অতি সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোটে যোগ দেয়ায় যে
প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ কি তার সনাতন
নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের ৪৪
বছরের রাজনীতিতে কখনো কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তী
সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ব্রেজনেভ তার ‘যৌথ নিরাপত্তা’
চুক্তিতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানালেও বাংলাদেশ তাতে শরিক হয়নি। পরবর্তীতে
পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এলেও বাংলাদেশ কখনো কোনো জোটে যোগ দেয়নি।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’
এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। এখন বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশ এই নীতি
থেকে সরে এলো কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। উপরন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫তম
অনুচ্ছেদ ‘আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, সংহতি ও উন্নয়নের’ কথা বলা
হয়েছে। অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক
বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথাও বলা হয়েছে এই অনুচ্ছেদে। তাই জোটে যোগ
দিয়ে আগামীতে ‘অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ
করবে কিনা, ‘শক্তি প্রয়োগে’ অংশ নেবে কিনা, এ প্রশ্ন থাকলই। যদিও জোটের
পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা কী হবে তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
জানিয়েছেন, এই জোটের উদ্যোগে রিয়াদে একটি কেন্দ্র হবে এবং এই কেন্দ্র
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে।’ তবে সৌদি
আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ আমাদের জানাচ্ছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে
যুদ্ধে সামরিক অভিযান সমন্বয় ও তাতে সহায়তা করতে সৌদি নেতৃত্বাধীন এ জোট
গঠন করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ আরো যুক্তি দেখিয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির অংশ
হিসেবে অন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ এই কেন্দ্রে যোগ দেয়ার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তত্ত্বগতভাবে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ সন্ত্রাসের
বিরুদ্ধে সোচ্চার। এক্ষেত্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে তথ্য বিনিময় আমাদের
অনেক সাহায্য করবে। বাংলাদেশে আইএসের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক আছে। আইএস আছে
কী নেই, এ নিয়ে সংশয় আছে। ঝওঞঊ ইনটেলিজেন্সের পক্ষ থেকে আইএসের অস্তিত্ব
এবং বেশ কটি হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে আইএসের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা
হলেও বাংলাদেশ সরকার তা অস্বীকার করেছে। এখন যদি আগামীতে এই জোট আইএসের
বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, তাহলে বাংলাদেশ আইএসের টার্গেটে
পরিণত হতে পারে। এতে বাংলাদেশে আইএসের হুমকি আরো বাড়বে। আল কায়েদা এ
অঞ্চলে (অর্থাৎ ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমারে) তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগের খবর আমরা
জানি না। তবে স্থানীয় জঙ্গিরা যে আল কায়েদা ও আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের
চেষ্টা করছে এ খবর গোয়েন্দারা আমাদের জানিয়েছে। তখন একটা ভয়ের কারণ হয়ে
দাঁড়াল যে, বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। সৌদি
আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ কতটুকু
নিশ্চিত করতে পারবে, সে ব্যাপারে এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এক
সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ
গুরুত্ব দেয়া হতো। সংবিধানের এই ধারাটি এখন আর নেই। বাতিল করা হয়েছে। ফলে
সৌদি জোটে যোগদান আমাদের জন্য কোনো প্রয়োজন ছিল না। ভারত কোনো জোটেই যোগ
দেয়নি। ওমানও যোগ দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ দিল। এই জোটে অন্য যেসব দেশ রয়েছে
সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে সবাই দুর্বল। বিশ্বে বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্ব
যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছে। এখন সৌদি আরব বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতাকে নিজের
স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে অথচ সৌদি আরব এখনো বাংলাদেশের শ্রমবাজার
উš§ুক্ত করে দেয়নি। ফলে জোটে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবেÑএ প্রশ্ন
থাকবেই। তবে এই জোটের ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। জোটের
অন্যতম শরিক পাকিস্তান কিছুটা অবাকই হয়েছে এই জোট গঠনে এবং জোটে
