এই জোটের জন্ম। এখানে কোনো একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কথা বলা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া-ইরাকে জন্ম নেয়া ইসলামিক স্টেট বা দায়েশের (আরবি নাম) বিরুদ্ধে আলাদাভাবে বিমান হামলা পরিচালনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ও রাশিয়া। অনেক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি জোট- ‘দ্য গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল’। এখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে আইএসআইএল তথা ইসলামিক স্টেটের কথা। ৬৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের মূল টার্গেট ইসলামিক স্টেট। এখন এর পাশাপাশি গঠিত হল আইএমএএফটি। একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরটির নেতৃত্বে সৌদি আরব। উভয় জোটের স্বার্থ কি এক? অর্থাৎ উভয় জোটই কি ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে? বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এ জোটে যোগ দেয়নি। এখন সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশ যোগ দিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিল না কেন? নাকি ওই জোটে যোগ দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগে সৌদি জোটে যোগ দিল! মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ নীতির কথা আমাকে বলতে চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এক টিভি টকশোতে তিনি আমাকে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন। তবে জানিয়েছিলেন, ‘অসামরিক ও জাতিসংঘের উদ্যোগে যে কোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।’ অর্থাৎ আমি ধরে নিয়েছি, যদি কোনো ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে সিরিয়ায়, তাহলে বাংলাদেশ মার্কিন জোটকে সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনে জোটে যোগ দেবে। এখন সৌদি জোটে, যার চরিত্র অনেকটা সামরিক, বাংলাদেশ যোগ দিল। ফলে জোটে যোগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার, বেশ কিছু দেশ রয়েছে যেগুলো উভয় জোটেই আছে (জর্ডান, আরব আমিরাত, বাহরাইন, তুরস্ক, কুয়েত ইত্যাদি)। সৌদি আরব মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটেও আছে। এখন অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এলো। সৌদি আরব নিজে যেখানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে রয়েছে এবং ওই জোটেরও টার্গেট আইএসের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড জব্দ করা, সেখানে দেশটি আলাদাভাবে কেন সন্ত্রাসীদের উৎখাতের নামে আলাদা একটি জোট গঠন করল?এর অনেক কারণ আছে। এক. সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘অ্যাক্টর’ অর্থাৎ অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখাতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। দুই. সৌদি আরব পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর লক্ষণ হিসেবে আমরা দেখেছি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমান বাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংক বহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে, কিন্তু আমিরের সমর্থনে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনিশিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইনাল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও এবং বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনিশিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলস্বরূপ নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। তিন. সৌদি আরবের নীতিনির্ধারকদের একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে। ইরানের এই ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ছয়-জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরানের বিখ্যাত দার্শনিক রামিন জাহানবেগলুর (Ramin Jahanbegloo) একটি মন্তব্য আমি উল্লেখ করতে চাই। জাহানবেগলু লিখেছিলেন, 'from now on Iran will be a full partner in the big game in the Middle East and the world including through intensified sectarian proxy wars in the region.' অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে সিয়া-সুন্নি যে দ্বন্দ্ব, সেখানে ইরান একটি ফ্যাক্টর এবং ইরানকে সঙ্গে নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে (পাঠক ইয়েমেন, ইরাক, লেবানন এবং সৌদি আরবে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন)। সৌদি রাজবংশের ভয়টা এখানেই- খোদ সৌদি আরবে শিয়া প্রভাবাধীন একটি অভ্যুত্থান এবং সেই অভ্যুত্থানে রাজবংশের উৎখাতের আশংকা! এখন তথাকথিত ‘সন্ত্রাস দমনের’ নামে একটি বৃহত্তর সামরিক জোট সৌদি আরবের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে পারে। চার. এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে, সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন, ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্র ‘সুন্নিস্তান’-এর জন্ম হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতাদর্শ। এ ক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতিনির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই। সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। পাঁচ. সৌদি আরবের আয়ের উৎস হচ্ছে তার তেলসম্পদ। সৌদি আরবে প্রমাণিত জ্বালানি তেলের রিজার্ভের পরিমাণ ২৫৯ মিলিয়ন ব্যারেল (বিশ্বের ২৪ ভাগ)। দৈনিক উৎপাদন ৭৯ লাখ ব্যারেল। তেলের দাম কমে যাওয়ায় সৌদি রিজার্ভে টান পড়েছে। এটাও হতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থলযুদ্ধ শুরু করে সৌদি আরব তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে চায়। মার্কিন জনমত যুদ্ধের বিপক্ষে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ওবামা প্রশাসন ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আর ‘যুদ্ধ’ শুরু করতে চায় না। এক্ষেত্রে সৌদি আরব একটি ‘প্রক্সি ওয়ার’ শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মোদ্দা কথা, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ একটি সামরিক জোট গঠনে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যকে হালকাভাবে নেয়া যাবে না।২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ শুরু করেছিল, তখন কিন্তু সৌদি আরবকে অতটা তৎপর দেখা যায়নি। সঙ্গত কারণেই ২০১৫ সালে এসে সৌদি আরব যখন সন্ত্রাসবিরোধী একটি জোট গঠন করার উদ্যোগ নেয়, তখন নানা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এখানে সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিল কেন? বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ নীতি অনুসরণ করে আসছে। এখন এই জোটে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশ সেই নীতি থেকে সরে এলো কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। উপরন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫তম অনুচ্ছেদে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, সংহতি ও উন্নয়নে’র কথা বলা হয়েছে। ২৫(ক)-তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন’। অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথাও বলা হয়েছে ওই অনুচ্ছেদে। তাই জোটে যোগ দিয়ে আগামীতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ করবে কিনা, ‘শক্তিপ্রয়োগে’ অংশ নেবে কিনা, এ প্রশ্ন থাকলই। যদিও জোটের পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা কী হবে তা এ মুহূর্তে স্পষ্ট নয়।পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই জোটের উদ্যোগে রিয়াদে একটি কেন্দ্র হবে। এবং এই কেন্দ্রের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে। তবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ আমাদের জানাচ্ছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামরিক অভিযান সমন্বয় ও তাতে সহায়তা করতে সৌদি নেতৃত্বাধীন এ জোট গঠন করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ আরও যুক্তি দেখিয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির অংশ হিসেবে অন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ এই কেন্দ্রে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তত্ত্বগতভাবে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে তথ্য বিনিময় আমাদের অনেক সাহায্য করবে। বাংলাদেশে আইএসের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক আছে। আইএস আছে কী নেই, এ নিয়ে সংশয় আছে। সাইট ইন্টেলিজেন্সের পক্ষ থেকে আইএসের অস্তিত্ব এবং বেশ ক’টি হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে আইএসের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হলেও বাংলাদেশ সরকার তা অস্বীকার করেছে। এখন যদি আগামীতে এই জোট আইএসের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, তাহলে বাংলাদেশ আইএসের টার্গেটে পরিণত হতে পারে। এতে করে বাংলাদেশে আইএসের হুমকি আরও বাড়বে। আল কায়দা এ অঞ্চলে (অর্থাৎ ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমারে) তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে সে খবর আমরা জানি না। তবে স্থানীয় জঙ্গিরা যে আল কায়দা ও আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে- এ খবর গোয়েন্দারা আমাদের জানিয়েছে। এখন একটা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল, বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে।সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবে, সে ব্যাপারে এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এক সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। সংবিধানের এই ধারাটি এখন আর নেই। বাতিল করা হয়েছে। ফলে সৌদি জোটে যোগদানের কোনো প্রয়োজন আমাদের ছিল না। ভারত কোনো জোটেই যোগ দেয়নি। ওমানও যোগ দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ দিল। এই জোটে অন্য যেসব দেশ রয়েছে, সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে সবাই দুর্বল।