বিশ্বের
উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিসে জাতিসংঘ কর্তৃক কপ-২১ সম্মেলন শুরু হলেও শেষ
অবধি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা
যাচ্ছে না। গত ৩০ নভেম্বর এই শীর্ষ সম্মেলনটি শুরু হয়েছে এবং চলবে ১১
ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রয়োজনে আরও দু-একদিন সম্মেলনটি বাড়ানো হতে পারে।
ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং,
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন। এতে করে একদিকে এই সম্মেলনের গুরুত্ব যেমনি বেড়েছে,
ঠিক তেমনি তাদের সবার বক্তব্যেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্ষতির
দিকটি ফুটে উঠেছে। বিশ্ব নেতারা প্রায় সবাই একবাক্যে বায়ুম-লে কার্বন
নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে করে ধারণা করা
স্বাভাবিক যে, একটি চুক্তি এবং কার্বন হ্রাসের বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে
কপ-২১ শেষ হবে। আমাদের ধারণা কতটুকু বাস্তবে রূপ পাবে, তা দেখার জন্য আরও
এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা সত্য, বিশ্ব নেতাদের মধ্যে একটা
উপলব্ধিবোধ এসেছে, কার্বন নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। তবে কাজটি
নিঃসন্দেহে সহজ নয়। এর সঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন জড়িতÑ উন্নত বিশ্ব কর্তৃক
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য, জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় ‘টেকনোলজি
ট্রান্সফার’, উন্নত বিশ্বের নিজের কার্বন নিঃসরণ হার কমানোÑ ইত্যাদি বিষয়
জড়িত। এর আগে গেল ডিসেম্বরে লিমা কপ-২০ সম্মেলনে প্রতিটি দেশকে কার্বন
নিঃসরণ কমাতে নিজস্ব কর্মপদ্ধতি ও কাঠামো উপস্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ এটা করেছে। কিন্তু সব দেশ এটা করতে পেরেছে কিনা, সে ব্যাপারে আমি
নিশ্চিত নই। চিন ও ভারতের মতো দেশের কার্বন নিঃসরণ নিয়েও কথা আছে। কেননা
দেশ দুটি সাম্প্রতিককালে বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশে পরিণত
হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনে যে ক’টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে আগামীতে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পরপর দু’বার বন্যা ও পরবর্তীকালে ‘সিডর’-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে ‘আইলা’। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিডরের পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে! সিডরের ক্ষতি ছিল গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নয়টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিলেন ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। সিডর ও আইলার পর ‘মহাসেন’ বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। যদিও এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাইনি। সিডর ও আইলার আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ নোনাজলের আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর মহাসেন আমাদের আবারও ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছিল।
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা আরও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।
বলা ভালো বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও, তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো, আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সিডর ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতি সাড়াতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ ‘যুদ্ধ’ করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এমন প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ু সংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি ‘রাজনীতি’ ঢুকে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে, তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সারা বিশ্বে একটা উদ্বিগ্নতা থাকলেও কতটুকু সচেতন আমরা তা নিশ্চিত নই। আমরা বারবার বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পরিবেশ দূষণ হয় এমন কর্মকা-ের ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি কম। বিদেশ থেকে যে সাহায্য পাওয়া গেছে, তাতে দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। এমনকি সুন্দরবনের কাছাকাছি একটি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে আমরা বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে রয়েছি। পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করলেও সরকার এ ব্যাপারে এখনো অনড়। মজার ব্যাপার বড় দল বিএনপি এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য না দিলেও বাম সংগঠনগুলো সোচ্চার। তারা সুন্দরবন পর্যন্ত লংমার্চের আয়োজন করেছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকারÑ সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কী আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না, নেইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ই-আইএ সমীক্ষাÑ তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারি মৌজায় ১ হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুম-লে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কি অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। ইতোমধ্যে সুন্দরবনকে গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির সৃষ্টি করে। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লংঘন করেছি। ফলে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আমরা যতই সোচ্চার হই না কেন, আমরা আমাদের নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় কতটুকু সচেতন এ প্রশ্ন উঠবেই। প্যারিস সম্মেলনে যদি আদৌ সুন্দরবনের প্রশ্নটি ওঠে, আমি তাতে অবাক হব না।
প্যারিস সম্মেলনের আগে বৈদেশিক সাহায্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য না পেলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না- এমন কথাও উঠেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জলবায়ু মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেরা যদি নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় সচেতন না হয়, তাহলে বাইরের কোনো ‘শক্তি’ তাকে সাহায্য করতে পারবে না।