পাকিস্তানের নাম থাকায়। পাকিস্তানের বক্তব্য পাকিস্তানের সঙ্গে পরামর্শ না
করেই এই জোটের ঘোষণা দেয়া হয়। আমি নিশ্চিত নই এই জোট গঠনে বাংলাদেশের সঙ্গে
বিস্তারিত আলোচনা আদৌ হয়েছিল কিনা। সৌদি আরব এ ধরনের একটি জোট গঠন করতে
যাচ্ছে কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রারম্ভিক আলোচনা হয়েছে এটাও
আমাদের অনেকের জানা নেই। ফলে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রাউন প্রিন্স
মোহাম্মদ বিন সালমান যখন গত ১৫ ডিসেম্বর এই জোট প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন
তখন বিষয়টি আমাদের অবাকই করেছে। এমন হয়েছে কিনাÑসৌদি আরব একাই সিদ্ধান্ত
নিয়ে তা জোটবদ্ধ দেশগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে শুধু? এটা যদি সত্য হয় তাহলে তা
নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। জোট নিয়ে পাকিস্তানের প্রশ্ন তোলা এই সম্ভাবনাটাকেই
সামনে চলে এলো।
এখানে আরো একটা কথা বলা দরকার। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, যাদের নাগরিকদের প্রায় সবাই মুসলমান। ওই অঞ্চলের একটি দেশও জোটে যোগ দেয়নি। তাজকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, কিরগিজস্তান এই দেশগুলো এক সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে গেলে এই দেশগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ’ যদি অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে থাকে জোটে যোগ দেয়ার ব্যাপারে। তাহলে মুসলমান প্রধান এই দেশগুলো যোগ দিল না কেন? ইন্দোনেশিয়া বড় মুসলিম দেশ। এই দেশটিও নেই কেন? পাঠক, লক্ষ্য করুন কোন দেশগুলো যোগ দিয়েছে? বেনিন, সাঁদ, টোগো, জিবুতি, সুদান, সিয়েরা লিওন, গ্যাবন, সোমালিয়া, কমোবোয়া, মালদ্বীপ এই দেশগুলোর সন্ত্রাস দমনে আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই এবং জাতিসংঘ এই দেশগুলোকে কখনো বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে আমন্ত্রণও জানায়নি। শুধু তাই নয়, সুদান, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, গিনি ইতোমধ্যে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব দেশে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারও নেই। তাহলে এই দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানাল হলো কেন? দেশগুলো গরিব। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। ধনী দেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতার ওপর দেশগুলো নির্ভরশীল। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই কি দেশগুলোকে সৌদি আরব তার জোটে রেখেছে?
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জোটে ৩৪ দেশ যোগ দিয়েছে। এই জোটকে বলা হচ্ছে ‘ইসলামিক মিলিটারির অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেররিজম’ (আইএসএএফটি)। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই এই জোটের জš§! এখানে কোনো একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কথা বলা হয়নি। সম্প্রতি সিরিয়া ইরাকে জš§ নেয়া ইসলামিক স্টেট বা দায়েশ (আরবি নাম) এর বিরুদ্ধে আলাদা আলাদাভাবে বিমান হামলা পরিচালনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ও রাশিয়া। অনেক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি জোট ‘দ্য গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল।’ এখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, আইএসআইএল তথা ইসলামিক স্টেটের কথা। ৬৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের মূল টার্গেট ইসলামিক স্টেট। এখন এর পাশাপাশি গঠিত হলো আইএসএএফটি। একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরটি নেতৃত্বে সৌদি আরব। উভয় জোটের স্বার্থ কি এক? অর্থাৎ উভয় জোটই কি ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হবে? বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জোটে বাংলাদেশকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়নি। এখন সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশ যোগ দিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিল না কেন? নাকি ওই জোটে যোগ দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগে সৌদি জোটে যোগ দিল? মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা আমাকে বলতে চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এক টিভি টক শোতে তিনি আমাকে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন। তবে জানিয়েছিলেন, ‘অসামরিক ও জাতিসংঘের উদ্যোগে যে কোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।’ অর্থাৎ আমি ধরে নিয়েছি যদি কোনো ধরনের ‘মানবিক বিপর্যয়ের’ ঘটনা ঘটে সিরিয়ায়, তাহলে বাংলাদেশ মার্কিন জোটকে সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনে জোটে যোগ দেবে। এখন সৌদি জোটে যার চরিত্র অনেকটা সামরিক, বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিল। ফলে জোটে যোগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার বেশ কিছু দেশ রয়েছে, যে দেশগুলো উভয় জোটেই আছে (জর্দান, আরব আমিরাত, বাহরাইন, তুরস্ক, কুয়েত ইত্যাদি)। সৌদি আরব মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটেও আছে।
এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। এক. সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। দুই. সৌদি আরব পারস্যীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংক বহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে; কিন্তু আমিরের সম্মানে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনেসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনেসিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। তিন. সৌদি আরবের নীতি-নির্ধারকদের একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। প্যারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে। চার. এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতার্দশ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতার্দশ। এক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতি-নির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই। সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
সৌদি জোট গঠন করার কথা বলা হয়েছে মাত্র। জোট এখনো তার যাত্রা শুরু করেনি। তার কমান্ডও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই জোটের সম্পর্ক কী হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। সুতরাং জোট গঠনের কথা ঘোষণা করলেও জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। Daily Manob Kontho 27.12.15
এখানে আরো একটা কথা বলা দরকার। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, যাদের নাগরিকদের প্রায় সবাই মুসলমান। ওই অঞ্চলের একটি দেশও জোটে যোগ দেয়নি। তাজকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, কিরগিজস্তান এই দেশগুলো এক সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে গেলে এই দেশগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ’ যদি অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে থাকে জোটে যোগ দেয়ার ব্যাপারে। তাহলে মুসলমান প্রধান এই দেশগুলো যোগ দিল না কেন? ইন্দোনেশিয়া বড় মুসলিম দেশ। এই দেশটিও নেই কেন? পাঠক, লক্ষ্য করুন কোন দেশগুলো যোগ দিয়েছে? বেনিন, সাঁদ, টোগো, জিবুতি, সুদান, সিয়েরা লিওন, গ্যাবন, সোমালিয়া, কমোবোয়া, মালদ্বীপ এই দেশগুলোর সন্ত্রাস দমনে আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই এবং জাতিসংঘ এই দেশগুলোকে কখনো বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে আমন্ত্রণও জানায়নি। শুধু তাই নয়, সুদান, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, গিনি ইতোমধ্যে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব দেশে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারও নেই। তাহলে এই দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানাল হলো কেন? দেশগুলো গরিব। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। ধনী দেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতার ওপর দেশগুলো নির্ভরশীল। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই কি দেশগুলোকে সৌদি আরব তার জোটে রেখেছে?
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জোটে ৩৪ দেশ যোগ দিয়েছে। এই জোটকে বলা হচ্ছে ‘ইসলামিক মিলিটারির অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেররিজম’ (আইএসএএফটি)। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই এই জোটের জš§! এখানে কোনো একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কথা বলা হয়নি। সম্প্রতি সিরিয়া ইরাকে জš§ নেয়া ইসলামিক স্টেট বা দায়েশ (আরবি নাম) এর বিরুদ্ধে আলাদা আলাদাভাবে বিমান হামলা পরিচালনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ও রাশিয়া। অনেক আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি জোট ‘দ্য গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল।’ এখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, আইএসআইএল তথা ইসলামিক স্টেটের কথা। ৬৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের মূল টার্গেট ইসলামিক স্টেট। এখন এর পাশাপাশি গঠিত হলো আইএসএএফটি। একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরটি নেতৃত্বে সৌদি আরব। উভয় জোটের স্বার্থ কি এক? অর্থাৎ উভয় জোটই কি ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হবে? বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জোটে বাংলাদেশকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দেয়নি। এখন সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশ যোগ দিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিল না কেন? নাকি ওই জোটে যোগ দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগে সৌদি জোটে যোগ দিল? মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা আমাকে বলতে চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এক টিভি টক শোতে তিনি আমাকে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন। তবে জানিয়েছিলেন, ‘অসামরিক ও জাতিসংঘের উদ্যোগে যে কোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।’ অর্থাৎ আমি ধরে নিয়েছি যদি কোনো ধরনের ‘মানবিক বিপর্যয়ের’ ঘটনা ঘটে সিরিয়ায়, তাহলে বাংলাদেশ মার্কিন জোটকে সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনে জোটে যোগ দেবে। এখন সৌদি জোটে যার চরিত্র অনেকটা সামরিক, বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিল। ফলে জোটে যোগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার বেশ কিছু দেশ রয়েছে, যে দেশগুলো উভয় জোটেই আছে (জর্দান, আরব আমিরাত, বাহরাইন, তুরস্ক, কুয়েত ইত্যাদি)। সৌদি আরব মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটেও আছে।
এই সৌদি জোট অনেক প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। এক. সৌদি আরব নিজে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অন্যতম নির্ধারক হিসেবে নিজেকে দেখতে চায়। অতীতের কোনো সৌদি বাদশাহ এভাবে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো বড় ভূমিকা পালন করেননি। কিন্তু বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ‘অ্যাপ্রোচ’ একটু ভিন্ন। তিনি সৌদি আরবকে দেখতে চান এ অঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে। তাই তার নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটের প্রয়োজন ছিল। দুই. সৌদি আরব পারস্যীয় অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াতে চায়। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখেছি, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ সৌদি আরবের হস্তক্ষেপ তথা সৌদি বিমানবাহিনীর ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ। এর আগে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সৌদি ট্যাংক বহরকে আমরা লেবাননে প্রবেশ করতে দেখেছি। অতীতে কুয়েতের আমির যখন ইরাকি সেনাদের দ্বারা উৎখাত হন (১৯৯০), তখন সৌদি আরব আমিরকে আশ্রয় দিয়েছিল বটে; কিন্তু আমিরের সম্মানে কোনো সেনা বা বিমান পাঠায়নি। ২০১১ সালে তিউনেসিয়ায় ‘জেসমিন বিপ্লব’ জাইন আল আবেদিন বেন আলিকে ক্ষমতাচ্যুত ও বেন আলি সৌদি আরবে আশ্রয় নিলেও সৌদি আরব তিউনেসিয়ায় হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতাসীন হয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনেন। আর তারই ফলে নতুন এক ‘সৌদি আরব’কে আমরা দেখছি। তিন. সৌদি আরবের নীতি-নির্ধারকদের একটা বড় ভয় ইরানকে নিয়ে। প্যারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের ভূমিকা বাড়ছে এবং ইরানের এই ভূমিকাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকারও করে। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি পারমাণবিক চুক্তি, ইরানের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে ওবামার গোপন চিঠি লেখা ইত্যাদি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ইরানের ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছে। চার. এই জোটে সিরিয়াকে রাখা হয়নি। এটা সবাই জানে সৌদি আরব চাচ্ছে সিরিয়ায় আসাদের উৎখাত। কিন্তু সৌদি পছন্দের তালিকায় আইএসও নেই। সম্প্রতি আসাদবিরোধী দলগুলোর একটি সম্মেলন হয়ে গেল রিয়াদে। সেখানে এমন অনেক দল অংশ নিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা কী হবে এসব দল ও জোটের বিরুদ্ধে? অনেকেই জানেন ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে, যারা ওয়াহাবি মতার্দশ ও আদি ইসলামিক রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত হচ্ছে। সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে এই ওয়াহাবি মতার্দশ। এক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে আইএসের সঙ্গে সৌদি নীতি-নির্ধারকদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আদর্শগতভাবে মিল তো আছেই। সুতরাং সৌদি-আইএস সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
সৌদি জোট গঠন করার কথা বলা হয়েছে মাত্র। জোট এখনো তার যাত্রা শুরু করেনি। তার কমান্ডও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই জোটের সম্পর্ক কী হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। সুতরাং জোট গঠনের কথা ঘোষণা করলেও জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। Daily Manob Kontho 27.12.15
0 comments:
Post a Comment