প্যারিসে জঙ্গি তৎপরতার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই পশ্চিম
আফ্রিকার দেশ মালির রাজধানী বামাকোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বের
দৃষ্টি কেড়েছে। প্যারিসবাসী যখন সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নিহত ১২৯ জন
সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে, ঠিক তখনই বামাকোতে
সন্ত্রাসীরা হোটেল র্যাডিসনে ১৭০ জন বিদেশি নাগরিককে জিম্মি করে নেয়।
ফ্রান্সের কয়েক হাজার সৈন্য সেখানে আগে থেকেই ছিল। তাদের জিম্মি উদ্ধার
অভিযানে ইতিমধ্যে সেখানে মারা গেছেন ২৭ জন মানুষ। প্যারিস আর বামাকোর ঘটনা
দুটি বিচ্ছিন্ন। কিন্তু একটা যোগসূত্র আছে। প্যারিস হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল
ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। এ কথা তারা স্বীকারও করেছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের
সঙ্গে মূল জড়িত যে ব্যক্তি আবদেল হামিদ আবাউদ, তিনি ফরাসি পুলিশের সাঁড়াশি
অভিযানে নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে বামাকোর ঘটনাবলির সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের
জঙ্গিরা সরাসরি জড়িত নন। এটা প্রমাণিত হলেও মালিতে বেশ কয়টি ইসলামিক
জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে আইএসের পরোক্ষ জড়িত থাকা
বিচিত্র কিছু নয়। বলা ভালো, ইসলামিক জঙ্গিদের জঙ্গি তৎপরতা রোধ করার জন্যই
ফ্রান্সের সেনাবাহিনী সেখানে হস্তক্ষেপ করেছিল। ধারণা করা হয়, মালিতে প্রায়
তিন হাজার ফ্রান্সের সেনা রয়েছে। মালিতে উত্তরে তুয়ারেগ বিদ্রোহ ঠেকাতে,
যা পরিচালিত হয়েছিল ইসলামী জঙ্গিদের দ্বারা এবং নস্যাৎ করতে ফ্রান্সের
সেনাবাহিনী সেখানে সাময়িকভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। সে থেকে ফ্রান্সের সৈন্যরা
সেখানেই আছে। ফলে ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর
ভূমিকার ব্যাপারে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের ক্ষোভ থাকবে-এটাই স্বাভাবিক। আর
কর্মকাণ্ডে আইএস জড়িত না থাকলেও আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত আল মুরাবিতুম
সংগঠনটি জড়িত।
এখানে উলেখ করা প্রয়োজন যে মালির উত্তরে তুয়ারেগ (Tuareg) অঞ্চলে
ন্যূনতম চারটি ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীর খবর আমরা জানি, যারা সেখানে একটি
‘জিহাদি যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে। একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও
তারা কাজ করে যাচ্ছে। এই চারটি সংগঠন হচ্ছে আনসার দ্বীন ((Ansar Dine)),
আল-কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব (AQIM), মোজওআ (Mojwa) ও আল মুয়াক্কিন বি ডিমা
(Al-Muwaqun Bi Dima)। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ‘সাহেল জোন’-এর অন্তর্ভুক্ত
মালি, মৌরিতানিয়া ও নাইজারে ইসলামিক জঙ্গিদের তৎপরতাও বেড়েছে। মাগরেবভুক্ত এ
অঞ্চলের বাইরে নাইজেরিয়ায় ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারামের নৃশংস ঘটনাবলি
সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছিল। বোকো হারামের জঙ্গিরা কিশোরী মেয়েদের স্কুল
থেকে অপহরণ করত এবং তাদের জঙ্গি কমান্ডারদের তথাকথিত যৌনদাসী হিসেবে
ব্যবহার করত। শত শত কিশোরী মেয়েকে অপহরণের পর আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বোকো হারাম সম্প্রতি ইসলামিক স্টেটের নেতৃত্বের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ
করেছে। অছওগ চাচ্ছে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। ২০০৭ সালে তারা
এই ঘোষণা দেয়। আলজেরিয়া, লিবিয়া, মালি, মরক্কো ও তিউনিসিয়ায় তাদের তৎপরতা
সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম ও আনসারুর মতো সংগঠন একটি খিলাফত
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নাইজার ও ক্যামেরুনেও তাদের কর্মকাণ্ড
সম্প্রসারিত হয়েছে। বলা হয়, নাইজেরিয়ার ৩৬টি প্রদেশের মধ্যে ১৪টিতে বোকো
হারামের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। আর মালিতে ২০১১ সালে জঙ্গি সংগঠন আনসার
দ্বীন সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শরিয়া আইন বলবৎ করেছে। ফলে এ
অঞ্চলগুলো একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে। উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশ একসময়
ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। ফলে এসব দেশের অনেক মানুষ ফ্রান্স, বিশেষ করে
রাজধানী প্যারিসে বসবাস করে। এদের দ্বিতীয় তথা তৃতীয় জেনারেশন ফ্রান্সে
বসবাস করে আসছে। কিন্তু ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেলেও এরা দ্বিতীয় শ্রেণির
নাগরিক। চাকরির ক্ষেত্রে, সামাজিক দিক দিয়ে এরা বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিল।