বিশ্বে বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্ব যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছে। এখন সৌদি আরব বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। অথচ সৌদি আরব এখনও বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে দেয়নি। ফলে জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে- এ প্রশ্ন থাকলই। তবে এই জোটের ভবিষ্যৎ ইতিমধ্যে নানা প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে। জোটের অন্যতম শরিক পাকিস্তান কিছুটা অবাকই হয়েছে এই জোট গঠনে এবং জোটে পাকিস্তানের নাম থাকায়। তাদের বক্তব্য, পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ না করেই এ জোটের ঘোষণা দেয়া হয়। আমি নিশ্চিত নই, এই জোট গঠনে বাংলাদেশের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আদৌ হয়েছিল কিনা। সৌদি আরব এ ধরনের একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছে, কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রারম্ভিক আলোচনা হয়েছে- এটাও আমাদের অনেকের জানা নেই। ফলে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যখন ১৫ ডিসেম্বর এই জোট প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন, তখন বিষয়টি আমাদের অবাকই করেছে। এমন হয়েছে কিনা- সৌদি আরব একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে তা জোটবদ্ধ দেশগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে শুধু? এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। জোট নিয়ে পাকিস্তানের প্রশ্ন তোলা এই আশংকাকেই সামনে নিয়ে এলো মাত্র। Daily Jugantor 19.12.15

ট্রাম্পের মুসলমানবিদ্বেষ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নতুন মাত্রা

যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বক্তব্য নতুন করে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে সব মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নাডিনোতে এক মুসলমান দম্পতির হামলায় ১৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর ট্রাম্প এই আহ্বান জানালেন। ট্রাম্পের এই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আমেরিকা ও ইসলামকে কখনোই মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না।’ একজনের দোষের জন্য কখনো পুরো ধর্মকে দোষারোপ করা যাবে না বলেও মনে করেন ওবামা। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনও ট্রাম্পের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। আর পেন্টাগনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের এই বক্তব্য জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করেছে। প্যারিসে নভেম্বরে আইএস জিহাদিদের হাতে ১২৯ জন মানুষ নিহত হওয়ার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রে তাসফিন মালিক ও সৈয়দ রিজওয়ান ফারুক দম্পতির গুলিতে মারা গেল ১৪ জন। এই দম্পতির সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। এর আগে ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে হামলা, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে নাইরোবির ওয়েস্ট গেটমলে হামলা, জানুয়ারিতে (২০১৫) প্যারিসের শার্লি এবদো ম্যাগাজিন কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা—সবই একই সূত্রে গাঁথা। এসব হামলা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ার হামলারই নতুন এক রূপ। অর্থাত্ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা ও এক দেশ থেকে অন্য দেশে তা ছড়িয়ে দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব শক্তিশালী হচ্ছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা চালাতে পারে—এমন একটি আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে আসিয়ান সম্মেলনের প্রাক্কালে সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে ইসলামিক জঙ্গিরা তত্পর। এদের কর্মকাণ্ড একাধিকবার আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দিয়েছে। ফিলিপাইনে আবু সায়াফ গ্রুপের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় জামিয়া ইসলামিয়ার হাতে বিদেশি নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এই দেশ দুটি সম্পর্কে বিশ্বে একটি বাজে ধারণার জন্ম দিয়েছে। এ অঞ্চলে আইএসের নেটওয়ার্ক কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে, তা জানা না গেলেও আল-কায়েদার প্রভাব আছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে আল-কায়েদা একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের জঙ্গিরাও যে এতে উত্সাহিত হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জঙ্গি তত্পরতার সঙ্গে ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীকে জড়িত করলেও অভিযুক্ত জঙ্গিদের ব্যক্তিজীবন ও তাদের জীবনধারা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্যারিস হামলার মূল পরিকল্পনাকারী আবদুল হামিদ আবাউদ নিজে কোনো দিন কোরআন পড়েননি, নামাজও পড়তেন না। তাঁর চাচাতো বোন নারী বোমাবাজ হাসনা আইত বুলাচেন পশ্চিমা সংস্কৃতি ও জীবনে বিশ্বাসী ছিলেন—এমনটাই জানা যায়। ফলে জঙ্গি তত্পরতার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই অনেকে মনে করেন।
যে প্রশ্নটি এখন অনেকেই করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে এর শেষ কোথায়? প্যারিস কিংবা ক্যালিফোর্নিয়ার ট্র্যাজেডিই কি শেষ? যেভাবে প্যারিসে এখনো সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তাতে কি এ ধরনের হামলা ভবিষ্যতে রোধ করা সম্ভব হবে? এর জবাব সম্ভবত ‘না’ বাচক। কেননা ইউরোপে বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আইএস। একটি ‘শক্তি’ তাদের উত্সাহ জোগাচ্ছে। সম্ভবত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই আন্দোলনের পেছনে। সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতেও হবে বলে আশঙ্কা করছি। কতগুলো উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ৯/১১-এর পর যেভাবে একটি ‘মুসলমানবিদ্বেষী’ মনোভাব সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল, আজ প্যারিস ঘটনাবলির পর সারা ইউরোপেও তেমনি একটা ‘মুসলমানবিদ্বেষী’ মনোভাব ছড়িয়ে গেছে। এখানে মুসলমানরা (যেসব শরণার্থীকে ইতিমধ্যে ইউরোপে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে) সব সময় থাকবে এক ধরনের ‘নিরাপত্তাবলয়’-এর ভেতর। তাদের সব কর্মকাণ্ড মনিটর করা হচ্ছে। তারা ইউরোপে আশ্রয় পেয়েছে বটে; কিন্তু তাদের এক ধরনের ‘বস্তিজীবন’ যাপনে বাধ্য করা হবে। তাদের জন্য তৈরি করা হবে ‘কংক্রিটের বস্তি’ এবং সেখানেই তাদের বসবাসে বাধ্য করা হবে। ইউরোপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা হবে। জার্মানিতে হিটলার যেভাবে ইহুদিদের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ রাখতেন কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী যুগে যেভাবে হোমল্যান্ড সৃষ্টি করে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখা হতো, অনেকটা সেভাবেই সিরীয় মুসলমান অভিবাসীদের এখন এক ধরনের ‘ঘেটো’ জীবনযাপনে বাধ্য করা হবে। উগ্রপন্থীরা তথা কনজারভেটিভরা প্যারিস ঘটনায় ‘উপকৃত’ হয়েছে। ফ্রান্সে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। তারা নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। এখন তাদের দিয়ে এক ধরনের ‘নোংরা রাজনীতি’ করানো হবে। অর্থাত্ ‘ইউরোপ হবে মুসলমানমুক্ত’—এ ধরনের একটি স্লোগান ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে পোল্যান্ডসহ বেশ কটি দেশ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাদ দিয়ে খ্রিস্টীয় ধর্মাবলম্বী শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সেখানে কট্টরপন্থীরা সক্রিয় হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য এর বড় প্রমাণ। তাঁর এই মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব বাহ্যত আইএসকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘অবস্থান’ করতে সাহায্য করবে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ৬৫ দেশের সমন্বয়ে একটি আইএসবিরোধী অ্যালায়েন্স রয়েছে। রাশিয়া এই জোটে নেই। কিন্তু রাশিয়া আলাদাভাবে আইএসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। তবে অচিরেই আইএসবিরোধী অভিযানে ফাটল দেখা দেবে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মাঝে যদি ফাটল থাকে, তাতে লাভ ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের। অধ্যাপক চসসুডোভস্কি তাঁর বহুল আলোচিত গ্রন্থ ঞযব ষেড়নধষরুধঃরড়হ ড়ভ ডধত্ : অসবত্রপধ'ং খড়হম ধিত্ ধমধরহংঃ ঐঁসধহরঃু গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ‘হাত’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যে অভিযান পরিচালনা করে আসছে, তাতে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য কাজ করছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা, অর্থনৈতিক অবরোধ ও সরকার পরিবর্তন। ইরাক ও লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে এই স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করা হলেও তা সফল হয়নি। এই স্ট্র্যাটেজি কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারেনি। যেসব দেশে এই স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে দরিদ্রতা বেড়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে এবং এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে (ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়া)। ‘মানবাধিকার রক্ষা ও পশ্চিমা গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা সেখানে কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