প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলনে একটি চুক্তি হলেও তা এখনই কার্যকরী হবে না। কার্যকর হবে ২০২০ সাল থেকে। বিশ্ব যদি প্যারিসে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে না পারে, তাহলে আমাদের জন্য আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হাড় কাঁপানো শীত, মারাত্মক ঝড়, অবাধ্য তাপপ্রবাহ, তীব্র পানি সংকট এবং সেই সঙ্গে ভয়াবহ শরণার্থী সংকট আমরা প্রত্যক্ষ করব আগামী দিনগুলোতে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ‘গ্রিনবিশ্ব’ উপহার দেওয়ার জন্য প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে একটি চুক্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এখানে উল্লেখ্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনে যে ক’টি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে আগামীতে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পরপর দু’বার বন্যা ও পরবর্তীকালে ‘সিডর’-এর আঘাতের সম্মুখীন হয়। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত করে ‘আইলা’। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপক খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিডরের পর বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে! সিডরের ক্ষতি ছিল গোর্কির চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সিডরে ৩০ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নয়টি জেলা। ২০০ উপজেলার ১ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন সিডরের আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা গিয়েছিলেন ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। সিডর ও আইলার পর ‘মহাসেন’ বাংলাদেশে আঘাত করেছিল। যদিও এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাইনি। সিডর ও আইলার আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত। আইলায় ৮০ ভাগ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ নোনাজলের আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব ওইসব অঞ্চলে। এরপর মহাসেন আমাদের আবারও ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছিল।
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালবাসেন। কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা আরও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের পরিবেশমন্ত্রী গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্লাকার্ড ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমত আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায় তাতে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পাইনি।
বলা ভালো বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও, তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এ জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এই সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। গেলবার যে বন্যা হলো, আবার আমাদের সে কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিল। বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এখন এ দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সিডর ও আইলার আঘাতে আমাদের যা ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতি সাড়াতে সরকারের বড়সড় উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলেও এখানেও ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। দলীয় বিবেচনায় টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে যেসব এনজিও জলবায়ু নিয়ে কাজ করেনি, যাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই, শুধু দলীয় বিবেচনায় তাদের নামে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। জলবায়ু তহবিলের অর্থ পাওয়া উচিত ওইসব অঞ্চলে যেখানে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের আঘাত বেশি আর মানুষ ‘যুদ্ধ’ করে সেখানে বেঁচে থাকে। অথচ দেখা গেছে, জলবায়ুর জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভাকে, মানিকগঞ্জের একটি প্রকল্পে কিংবা নীলফামারী তিস্তা বহুমুখী সমাজকল্যাণ সংস্থাকে। সিরাজগঞ্জের প্রগতি সংস্থাও পেয়েছে থোক বরাদ্দ। অথচ এমন প্রতিষ্ঠানের একটিরও জলবায়ু সংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জলবায়ু তহবিলের টাকা বরাদ্দেও যদি ‘রাজনীতি’ ঢুকে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু থাকতে পারে না। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যায়, বরাদ্দ পাওয়া এনজিওগুলোর সঙ্গে সরকারি দলের নেতা ও কর্মীরা জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি যদি এখানেও স্পর্শ করে, তাহলে জলবায়ু ফান্ডে আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। সচেতন হওয়ার সময় তাই এখনই। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে সারা বিশ্বে একটা উদ্বিগ্নতা থাকলেও কতটুকু সচেতন আমরা তা নিশ্চিত নই। আমরা বারবার বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। পরিবেশ দূষণ হয় এমন কর্মকা-ের ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি কম। বিদেশ থেকে যে সাহায্য পাওয়া গেছে, তাতে দুর্নীতি রোধ করতে পারিনি। এমনকি সুন্দরবনের কাছাকাছি একটি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে আমরা বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে রয়েছি। পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করলেও সরকার এ ব্যাপারে এখনো অনড়। মজার ব্যাপার বড় দল বিএনপি এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য না দিলেও বাম সংগঠনগুলো সোচ্চার। তারা সুন্দরবন পর্যন্ত লংমার্চের আয়োজন করেছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এ জন্য বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকারÑ সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কী আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না, নেইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ই-আইএ সমীক্ষাÑ তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারি মৌজায় ১ হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুম-লে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কি অন্যত্র স্থানান্তরিত করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। ইতোমধ্যে সুন্দরবনকে গ্লোবাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু করতে পারি না যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির সৃষ্টি করে। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লংঘন করেছি। ফলে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে আমরা যতই সোচ্চার হই না কেন, আমরা আমাদের নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় কতটুকু সচেতন এ প্রশ্ন উঠবেই। প্যারিস সম্মেলনে যদি আদৌ সুন্দরবনের প্রশ্নটি ওঠে, আমি তাতে অবাক হব না।
প্যারিস সম্মেলনের আগে বৈদেশিক সাহায্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য না পেলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না- এমন কথাও উঠেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জলবায়ু মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য, উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেরা যদি নিজেদের পরিবেশ রক্ষায় সচেতন না হয়, তাহলে বাইরের কোনো ‘শক্তি’ তাকে সাহায্য করতে পারবে না।
প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলনে একটি চুক্তি হলেও তা এখনই কার্যকরী হবে না। কার্যকর হবে ২০২০ সাল থেকে। বিশ্ব যদি প্যারিসে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে না পারে, তাহলে আমাদের জন্য আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হাড় কাঁপানো শীত, মারাত্মক ঝড়, অবাধ্য তাপপ্রবাহ, তীব্র পানি সংকট এবং সেই সঙ্গে ভয়াবহ শরণার্থী সংকট আমরা প্রত্যক্ষ করব আগামী দিনগুলোতে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ‘গ্রিনবিশ্ব’ উপহার দেওয়ার জন্য প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে একটি চুক্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
Daily Amader Somoy
06.12.15
0 comments:
Post a Comment