আর এই সুযোগটি নিয়েছিল আইএস। এরা তরুণসমাজের মধ্যে তাদের অবস্থান শক্তিশালী
করেছিল। ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এ ক্ষেত্রে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন
করেনি। এর বড় প্রমাণ হাসনাআইত বুলাচেনের ঘটনা, যিনি ইউরোপে প্রথম নারী
আÍঘাতী হিসেবে পরিচিতি পান। বুলাচেন কিছুদিন আগ পর্যন্ত পশ্চিমা পোশাক ও
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর বন্ধুরা ইংল্যান্ডের টেলিগ্রাফকে
জানিয়েছেন, হাসনা ব্যক্তিজীবনে জিনস প্যান্ট, কোকাকোলা আর পশ্চিমা সংগীতে
বুঁদ হয়ে থাকতেন। তাঁর কাছে ইসলাম ধর্মের কোনো আবেদন ছিল না। হঠাৎ করেই
তিনি ‘হিজাবি’ হয়ে যান ও জিহাদি তৎপরতায় জড়িয়ে যান। আইএসের সমর্থক হাসনা
বুলাচেন পুলিশের আক্রমণের মুখে গত ১৯ নভেম্বর প্যারিসে নিজেকে উড়িয়ে দেন।
আইএস এভাবেই তরুণ প্রজন্মের ভেতর তার ‘প্রভাব’ বিস্তার করেছিল।
এখানে উলেখ করা প্রয়োজন যে সিরিয়ায় আইএস বা ইসলামিক স্টেটের নাম প্রথম শোনা যায় ২০১৩ সালে। তখন সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। এ এলাকার ঐতিহাসিক নাম লেভান্ট। জঙ্গিরা এই নামটি গ্রহণ করেছিল। পরে নামটি পরিবর্তন করে। তবে ১৯৯১ সালে ‘জামাত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ’ নামে একটি সংগঠনের ব্যাপারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে এরা ‘আল-কায়েদা ইন ইরাক’ নাম ধারণ করে। এই সংগঠনটি মূলত সুন্নি প্রভাবাধীন ও সুন্নি সম্প্রদায়নির্ভর। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন শুরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। ২০১৪ সালের ২৯ জুন বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। তবে আল-কায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আইএসের সঙ্গে আল-কায়েদার কোনো সম্পর্ক নেই। আল-কায়েদার রাজনৈতিক দর্শন ও ইসলামিক স্টেটের রাজনীতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুটি সংগঠনই মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল-কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যা আল-কায়েদার নেতা বিন লাদেন যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেননি। বুগদাদি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা বা খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে দাবি করেছেন, সব মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে এই খেলাফতের প্রতি একাÍতা প্রকাশ করা। তিনি মুসলিমপ্রধান দেশগুলো নিয়ে এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। অন্যদিকে আল-কায়েদা স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ছোট ছোট আমিরাত প্রতিষ্ঠা করা। আল-কায়েদা মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অপারেট করে। কিন্তু আইএস তা করে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আল-কায়েদা ও আইএস উভয় সংগঠনই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার জন্ম দেওয়া। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় স্ট্র্যাটেজি রয়েছে। এখানে তার স্বার্থ অনেক। স্বার্থ রয়েছে ফ্রান্সেরও। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আমিরাত ও সাইপ্রাসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সস্তায় তেল পাওয়া যায়। এই তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। লিবিয়ার তেলের ওপর তিনটি পশ্চিমা দেশের নির্ভরশীলতা ইতিমধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইতালির প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ২৯ শতাংশ আসে লিবিয়া থেকে। ফ্রান্স ও স্পেনের এই নির্ভরশীলতার হার যথাক্রমে ১৪ ও ১০ শতাংশ। তারা চাইবে সস্তায় তেল নিতে। সিরিয়ায় খুব বেশি তেলসম্পদ নেই। কিন্তু এই তেলই এখন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের আয়ের অন্যতম উৎস। আইএস প্রতিদিন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ৪০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। কালোবাজারে তা বিক্রি করে। এর মূল্য বছর হিসাবে ৩২ কোটি ডলার। আর প্রতিদিনের তেল বিক্রির অর্থ জমা হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের ফান্ডে। এই ফান্ড ব্যবহৃত হয় জঙ্গিদের মাসিক বেতন (৪৩০ ডলার থেকে এক হাজার ডলার) ও সেই সঙ্গে বিদেশে জঙ্গি তৎপরতার কাজে। যেমন বলা যেতে পারে, প্যারিসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় ৫০ হাজার ডলার ব্যয় হয়েছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা।