ইউরোপে কিংবা পশ্চিম আফ্রিকায় অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে সেখানে সন্ত্রাসীরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এতে সন্ত্রাসীরা প্যারিসের সমাজজীবনের কত গভীরে প্রবেশ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক স্থানে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। খোদ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ যখন একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ উপভোগ করছিলেন, ওই স্টেডিয়ামের বাইরে তখন তিন আত্মঘাতী বোমারু নিজেদের বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল। গোয়েন্দারা সেটা আঁচ করতে পারেনি। চিন্তা করা যায় সন্ত্রাসীরা কালাশনিকভ রাইফেল ব্যবহার করে ‘পাখির মতো’ নির্বিচারে একটি কনসার্ট হলে মানুষ হত্যা করেছিল। এই রাইফেল সিরিয়া থেকে আসেনি। সংগ্রহ করা হয়েছিল ফ্রান্সের ভেতর থেকেই। ফ্রান্সে যে এ রকম একটি হামলা হতে পারে, তা ইসলামিক স্টেটের প্রপাগান্ডা ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এ ফেব্রুয়ারি মাসের সপ্তম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্স কেন, সব ইউরোপীয় রাষ্ট্র তথা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা এখানেই যে ‘দাবিক’-এ অভিযুক্ত আবাউদের (ফ্রান্সে তাঁর পরিচিতি ছিল আবু উমর আল বালঝিকি নামে) সাক্ষাত্কার ছাপা হলেও তা প্রতিরোধে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যেমনটি তারা নিতে পারেনি নিউ ইয়র্কে  ‘টুইন টাওয়ার’-এর ক্ষেত্রেও। টুইন টাওয়ারে হামলার ১৪ বছর পর প্যারিসে বড় ধরনের একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলো। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরপরই আইএসের অপারেটিভরা ক্যালিফোর্নিয়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালাল।
২০০১ সালে অস্তিত্ব ছিল আল-কায়েদার। আজ দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামিক স্টেট। টার্গেট একটাই—মুসলমানবিরোধী একটা জগত্ গড়ে তোলা। ২০০১ সালের পর দীর্ঘদিন মুসলমানবিরোধী একটা মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন মুসলমানরা, যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক তারা সেখানে একটা আতঙ্কের মধ্যে ছিল। সেই পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে মুসলমানরা যখন মার্কিন সমাজে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে, ঠিক তখনই ক্যালিফোর্নিয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আইএসের সম্পৃক্ততা ‘আবিষ্কৃত’ হলো। তাসফিন রিজওয়ান দম্পতি যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে পুলিশ হানা দিয়ে বেশ কিছু বিস্ফোরকও পেয়েছে। এ খবর আমরা পেয়েছি পত্রপত্রিকা থেকে। এ ঘটনা মার্কিন সমাজে যে প্রভাব ফেলবে, মুসলমানবিদ্বেষী একটা মনোভাব যে আবারও সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে, তা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব কেন শক্তিশালী হয়েছে তার স্পষ্ট কারণও রয়েছে। তুলনামূলক বিচারে মার্কিন সমাজে মুসলমানরা অতটা ভয়ংকর নয়, বরং শান্ত ও শিক্ষিত। মাত্র ১ শতাংশ মুসলমান বাস করে যুক্তরাষ্ট্রে। ২০৫০ সালে তা হবে ২.১ শতাংশ। মুসলমানরা যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার হারে দ্বিতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী। এমনকি মার্কিনিদের চেয়েও মুসলমানরা শিক্ষিত। প্রথম অবস্থানে রয়েছে ইহুদিরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রায় দুই হাজার ৫০০ মসজিদ রয়েছে, যে মসজিদগুলো প্রধানত জাতিগতভাবেই প্রতিষ্ঠিত। যেমন বাংলাদেশি মুসলমানদের নিজস্ব মসজিদ রয়েছে, তেমনি পাকিস্তানি আমেরিকানদেরও আলাদা মসজিদ রয়েছে। ৯/১১-এর ঘটনাবলির পর এই মসজিদগুলো বারবার আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশি আমেরিকানরা যেখানে বসবাস করে (বিশেষ করে নিউ ইয়র্কে) সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে তারা বাসাবাড়িতে মার্কিন পতাকা উত্তোলন করে রেখেছে দীর্ঘদিন। সেই পরিস্থিতি অবশ্য এখন আর নেই। তবে সর্বশেষ ক্যালিফোর্নিয়ার ঘটনাবলির পর মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাবটা আবার চাঙ্গা হবে এবং রিপাবলিকানরা এটাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইস্যু করবে—এটা দিব্যি দিয়ে বলা যায়। ব্যক্তিজীবনে ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত। চূড়ান্ত বিচারে তিনি মনোনয়ন না পেলেও মনোনয়নপ্রত্যাশী ট্রেড ক্রুজ কিংবা বেন কারসন কোনো অংশে কম যান না। মুসলমানবিদ্বেষী হিসেবে এ দুজনেরও পরিচিতি আছে। ক্যালিফোর্নিয়ার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এই দৌড়ে জেব বুশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। রিপাবলিকান শিবিরে কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী হচ্ছে। ওবামা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মার্কিন সমাজে যে মুসলমানবিরোধী জনমত শক্তিশালী হচ্ছে, তা তিনি উপেক্ষা করবেন কিভাবে? টেক্সাসের স্কুলের ছোট্ট বালক আহমেদ মোহাম্মদের ‘কাহিনী’ নিশ্চয়ই আমাদের সবার মনে আছে। ফলে আগামী দিনগুলোতে আমরা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এর নতুন এক রূপ প্রত্যক্ষ করব। ১৪ বছর পর নতুন করে আবারও ‘মুসলমানবিরোধী’ রাজনীতি শুরু হবে! সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন মেরিন সেনা পাঠালেও লিবিয়ায় ওবামা কোনো সেনা পাঠাননি। এমনকি সিরিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর একটা সম্ভাবনা তৈরি হলেও (২০১৪) ওবামা শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বোমাবর্ষণের নির্দেশ দিতে তিনি ভুল করেননি। পরিস্থিতি গত এক বছরে আরো অবনতি হয়েছে। আইএস জঙ্গিরা তাদের জঙ্গি তত্পরতা  বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে তত্পর হয়েছে। আবারও নতুন করে এক ধরনের ‘ইসলাম ফোবিয়ায়’ আক্রান্ত হতে পারে বিশ্ব! ‘৯/১১ সিনড্রোম’ (টুইন টাওয়ারে হামলা, ২০০১) নতুন করে আবার ফিরে আসছে! অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায় নতুন করে যে ‘ইসলাম ফোবিয়া’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তাতে রিপাবলিকানদের ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে পারে। যারা পর্দার অন্তরালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাজনীতি’ নিয়ন্ত্রণ করে তারা এটিই চাইছে। বিশ্বে উত্তেজনা কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, তথাকথিত এই ‘ইসলাম ফোবিয়া’ অর্থাত্ মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব বিশ্বে আবার নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। এতে বিস্মিত হবে বিশ্বশান্তি। Daily Kalerkontho 15.12.15

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক মূল্যায়ন প্রসঙ্গে কিছু কথা

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি সরকার মূল্যায়ন করছে বলে আমাদের জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। ৬ ডিসেম্বর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন (আমাদের সময়, ৭ ডিসেম্বর)। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বললেন এমন এক সময়Ñ যখন পাকিস্তানি নেতাদের নানা ধৃষ্টতামূলক মন্তব্য বাংলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং কোনো কোনো মহল থেকে প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানানো হয়। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় তারা যে ‘উদ্বিগ্ন’ ও ‘বেদনাগ্রস্ত’Ñ এ কথাটিও তারা উল্লেখ করতে ভোলেননি। শুধু তা-ই নয়, ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে ডেকে তারা বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বা নৃশংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং এ ধরনের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের কোনো দায় ছিল না।’ কী ধৃষ্টতাপূর্র্ণ কথা! মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান কোনো অপরাধ করেনি! তাহলে কারা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল? কারা আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছিল? মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনারা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা তো একাধিক রিপোর্টে আছে। অ ১৯৭২
