বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা পৌর নির্বাচন হলেও এর ওপর ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, যদি স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীদের দৌরাত্ম্য, ভোটকেন্দ্র দখল, সিল মারার প্রবণতা রোধ করা না যায়, তাহলে প্রমাণিত হবে সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক নয়। ইতোমধ্যেই অনেকগুলো কারণ সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। প্রথম কারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের নিয়ে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন মাঠ প্রশাসনে কর্মরত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। এমনকি মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল মীমাংসার জন্য গঠিত আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬২ জন জেলা কর্তৃপক্ষকে। অথচ এসব কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত নিজস্ব জনবল রয়েছে। তাদের দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেত। এখন সরকারি কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় এই নির্বাচন কতটুকু ‘সরকারের প্রভাবমুক্ত’ থাকবেÑ এটা একটা মূল প্রশ্ন এখন। আইন নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিলেও কমিশনারদের ভূমিকা দেখে আমার মনে হয়েছে, তারা যেন এখনো অনেকটা ‘সরকারি কর্মচারীদের’ মতো ভূমিকা পালন করছেন! তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বলে অনেকেরই ধারণা। কেননা প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় সরকারদলীয় প্রার্থী, সমর্থকরা যখন নির্বাচনবিধি লঙ্ঘন করছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তখন শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচন কিংবা আরও আগে উপজেলা নির্বাচনের সময় ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপির সংবাদ গণমাধ্যমে এলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, তা দেখা যায়নি। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনকি দায়মুক্তিও দিয়েছে ইসি।
একটা কথা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উঠেছে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ অর্থাৎ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হোক যাতে সব পক্ষের মানুষ নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে। পুলিশ হয়রানি বাড়ছে। তারা সঠিকভাবে মাঠে থাকতে পারছেন না। অনেক সময় দেখা গেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় তাদের বাধা দেওয়া হয়েছিল। কোথাও কোথাও বিএনপি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় অথবা তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় সরকারদলীয় প্রার্থীকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সরকারি জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থীও মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যতটা না নির্দেশ ছিল, স্থানীয় সরকারদলীয় প্রার্থী ও সমর্থকদের ভূমিকা ছিল বেশি। ফলে শঙ্কা তো থাকলই যে নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকছে না। নারী কাউন্সিলরদের প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও যা ঘটেছে, তা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের জন্য প্রতীক রাখা হয়েছিল চুড়ি, চকোলেট, পুতুল, ফ্রক, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি। এটা কী ধরনের মানসিকতা? এ ধরনের প্রতীক মহিলাদের জন্য রেখে পুরো নির্বাচন কমিশন তাদের মূর্খতা ও অযোগ্যতাই প্রমাণ করল না, বরং এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রমাণ রাখল। তারা যে কত অবিবেচক, এটা তারা আবারও প্রমাণ করলেন। তাই অনেকগুলো ‘প্রশ্ন’ ও ‘সম্ভাবনা’কে সামনে রেখে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
আজ নির্বাচন কমিশনের জন্য সুযোগ এসেছিল তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। নির্বাচনে অনিয়ম রোধ, স্থানীয় মাস্তানদের নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠে সমঅবস্থানের সুযোগ করে দেওয়া, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে কঠোর হওয়াÑ নির্বাচন কমিশন এই কাজগুলো যদি নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে এ দেশে ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’ নতুন একটি রূপ পেত। এটা না পারার ব্যর্থতার দায়টা এখন সরকারের চেয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর বেশি বর্তাবে। আমরা এক ‘অদৃশ্য অরাজনৈতিক সংস্কৃতি’তে আটকে আছি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে বহুমত বিকশিত হয়, ব্যক্তি তার অধিকার নির্বিঘেœ প্রয়োগ করতে পারে, প্রশাসন যেখানে থাকে নিরপেক্ষ, এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এখানে বিলুপ্ত হচ্ছে! বহুমতকে এখানে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব বাড়ছে। যেনতেন প্রকারেই হোক ক্ষমতা ধরে রাখাই হচ্ছে মুখ্য। আমরা যদি এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। এ নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করতে পারি। কিন্তু তাতে করে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। মূল ধারার রাজনীতিতে যদি বড় দলগুলো বাইরে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সংকটের মাত্রা বাড়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন ও পরে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন (মেয়র ও কাউন্সিলর) একটা ‘সম্ভাবনা’ তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি অতি উৎসাহীদের অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য। বুথ-কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে সিল মারা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এসব ঘটনার যে দৃশ্য জাতি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে দেখেছে, তা কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ভালো খবর নয়। এখন শুধু বিএনপিই বলছে না, বরং সরকারের ‘মিত্র’ এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও অনেকটা হতাশার সুরে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র চর্চার কোনো সুযোগ নেই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে দৃশ্য আমরা দেখেছি, সেই দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না। পৌর নির্বাচনে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হোক, এটা আমরা কেউই চাই না। কিন্তু ইসি আমাদের সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। পৌরসভা নির্বাচন সরকারের জন্যও একটা প্লাস পয়েন্ট। এই নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিয়েছেÑ এতে ‘সকল দলের অংশগ্রহণের’ যে সংস্কৃতি, তা নিশ্চিত করে সরকার তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে, সরকারি প্রভাব থাকলে, সরকারের ভূমিকা দুর্বল হবে। বহির্বিশ্বে সরকারের ভূমিকা নিয়ে আরও ‘প্রশ্ন’ উঠবে। বিদেশি বন্ধুদের কাছে সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা আরও হারাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কী পরিবর্তন আসে সেটাই দেখার বিষয়।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গত ২২ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির অনুষ্ঠানে বলেছেন, পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন কমিশনকে তিনি ‘মেরুদ-হীন’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। জনাব এরশাদের এই বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা তিনি এখনো মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’। সরকার থেকে তিনি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান। ফলে তার বক্তব্য ‘সরকারের একটা অংশের’ বক্তব্য বলে মানুষ ভুল করতে পারে! জনাব এরশাদ নিজে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে পদত্যাগ করেননি। জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা এখনো মন্ত্রিপরিষদে আছেন। তিনি এ ধরনের বক্তব্য না দিলেও পারতেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সাধারণ মানুষ চায় নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। নিরপেক্ষ হোক। এই নির্বাচন সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে পারে। পৌর নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে আমাদের গণতন্ত্রের জন্য তা হবে এক ‘অশনিসংকেত’। এবং ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচনে ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত না হওয়ায় যে ‘রাজনৈতিক সংকটের’ জন্ম হয়েছিল, সেই ‘সংকট’ থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে পারব না। তাই সুস্থ গণতন্ত্রের স্বার্থে পৌর নির্বাচনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, সহিংসমুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
Daily Amader Somoy
27.12.15
0 comments:
Post a Comment