জবঢ়ড়ৎঃ নু ঃযব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়সসরংংরড়হ ড়ভ ঔঁৎরংঃং, মার্কিন কংগ্রেসে দেওয়া প্রয়াত সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির বক্তব্যÑ যা ছাপা হয়েছিল ডধংযরহমঃড়হ চড়ংঃ-এ ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট, এঁরহহবংং ইড়ড়শ ড়ভ জবপড়ৎফং, এবড়ৎমব ডধংযরহমঃড়হ টহরাবৎংরঃু’ং ঘধঃরড়হধষ ঝবপঁৎরঃু অৎপযরাবং, অহঃযড়হু গধংশধৎবহযধং-এর ঝঁহফধু ঞরসবং-এর প্রতিবেদনে (১৩ জুন, ১৯৭১) উল্লেখ আছে গণহত্যার কথা। আজ এত বছর পর এই গণহত্যার প্রশ্ন তোলা এবং পাকিস্তানি সেনারা এ গণহত্যা চালায়নিÑ এ প্রশ্ন তোলা অবান্তর। আজ পাকিস্তান এ প্রশ্নটি তুলে দুই দেশের সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করছে। এ প্রসঙ্গে আমি জাতিসংঘ সনদের মূলনীতির ১ ও ৭ নম্বর ধারাটি উল্লেখ করতে চাই। ১ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সকল সদস্যের সার্বভৌমত্ব ও সমতার মূলনীতির উপর এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত।’ আর ৭ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সনদ জাতিসংঘকে কোনো রাষ্ট্রের নিছক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোনো সদস্যকে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে না।’ এ ধারাটি যদি আমরা অনুসরণ করি তাহলে দেখা যাবে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জাতিসংঘ সনদের মূলনীতির ৭ নম্বর ধারাকে ‘কনট্রাডিক্ট’ করে। এই ধারা অনুযায়ী পাকিস্তানের কোনো অধিকার নেই বাংলাদেশের কোনো অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য বা সমালোচনা করার। ফলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বক্তব্যটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন মহল থেকে এর সমালোচনা করা হয়েছে। ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর বাংলাদেশের বিজয় দিবসে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ তখনো এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল পাকিস্তান। আসলে ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে ৪১ বছরের ইতিহাসÑ এ  ইতিহাস সব সময় ‘আস্থা ও বিশ্বাস’-এর নিরিখে পরিচালিত হয়েছে, এটা বলা যাবে না। এই সম্পর্ক উজ্জ্বল ছিলÑ এটিও বলা যাবে না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা ছিল, এর সমাধান হয়নি এতদিন পরও। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। একটি মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়েছিল এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনোর ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পাকিস্তান কখনোই সম্মান জানায়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে হত্যাযজ্ঞ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চালিয়েছিল, এ জন্য ক্ষমাও চায়নি কোনোদিন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হলেও পাকিস্তানের নেতারা তা করেননি। এমনকি পাকিস্তানের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধি পাকিস্তান সরকারের প্রতি ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানালেও পাকিস্তানে অতীতে কোনো সরকারই এ কাজটি করেনি। বরং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ‘এসব পুরনো কথা’ এবং ‘এসব ভুলে’ সামনের দিকে তাকাতে বলা হয়েছে। কিন্তু একাত্তরে গণহত্যার কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যায় কীভাবে? পাকিস্তান সরকার কিংবা শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো এই গণহত্যা স্বীকার করে না তাদের দলীয় স্বার্থে। তবে শুভবুদ্ধির কিছু মানুষ আছেনÑ যারা গণহত্যার কথা স্বীকার করেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছে, ঠিক তখনই ঢাকায় পাকিস্তানের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের চেয়ারপারসন হিনা জিলানি স্বীকার করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশটির নাগরিকদের একটি অংশ। তিনি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা স্বীকার করেন (একটি জাতীয় দৈনিক, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫)। তাই পাকিস্তানের শাসকচক্র ১৯৭১ সালের গণহত্যার কথা স্বীকার না করলেও সাধারণ মানুষের একটি অংশ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম মনে করেÑ সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা ছিল, তার সমাধান হয়নি। ‘ডেড ইস্যু’ অর্থাৎ এগুলো মূল্যহীন।
১৯৭৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়টা অনেক লম্বা। এত দীর্ঘ সময় দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর পূর্ণ সমাধান হয়েছে, তা বলা যাবে না। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদ ফেরত, বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন হয়নি। পাকিস্তানের কাছে পাওনা সম্পদের বিষয়টি একাধিকবার বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। ১৯৭৪ সালে প্ল্যানিং কমিশন ২ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা পাওনা দাবি করে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭১ সালের যুক্ত পাকিস্তানের সম্পত্তি, জনসংখ্যা, সংখ্যাসাম্য নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে ওই পাওনা টাকার দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। গত ৪০ বছরে এ ব্যাপারে তেমন অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে এই দাবি উত্থাপন করলেও পাকিস্তান এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায়নি। তবে ‘বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ’ বাংলাদেশ বিমানকে একটি পুরনো টাইপের বোয়িং বিমান দিয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু যুক্ত পাকিস্তানের সম্পদের তুলনায় তা কিছুই নয়। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় পাকিস্তান নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে একটি ‘কাউন্সিল’ গঠন করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারেও পরবর্তী সময়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানি নাগরিকরা ‘বিহারি’ হিসেবে পরিচিত। এসব পাকিস্তানি নাগরিক এখনো পাকিস্তানে যেতে চান। এটি সত্য, আটকেপড়া কয়েক পাকিস্তানি ইতোমধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছেন। প্রায় ২ লাখ পাকিস্তানি এখনো ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছেন। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক তাদের নিতে রাজি থাকলেও পরে বেনজির ভুট্টোর বিরোধিতার কারণে ওই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে যায়। বেনজির ভুট্টো তাদের পাকিস্তানি বলতেও রাজি ছিলেন না। বর্তমানে এ ব্যাপারে তেমন কিছু শোনা যায় না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেভাবে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, তাও হয়নি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ২৭ দশমিক ৬ ভাগ হারে। অথচ বাংলাদেশ থেকে আমদানি বেড়েছে মাত্র ৯ দশমিক ২ ভাগ হারে। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণও কমতির দিকে।
২০১০-১১ সময়সীমায় বাণিজ্যের পরিমাণ যেখানে ছিল ৯৮৩ মিলিয়ন ডলার, বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৪০ মিলিয়ন ডলারে। পাকিস্তানি নাগরিক, এমনকি ঢাকায় দূতাবাসের কর্মচারীরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অপকর্মে নিজেদের জড়িত করছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে ভারতীয় জাল নোটের ‘অবৈধ ব্যবসা’ তথা পাচারের সঙ্গে পাকিস্তানি বেশকিছু নাগরিক জড়িত। কয়েকজন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছে। এমনকি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাজহার খান (তিনি ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশনে কর্মরত ছিলেন) ‘অকূটনৈতিক কাজ’-এ জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ তাকে বহিষ্কার করেছিল। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বিস্তারে কোনো কোনো পাকিস্তানি জড়িতÑ এমন অভিযোগও আছে।
সার্ক, কমনওয়েলথ, ডি-৮ কিংবা ওআইসিসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় থাকার কথা থাকলেও তা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় পাকিস্তান যখন ‘হস্তক্ষেপ’ করে, তখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও অবনতি হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানিদের নেতিবাচক প্রচারটি বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম সহ্য করবে না। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব আরও শক্তিশালী হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি সামাজিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। আর্থিক ভিত্তি, নারী শিক্ষা,  বৈদেশিক রিজার্ভ, মুদ্রামান স্বাস্থ্যসেবা, শিুশ মৃত্যুহার কমানো, রেমিট্যান্স ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিসস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে।
আমাদের জন্য পাকিস্তান কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ‘মডেল’ নয়। সার্কে এ দুটি দেশ আছে বটে কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পাকিস্তান মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ককে যতটুকু গুরুত্ব দেয়, সার্কের সঙ্গে সম্পর্ককে এখন আর অত গুরুত্ব দেয় না। বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তান তার মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আনে, তাহলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতি হতে বাধ্য। পাকিস্তান তার মানসিকতায় পরিবর্তন আনবেÑ এই বিশ্বাসও রাখতে পারছি না। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের কথা বলেন, তখন আমরা স্পষ্ট নইÑ ওই পুনর্মূল্যায়ন বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। কিন্তু এটি করা বোধহয় ঠিক হবে না। এটি করা হলে বিশ্বসমাজে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বাজে ধারণা পৌঁছে যেতে পারে। পাকিস্তানে অবস্থিত বাংলাদেশ তার হাইকমিশনকে ‘ডাউন গ্রেড’ করতে পারে, দূতাবাস স্টাফ কমিয়ে আনতে পারে। তবে সব দিক ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। চিরবৈরী  পাকিস্তান ও ভারত কখনো সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ‘উষ্ণ’ না থাকলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রয়েছে। গত সপ্তাহেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসলামাবাদ সফর করেছেন। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ‘মূল্যায়ন’-এর প্রশ্নে ভেবে-চিন্তে এবং আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্যই তা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই করতে হবে। Daily Amader Somoy 13.12.15

কেমন হবে পৌরসভা নির্বাচন

৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা। ৩০ ডিসেম্বর ভোট। এই নির্বাচন নিয়ে মাঠে-ঘাটে, বিভিন্ন টকশোতে নানা কথা। নানা মন্তব্য। নির্বাচন ভালো হবে, কী মন্দ হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান বেশ সরগরম। এটা পৌর নির্বাচন। সাধারণ অর্থে এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা করা চলে না। কিন্তু যেহেতু দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনটি হচ্ছে, তাই অনেকটা জাতীয় নির্বাচনের আমেজ এসে গেছে। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন- ‘এটা একটা টেস্ট কেস’, এই পৌর নির্বাচন প্রমাণ করবে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হবে কি-না। মাঠে আছে বিএনপি। সরব। নির্বাচন নিয়ে তাদের শংকা অনেক বেশি। খোদ খালেদা জিয়াও পৌর নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তবে অনেকটা ‘বেকায়দায়’ আছেন সরকারি দলের সংসদ সদস্য তথা মন্ত্রীরা। তারা তাদের প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন না আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে। তবে সেখানেও আছে প্রশ্ন। যুগান্তর আমাদের জানান দিচ্ছে-‘প্রশাসনের হাতে পৌর নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ’। নির্বাচন কমিশনাররা টিভির পর্দায় খুব জোরেশোরেই বলছেন, ‘পৌরসভা নির্বাচন ভোট গ্রহণ পুরোপুরি সুষ্ঠু করতে কঠোর অবস্থানে থাকবে কমিশন।’ এক ধরনের আÍতুষ্টিতেই ভুগছেন নির্বাচন কমিশনাররা- নির্বাচন সুষ্ঠু হবে! কিন্তু অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সুখকর নয়। তাই ‘ঈষাণ কোণে কালো মেঘ’ দেখতে পাচ্ছি। সংবাদপত্রগুলো মাঝে মধ্যে এমন সব খবর দিচ্ছে, যা আমাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা পৌর নির্বাচন হলেও এর ওপর ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, যদি স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য, ভোট কেন্দ্র দখল, সিল মারার প্রবণতা রোধ করা না যায়, তাহলে প্রমাণিত হবে, সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক নয়। বেশকিছু কারণ সৃষ্টি হয়েছে যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। প্রথম কারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের নিয়ে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন মাঠ প্রশাসনে কর্মরত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। এমনকি মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল মীমাংসার জন্য গঠিত আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬২ জন জেলা কর্তৃপক্ষকে। অথচ এসব কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত নিজস্ব জনবল রয়েছে। তাদের দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেত। সরকারি কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় এই নির্বাচন কতটুকু ‘সরকারের প্রভাবমুক্ত’ থাকবে- এটা একটা মূল প্রশ্ন এখন। আইন নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিলেও কমিশনারদের ভূমিকা দেখে আমার মনে হয়েছে, তারা যেন এখনও অনেকটা সরকারি কর্মচারীদের মতো ভূমিকা পালন করছেন! তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বলে অনেকেরই ধারণা। কারণ প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় সরকারদলীয় প্রার্থী, সমর্থকরা যখন নির্বাচন বিধি লংঘন করছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশন নির্বিকার। বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, কিংবা তারও আগে উপজেলা নির্বাচনের সময় ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপির সংবাদ গণমাধ্যমে এলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, এমনটি দেখা যায়নি। একটা কথা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উঠেছে যে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ, অর্থাৎ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হোক, যাতে সব পক্ষের মানুষ নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে, বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে। পুলিশি হয়রানি বাড়ছে। তারা সঠিকভাবে মাঠে থাকতে পারছেন না। অনেক সময় দেখা গেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় তাদের বাধা দেয়া হয়েছিল। কোথাও কোথাও বিএনপির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় অথবা তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় সরকারদলীয় প্রার্থীকেই বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সরকারি জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থীও মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যতটা না নির্দেশনা ছিল, স্থানীয় সরকারদলীয় প্রার্থী ও সমর্থকদের ভূমিকা ছিল তার চেয়ে বেশি। ফলে এ শংকা থাকলই যে, নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকছে না। নারী কাউন্সিলরদের প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও যা ঘটেছে, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের জন্য প্রতীক রাখা হয়েছে চুড়ি, চকলেট, পুতুল, ফ্রক, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি। এটা কী ধরনের মানসিকতা? এ ধরনের প্রতীক মহিলাদের জন্য রেখে নির্বাচন কমিশন শুধু তাদের মূর্খতা ও অযোগ্যতাই প্রমাণ করল না, বরং এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রমাণ রাখল। তারা যে কত অবিবেচক, এটা তারা আবারও প্রমাণ করল। সুতরাং অনেক ‘প্রশ্ন’ ও ‘সম্ভাবনা’কে সামনে রেখে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আজ নির্বাচন কমিশনারের জন্য সুযোগ এসেছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। নির্বাচনে অনিয়ম রোধ, স্থানীয় মাস্তানদের নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠে সমঅবস্থানের সুযোগ করে দেয়া, আচরণবিধি লংঘনের ব্যাপারে কঠোর হওয়া- নির্বাচন কমিশন এই কাজগুলো যদি নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে এ দেশে ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’র মৃত্যু ঘটবে! দায়টা তখন সরকারের চেয়েও নির্বাচন কমিশনের ওপর বেশি বর্তাবে। আমরা এক ‘অদৃশ্য অরাজনৈতিক সংস্কৃতি’তে আটকে আছি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে বহুমত বিকশিত হয়, ব্যক্তি তার অধিকার নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করতে পারে, প্রশাসন সেখানে থাকে নিরপেক্ষ- এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এখানে বিলুপ্ত হচ্ছে! বহুমতকে এভাবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব বাড়ছে। যেনতেন প্রকারেই হোক, ক্ষমতা ধরে রাখাই হচ্ছে মুখ্য। আমরা যদি এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। এ নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করতে পারি। কিন্তু তাতে করে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। মূলধারার রাজনীতিতে যদি বড় দলগুলো বাইরে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সংকটের মাত্রা বাড়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন এবং পরে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন (মেয়র ও কাউন্সিলর) একটা ‘সম্ভাবনা’ তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই ‘সম্ভাবনা’কেও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি অতি উৎসাহীদের অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য। বুথ কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে প্রকাশ্যে সিল মারা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া- এসব ঘটনার যে দৃশ্য জাতি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে দেখেছে, তা কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ভালো খবর নয়। এখন শুধু বিএনপিই বলছে না, বরং সরকারের ‘মিত্র’ এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও অনেকটা হতাশার সুরে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র চর্চার কোনো সুযোগ নেই। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে দৃশ্য আমরা দেখেছি, সেই দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না। পৌর নির্বাচনে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হোক, এটা আমরা কেউই চাই না। পৌরসভা নির্বাচন সরকারের জন্যও একটা প্লাস পয়েন্ট। এ নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিয়েছে- এতে ‘সব দলের অংশগ্রহণের’ যে সংস্কৃতি, তা নিশ্চিত করে সরকার তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে, সরকারি প্রভাব থাকলে সরকারের ভূমিকা দুর্বল হবে। বহির্বিশ্বে সরকারের ভূমিকা নিয়ে আরও ‘প্রশ্ন’ উঠবে। বিদেশী বন্ধুদের কাছে সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা আরও হারাবে। আমার ধারণা, প্রভাবমুক্ত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ভালো করবে। কেননা গত সাত বছরে সরকারের বেশ কিছু উন্নয়নের দাবিদার এখন সরকারি দলের প্রার্থীরা। এটাকে পুঁজি করে সরকারি দল সাধারণ ভোটারদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় এবং তাতে যদি আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী হন, তাহলে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে। সরকার তার জনপ্রিয়তা যাচাই করে (যা পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে) আবারও ৫ বছরের জন্য ম্যান্ডেট নিতে পারে। সে কারণে ২০১৭-এর প্রথম দিকে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনাকে আমি উড়িয়ে দিতে পারি না। সরকার তখন আগামী এক বছর ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়ে, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রেখে, দুর্নীতি রোধ করে সরকারি দলের জন্য একটা ‘ক্ষেত্র’ সৃষ্টি করতে পারে। এটাকে পুঁজি করেই সরকারি দল নির্বাচনে যেতে পারে। এ কারণেই আমার বিবেচনায় পৌর নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে একটি ‘টেস্ট কেস’, যাতে সরকারি মনোভাব বোঝা যাবে। কিন্তু যদি নির্বাচনটি ভালো না হয়, যদি শেষ মুহূর্তে বিএনপি আবারও নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয়(!), তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন যে ‘মাত্রা’ যোগ হল, তা আমাদের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে না। আমাদের জন্য সেটা হবে দুঃখের কথা। নির্বাচনে বিএনপিকে রাখাই হবে সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনে হেরে গেলেও(!) সরকার পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রায় সাত বছর পর ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষে’র মধ্যে ‘ভোটযুদ্ধ’ শুরু হতে যাচ্ছে। এই প্রথমবার ভোটাররা দলীয়ভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। ব্যক্তি এখানে মুখ্য হবে না। ফলে ভোটের এ রায় প্রমাণ করবে আওয়ামী লীগ তার জনপ্রিয়তা কতটুকু বাড়াতে পেরেছে কিংবা বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন কতটুকু আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দুটি বড় দলই হচ্ছে বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে বোধ করি আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। Daily Jugantor 11.12.15

প্যারিস সম্মেলনে বিশ্ব কী পাবে

জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস সম্মেলনে, যা কপ-২১ নামে পরিচিত বিশ্ব কি কিছু পাবে? একটি চুক্তি কি স্বাক্ষর হবে শেষ পর্যন্ত? এর আগের সম্মেলনে (লিমা ২০১৪) বলা হয়েছিল, এটাই সর্বশেষ সুযোগ। বিশ্বনেতৃবৃন্দ যদি বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে না পারেন তাহলে একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হবে বিশ্ব। কপের লিমা সম্মেলনের পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তা হচ্ছে, প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন করে শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করা সম্ভব হবে? বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাই কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবেই। ইতোমধ্যেই জাপান, কানাডা ও রাশিয়া কিয়োটা-পরবর্তী আলোচনা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিল। সুতরাং বোঝাই যায় এক ধরনের হতাশা এসে গেছে। আসলে বিশ্বের দেশগুলো এখন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে এক এক গ্রুপের এক এক এজেন্ডা। উন্নত বিশ্ব কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্বের যে দাবি তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বও একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ধনী দেশগুলো এনেস্ক্র-১-এ অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জিডিপির শতকরা ৭৫ ভাগ এ দেশগুলোর। অথচ লোকসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে সবচেয়ে বেশি, শতকরা ৫১ ভাগ। অন্যদিকে গ্রুপ-৭৭-এর দেশগুলো (মোট ১৩০টি দেশ) বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ, জিডিপির মাত্র ১৯ ভাগ। কিন্তু কার্বন উদ্গিরণ করে ৪২ ভাগ। আবার সাগরপাড়ের দেশগুলো, যারা বিশ্বের জনসংখ্যা, জিডিপি ও কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ১ ভাগ, তাদের দাবি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থার চেয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ কমিয়ে আনার। বনাঞ্চলভুক্ত দেশগুলো যারা রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন হিসেবে পরিচিত তারা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১৯ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপির মাত্র ৩ ভাগ তাদের। আর মাত্র ৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র একা কার্বন নিঃসরণ করে ২০ ভাগ, জিডিপির ৩০ ভাগ তাদের। অথচ জনসংখ্যা মাত্র বিশ্বের ৫ ভাগ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিশ্ব জিডিপির ২৫ ভাগ ও জনসংখ্যার ৮ ভাগের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ করে ১৫ ভাগ। চীনকে নিয়ে সমস্যা এখন অনেক। চীন একা কার্বন নিঃসরণ করে ২১ ভাগ। বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগই চীনা নাগরিক। জিডিপির ৬ ভাগ তাদের। প্রতিটি গ্রুপের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে চায়। জাতিসংঘ একে বলছে কার্বনঘনত্ব। অর্থাৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাইঅক্সাইড উদ্গিরণের হারকে কার্বনঘনত্ব বা গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বলা হয়। উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে এ হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের হার কমানো উচিত, এটা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু কে কতটুকু কমাবে, সে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন (এবং সেই সঙ্গে ভারতও) বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছড়ায়, সে কারণে এ দুটো দেশের কাছ থেকে 'কমিটমেন্ট' আশা করেছিল বিশ্ব। কিন্তু তা হয়নি। চীন প্রস্তাব করেছিল ২০০৫ সালের কার্বনঘনত্বের চেয়ে দেশটি ২০২০ সালে শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ কমাবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল তারা ১৭ ভাগ কমাবে। কিন্তু চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখানে বলা ভালো, চীনের কার্বনঘনত্ব ২.৮৫ টন, আর ভারতের ১.৮ টন। চীন ও ভারত দুটো দেশই বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে এ শতাব্দীতেই। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে ২২ হাজার ডলারে উন্নীত হবে।
২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, ৩০ বছর পর অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। তবে এটা ধরে রাখতে হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮ থেকে ৯ ভাগ। এ কারণেই ভারতকে নিয়ে ভয়_ তাদের কার্বনঘনত্ব বাড়বে। কেননা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। আর তাতে করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়বে। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৭ সালে কিয়োটো সম্মেলনে ১৬০টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯০ সালের কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের মাত্রার চেয়ে ৮ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৭ শতাংশ ও জাপানের ৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা। তা ছাড়া সার্বিকভাবে ৫.২ শতাংশ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সব কটি দেশকে ২০০৮-১২ সালের মধ্যে গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট গোর কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও পরে বুশ প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে কিয়োটো চুক্তি কাগজ-কলমে থেকে গিয়েছিল। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে কটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন আগামীতে উদ্বাস্তু হবে। ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন সম্মেলনে পরিবেশগত উদ্বাস্তুদের টহরাবৎংধষ ঘধঃঁৎধষ চবৎংড়হ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি।
সর্বশেষ দোহা সম্মেলনেও বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া গেছে মাত্র ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেখান থেকে পেয়েছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর হয়নি। সার্ক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঐক্যবদ্ধভাবে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলো আমরা তুলে ধরব। কিন্তু লিমায় তা হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারত একই ফোরামে ছিল না। একটি আইনি বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্পর্কেও কোনো সমঝোতা হয়নি। কপ সম্মেলন এলেই বড় বড় কথা বলা হয়। কয়েক টন কার্বন নিঃসরণ করে সম্মেলন 'অনেক আশার কথা' শুনিয়ে শেষ হয় বটে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয় খুব কমই। আগে সমস্যা ছিল উন্নত বিশ্বকে নিয়ে। এখন চীন ও ভারত একটি সমস্যা। তাদের যুক্তি, নিঃসরণের পরিমাপ হ্রাস করলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তাতে বাড়বে দারিদ্র্য। এ যুক্তি ফেলে দেয়ার নয়। ফলে কপ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন থেকে গেলই। গেল বছরের ডিসেম্বরে (১-১২ ডিসেম্বর) পেরুর রাজধানী লিমায় কপ-২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কপ-১৮ (ডারবান) সম্মেলনের পর দোহায় কপ-১৯, সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কপ-২১ সম্মেলন। কিন্তু তাতে আমাদের প্রাপ্তি কী? শুধু 'অংশগ্রহণ' ছাড়া আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই।
আল গোর নিজে তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ দুই থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। এর অর্থ প্রচুর মানুষ হারাবে তাদের বসতি, পেশা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে নোনা পানির আগ্রাসন। সেই সঙ্গে ধানের আবাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। দুই কোটি কৃষক, জেলে পেশা হারিয়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এসে নতুন নতুন বস্তি গড়ে তুলবে। রিকশা চালানোর জীবন বেছে নেবে। সৃষ্টি হবে একটি শ্রেণির, যারা শহুরে মানুষের ভাষায় 'জলবায়ু উদ্বাস্তু'। এ জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি হবে। বিদেশে অর্থসাহায্য চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে প্রাপ্ত সাহায্যের ব্যবহার নিয়ে নানা অনিয়মের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই সরকার এসব অনিয়ম বোধ করতে পেরেছে।
বলা ভালো, বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এ সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখনো এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু 'সিডর' ও 'আইলা'র আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল সে ক্ষতি পোষাতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ যুদ্ধ করে যেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ুসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
আমাদের জন্য তাই প্যারিস কপ-২১ সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশ পরিবেশগত নানা সমস্যায় আক্রান্ত। বাংলাদেশের একার পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই বাংলাদেশ আজ আক্রান্ত। সুতরাং বৈশ্বিকভাবে যদি বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি কমানো না যায় তাহলে বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করাও সম্ভব হবে না। তাই একটি চুক্তি অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে আরো প্রয়োজন জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় বৈদেশিক সাহায্যের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি এবং সেই সঙ্গে প্রযুক্তি হস্তান্তরের একটা 'কমিটমেন্ট'। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে আমাদের যেতে হবে। সোলার বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, স্থানীয়ভাবে তাদের কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। সুতরাং আর্থিক সাহায্যের প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য, বিশ্বনেতৃবৃন্দ বার বার সাহায্যের কথা বললেও সে সাহায্য কখনই পাওয়া যায়নি। প্যারিস সম্মেলন চলাকালে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ প্রকাশ করেছে জার্মান ওয়াচ নামে একটি সংস্থা। প্রতি বছর বৈশ্বিক জলবায়ুসূচক তারা প্রকাশ করে। শীর্ষ সম্মেলন চলাকালেই তারা প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক জলবায়ুসূচক ২০১৬।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝড়, বন্যা, ভূমিধস ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকা এরা প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ৬ নাম্বারে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে হন্ডুরাস। তারপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপাইন ও নিকারাগুয়া। তাই প্যারিস সম্মেলনটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ সম্মেলন নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তি হলেও তাতে যদি আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকে তাহলে ওই চুক্তি মূল্যহীন হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে বিশ্বনেতৃবৃন্দের সবাই, যারা কপ-২১-এ যোগ দিয়েছিলেন, তারা প্যারিস ছেড়েছেন। তারা দেশীয় কর্মকর্তাদের রেখে গেছেন, যারা বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে দেনদরবার করবেন। তবে একটা চুক্তি হোক_ এ প্রত্যাশা সবার। Daily Jai Jai Din 07.12.15

কপ ২১ : আদৌ কি সমঝোতা হবে


বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিসে জাতিসংঘ কর্তৃক কপ-২১ সম্মেলন শুরু হলেও শেষ অবধি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। গত ৩০ নভেম্বর এই শীর্ষ সম্মেলনটি শুরু হয়েছে এবং চলবে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রয়োজনে আরও দু-একদিন সম্মেলনটি বাড়ানো হতে পারে। ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন। এতে করে একদিকে এই সম্মেলনের গুরুত্ব যেমনি বেড়েছে, ঠিক তেমনি তাদের সবার বক্তব্যেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতির দিকটি ফুটে উঠেছে। বিশ্ব নেতারা প্রায় সবাই একবাক্যে বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে করে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, একটি চুক্তি এবং কার্বন হ্রাসের বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে কপ-২১ শেষ হবে। আমাদের ধারণা কতটুকু বাস্তবে রূপ পাবে, তা দেখার জন্য আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা সত্য, বিশ্ব নেতাদের মধ্যে একটা উপলব্ধিবোধ এসেছে, কার্বন নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। তবে কাজটি নিঃসন্দেহে সহজ নয়। এর সঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন জড়িতÑ উন্নত বিশ্ব কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় ‘টেকনোলজি ট্রান্সফার’, উন্নত বিশ্বের নিজের কার্বন নিঃসরণ হার কমানোÑ ইত্যাদি বিষয় জড়িত। এর আগে গেল ডিসেম্বরে লিমা কপ-২০ সম্মেলনে প্রতিটি দেশকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ এটা করেছে। কিন্তু সব দেশ এটা করতে পেরেছে কিনা, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। চিন ও ভারতের মতো দেশের কার্বন নিঃসরণ নিয়েও কথা আছে। কেননা দেশ দুটি সাম্প্রতিককালে বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশে পরিণত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনে যে ক’টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে আগামীতে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পরপর দু’বার বন্যা ও পরবর্তীকালে ‘সিডর’-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে ‘আইলা’। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিডরের পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে! সিডরের ক্ষতি ছিল গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নয়টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিলেন ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। সিডর ও আইলার পর ‘মহাসেন’ বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। যদিও এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাইনি। সিডর ও আইলার আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ নোনাজলের আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর মহাসেন আমাদের আবারও ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছিল।
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা আরও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।
বলা ভালো বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও, তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো, আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সিডর ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতি সাড়াতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ ‘যুদ্ধ’ করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এমন প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ু সংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি ‘রাজনীতি’ ঢুকে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে, তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সারা বিশ্বে একটা উদ্বিগ্নতা থাকলেও কতটুকু সচেতন আমরা তা নিশ্চিত নই। আমরা বারবার বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পরিবেশ দূষণ হয় এমন কর্মকা-ের ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি কম। বিদেশ থেকে যে সাহায্য পাওয়া গেছে, তাতে দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। এমনকি সুন্দরবনের কাছাকাছি একটি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে আমরা বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে রয়েছি। পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করলেও সরকার এ ব্যাপারে এখনো অনড়। মজার ব্যাপার বড় দল বিএনপি এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য না দিলেও বাম সংগঠনগুলো সোচ্চার। তারা সুন্দরবন পর্যন্ত লংমার্চের আয়োজন করেছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকারÑ সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কী আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না, নেইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ই-আইএ সমীক্ষাÑ তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারি মৌজায় ১ হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুম-লে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কি অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। ইতোমধ্যে সুন্দরবনকে গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির সৃষ্টি করে। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লংঘন করেছি। ফলে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আমরা যতই সোচ্চার হই না কেন, আমরা আমাদের নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় কতটুকু সচেতন এ প্রশ্ন উঠবেই। প্যারিস সম্মেলনে যদি আদৌ সুন্দরবনের প্রশ্নটি ওঠে, আমি তাতে অবাক হব না।
প্যারিস সম্মেলনের আগে বৈদেশিক সাহায্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য না পেলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না- এমন কথাও উঠেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জলবায়ু মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেরা যদি নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় সচেতন না হয়, তাহলে বাইরের কোনো ‘শক্তি’ তাকে সাহায্য করতে পারবে না।
প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলনে একটি চুক্তি হলেও তা এখনই কার্যকরী হবে না। কার্যকর হবে ২০২০ সাল থেকে। বিশ্ব যদি প্যারিসে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে না পারে, তাহলে আমাদের জন্য আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হাড় কাঁপানো শীত, মারাত্মক ঝড়, অবাধ্য তাপপ্রবাহ, তীব্র পানি সংকট এবং সেই সঙ্গে ভয়াবহ শরণার্থী সংকট আমরা প্রত্যক্ষ করব আগামী দিনগুলোতে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ‘গ্রিনবিশ্ব’ উপহার দেওয়ার জন্য প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে একটি চুক্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
Daily Amader Somoy
06.12.15

প্যারিস সম্মেলন প্রত্যাশা পূরণ করবে কি?

৩০ নভেম্বর থেকে প্যারিসে কপ-২১ শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাসহ ১৯৬টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা জলবায়ুবিষয়ক এ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। সম্মেলন চলবে প্রায় দু’সপ্তাহ এবং ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাস করার ব্যাপারে বিশ্বনেতারা শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। বাংলাদেশের জন্য এই কপ-২১ সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে যে ক’টি দেশের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত শরিক দেশগুলোর জোট ‘ভালনারেবেল টোয়েন্টি’তে (ভি-২০) যোগ দিয়েছে। ভি-২০-তে বাংলাদেশ ছাড়াও কিরিবাতি, টুভালুর মতো সাগরপাড়ের দেশগুলোর পাশাপাশি নেপাল, ভুটানের মতো দেশও রয়েছে, যাদের সীমান্তে কোনো সাগর নেই। এসব দেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে প্রযুক্তি ও অর্থের দরকার এ দেশগুলোর তা নেই। এমনকি পশ্চিমা বিশ্ব সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা তারা দেয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নত সব দেশই আজ ঝুঁকির মুখে। তবে মালদ্বীপ কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশের ঝুঁকির পরিমাণ বেশি। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বের দেশগুলো নানা গ্রুপে বিভক্ত এবং তাদের স্ট্রাটেজিও ভিন্ন ভিন্ন। গ্রুপ-৭৭-এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১৩০টি দেশ। বিশ্বের জনসংখ্যার ৭৬ ভাগ এসব দেশে বসবাস করে এবং বিশ্ব জিডিপির ১৯ ভাগ তারা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এ দেশগুলো বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ করে মোট নিঃসরণকৃত কার্বনের ৪২ ভাগ। চীন অন্যতম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ (২১ ভাগ), অথচ বিশ্ব জিডিপির ৬ ভাগ তাদের এবং বিশ্ব জনসংখ্যার ২০ ভাগ চীনের। ধনী দেশগুলো এনেস্ক ১-এর অন্তর্ভুক্ত, যাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৫১ ভাগ; অথচ বিশ্ব জনসংখ্যার ১৯ ভাগ এবং জিডিপির ৭৫ ভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণে। যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে ২০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে, ৩০ ভাগ জিডিপি আর বিশ্ব জন্যসংখ্যার মাত্র ৫ ভাগ তাদের। এর বাইরে আফ্রিকান ইউনিয়নভুক্ত ৩৯ দেশ, তেল ও গ্যাস সম্পদসমৃদ্ধ ওপেকভুক্ত দেশ এবং জনসম্পদসমৃদ্ধ ‘রেইনবো কোয়ালিশন’ভুক্ত দেশগুলোর অবস্থান আলাদা আলাদা।মোটামুটিভাবে সবাই এটা স্বীকার করে যে, তারা বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের হার কমাবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে। ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ করেছিল, (চীন করেছিল ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন), সেখানে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিঃসরণের পরিমাণ ছিল ৬ বিলিয়ন টন (চীনের ৬ বিলিয়ন টনের উপরে)। এখন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমাবে ১৭ থেকে ২০ ভাগ। চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ কমানোর। আর ভারতের প্রতিশ্রুতি ২০ ভাগ কমানোর। দেশগুলো এই প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখতে পারবে এটাই বড় প্রশ্ন এখন।বাংলাদেশের ঝুঁকির প্রসঙ্গটি বিশ্ব মিডিয়ায় অনেকবারই এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরে বিষয়টি নিয়ে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। অনেকে স্মরণ করতে পারেন, চলতি বছরের প্রথম দিকে অনেকটা অগোচরেই খুলনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তিন দিনব্যাপী জলবায়ু উদ্বাস্তু সংক্রান্ত একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি সম্মেলনের যথেষ্ট গুরুত্ব থাকলেও মিডিয়ায় সেই সম্মেলন সংক্রান্ত খবরাদি আমার চোখে পড়েনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংগঠক ‘ন্যানসেন ইনিশিয়েটিভে’র সহযোগিতায় ওই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ১৪টি দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। খুলনায় এ ধরনের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য নিঃসন্দেহে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে। আর বাংলাদেশের যেসব এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে রয়েছে বৃহত্তর খুলনা। ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ও ‘আইলা’য় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো এ অঞ্চলেই অবস্থিত। এ অঞ্চলের মানুষ আজও সিডর ও আইলার বিপর্যয় থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।এখানে গত বছর ডিসেম্বরে পেরুর রাজধানী লিমায় অনুষ্ঠিত কপ-২০ (কমিটি অব দ্য পার্টিস) সম্মেলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে লিমা ঘোষণা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তবে প্রশ্ন আছেই। উন্নত বিশ্ব শেষ পর্যন্ত লিমা ঘোষণাকে বিবেচনায় নিয়ে প্যারিসে চুক্তি স্বাক্ষর করে কি-না, তা জানার জন্য আমাদের আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের দ্বন্দ্বের আলোকে মার্কিন কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তির ব্যাপারে আপত্তি তোলে কি-না, সেটাই দেখার বিষয়। তবে প্যারিসে এ নিয়ে বেশ দেন-দরবার হবে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলো আন্তর্জাতিক আসরে দেন-দরবার করবে। জাতিসংঘ উদ্যোগী হবে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের করার কিছু নেই। কেননা উন্নত বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি রাজি না হয়, তাহলে প্যারিস সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে না।আমাদের জন্য খুলনা সম্মেলনের গুরুত্ব যথেষ্ট। সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশ প্যারিসে অনুষ্ঠানরত ‘কপ’ সম্মেলনে উপস্থাপন করছে। খুলনা ঘোষণায় বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের বাস্তুচ্যুতি একটি নির্মম সত্য। এ সমস্যা মোকাবেলায় স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে। বাস্তুচ্যুতি ঠেকাতে এবং নিদেনপক্ষে বাস্তুচ্যুতদের সহযোগিতায় দেশীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ধনী ও উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতিমালা তৈরি করাও একান্ত জরুরি। এছাড়া বাস্তুচ্যুত অভিবাসীদের সুরক্ষার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে, তাদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশ এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বলেও আমার জানা নেই। অথচ দ্বীপাঞ্চল থেকে মানুষ প্রতিদিনই উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে এবং বড় বড় শহরে আশ্রয় নিয়ে বস্তি জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ তাদের পারিবারিক পেশা ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ এদের পুনর্বাসনের কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেলেও এ দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যারা চালান তারা এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অতি সম্প্রতি একটি শংকার কথা আমাদের জানিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। বাংলাদেশ এই জলবায়ু পরিবর্তনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এডিবির এক রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এডিবি জানিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ করে কম হতে পারে। চলতি শতাব্দী শেষে এ ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৯ শতাংশ। আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এডিবির এ রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার অপর দুটি দেশ নেপাল ও মালদ্বীপের ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে, তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শুধু এডিবির রিপোর্টেই নয়, জাতিসংঘের রিপোর্টেও এই ক্ষতির দিকটি উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ বা কমিটি অব দ্য পার্টিস নামে পরিচিত, সেখানেও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার কথা উঠে আসে। দেশের পরিবেশমন্ত্রী ঘটা করে কপ সম্মেলনে যান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ইতিমধ্যে নাসা আরও একটি আশংকার কথা জানিয়েছে। নাসা আশংকা করছে, গ্রিনল্যান্ডে যে বরফ জমা রয়েছে তা যদি উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড হ্রাসের কথা বলছে নাসা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরগুলোয় ইতিমধ্যে ৪ কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আল গোর বিশ্বের ১০৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে (বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদও ছিলেন ওই দলে) গিয়েছিলেন অ্যান্টার্কটিকায়। শুধু জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় এখনও নীরব।প্রতিবছরই কপ সম্মেলনে ভালো ভালো কথা বলা হয়। কোপেনহেগেন থেকে লিমা (২০১৪) সম্মেলন পর্যন্ত প্রতিটি সম্মেলনেই বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ থাকবে। এ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হলেও বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হবে তা স্পষ্ট নয়। গত বছর ডিসেম্বরে লিমা সম্মেলনে বলা হয়েছিল, পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিটি দেশ নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপন করবে। প্রতিটি দেশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন করার। অর্থাৎ তারা নিজেরাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যবস্থা বের করবে। প্রশ্নটা এখানেই। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে একটি কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন রয়েছে; কিন্তু এ নিয়ে স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। আমাদের আমলারা বিদেশ ভ্রমণে যেতে পছন্দ করেন। সম্মেলনে যোগ দিয়ে যে হাতখরচ পাওয়া যায়, তা নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন তারা। দেশে ফিরে এসে একরকম ‘ভুলে’ যান সবকিছু!খুলনা সম্মেলনে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেছিলেন, শুধু ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৪ কোটি ৬ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে (কালের কণ্ঠ, ৬ এপ্রিল)। তার এ বক্তব্যের জন্য তাকে আমি সাধুবাদ দিতে পারি না। কেননা জলবায়ু কূটনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে সফল, তা তারা দাবি করতে পারে না। পত্রপত্রিকা থেকে দেখেছি বাংলাদেশ লিমা সম্মেলনের আলোকে অতি সম্প্রতি একটি ‘কর্মপরিকল্পনা’র জন্ম দিয়েছে। এতে ১৫ ভাগ কার্বন নিঃসরণের প্রতিশ্র“তি রয়েছে। কিন্তু যদি বিনিয়োগ না আসে, যদি প্রযুুক্তি সহায়তা না পাওয়া যায়, তাহলে এই প্রতিশ্র“তি কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। তাই ভি ২০ জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ তার স্বার্থ কতটুকু আদায় করতে পারবে এ প্রশ্ন থাকলই।প্যারিসে সন্ত্রাসী ঘটনাবলীর পরও এ সম্মেলন শুরু হয়েছে। শুধু বিপুলসংখ্যক সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিই নয়, বরং প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উপস্থিতি (যারা বিভিন্ন দেশ থেকে গেছেন, যাদের মধ্যে অনেক এনজিও প্রতিনিধিও আছেন) প্যারিসকে পুনরায় বিশ্বের আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত করলেও একটি ‘ভালো খবর’ প্যারিস কপ-২১ সম্মেলন জন্ম দিতে পারবে কি-না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা হচ্ছে ‘কর্পোরেট হাউস’ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। বড় বড় কর্পোরেট হাউসের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। তাই তারা তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কার্বন হ্রাস কতটুকু কমাবে, চীন তার কার্বন নিঃসরণ কতটুকু কমাবে বা আদৌ কমাবে কি-না, ভারতের ভূমিকাই বা কী হবে- এসব প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে। তারপরও একটি চুক্তি হোক- এ প্রত্যাশা সবার।
Daily Jugantor
06.12.15