কাকতালীয়ভাবে ২০০১ সালের ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার সঙ্গে প্যারিসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের অনেক মিল আছে। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও ‘টুইন টাওয়ার’ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ‘রহস্য’ আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। কেন ‘টুইন টাওয়ার’ হামলায় একজন ইহুদিও মারা গেল না, কারা অভিযুক্ত সৌদি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, এর পেছনে কাদের আর্থিক স্বার্থ বেশি ছিল, একটা মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করে কারা লাভবান হয়েছে, কেন সৌদি আরব রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না-এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আমাদের জানা নেই। আমি ইতিমধ্যে কালের কণ্ঠে ৯/১১ নিয়ে একাধিক নিবন্ধ লিখেছি। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছি ৯/১১-এর ঘটনাবলি ছিল একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্রেরই ফল। আজ যখন ভিন্ন আঙ্গিকে প্যারিস ট্র্যাজেডি সংঘটিত হতে দেখি, তখন স্পষ্টতই আবারও সেই ষড়যন্ত্রের কথাই মনে হয়ে যায়। আল-কায়েদার চ্যাপ্টার এখন ‘শেষ’। ওসামা বিন লাদেন এখন ইতিহাস। রাজনীতির মঞ্চে এখন আছেন বুগদাদি, আর ইসলামিক স্টেট। কে এই বুগদাদি, কারা আইএস তৈরি করল-এ নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরাই বলেন, এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সৃষ্টি। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মিসেল চসসুডোভসকি তো স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছেন, প্যারিস ট্র্যাজেডি হচ্ছে ৯/১১ ফ্রেন্স স্টাইল (Le 11 September a la francaise)। যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই Greater Middle East Policy সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। কয়েক বছর আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক সাতটি দেশের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। ওই সাতটি দেশ হচ্ছে-ইরান, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরাক। ইতিমধ্যে লিবিয়া ও ইরাকে পরিবর্তন হয়েছে। সিরিয়া পরিবর্তনের পথে। ২০২০-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে মানচিত্র আঁকতে হবে। সৌদি আরব ভেঙে যাওয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া ও ইরাক একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়া-এ সবই এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। আর সূ²ভাবে দেখলে দেখা যাবে, এ থেকে উপকৃত হচ্ছে একমাত্র ইসরায়েল। আজ তাই কোনো কোনো পক্ষের কাছে যেমনি প্রয়োজন ছিল ৯/১১-এর জন্ম দেওয়ার, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ছিল প্যারিস ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করার। আর এর রেশ ধরেই মালির রাজধানী বামাকোতে ঘটল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এর মধ্য দিয়েই এখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শেষ হয়ে যাবেÑএটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা আইএসের ট্র্যাটেজি হচ্ছে ‘সন্ত্রাসের মধ্যে বিজয় অর্জন’। বুগদাদি এই স্ট্র্যাটেজি রচনা করেছেন। সন্ত্রাসের মাধ্যমে তিনি সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকায় আইএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন বটে; কিন্তু তা বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্যারিসে ১২৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আইএস ঘৃণাই অর্জন করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড পছন্দ করছে না। বুগদাদি তাঁর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আফ্রিকায়ও ছড়িয়ে দিতে চান। আর তাই মালির রাজধানী বামাকোতে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটল, তা সমর্থন পাবে না। তবে একটা ভয়ের আবহ ছড়িয়ে দিল।
এর শেষ কোথায়? আইএস হোয়াইট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন মালির রাজধানীতে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিল ইসলাম নয়, বরং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই তারা ‘বিজয়’ অর্জন করতে চায়! আইএসের বিরুদ্ধে একটি সর্বাÍক ‘যুদ্ধ’ শুরু করা জরুরি। সিরিয়ায় স্থলবাহিনী পাঠানো হবে কি না এটা নিয়ে বিশ্ব আজ দ্বিধাবিভক্ত। ওবামা প্রশাসন এখনো সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ওবামার যেকোনো সিদ্ধান্ত ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। রিপাবলিকানদের হাত এতে শক্তিশালী হবে। আইএসের শিবিরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া বোমাবর্ষণ করে দেশ দুটি আলাদা আলাদাভাবে সিরিয়ায় তাদের ‘অভিযান’ অব্যাহত রেখেছে। সমস্যা আছে আসাদকে রাখা আর না রাখা নিয়ে। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র আসাদকে সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে সরানোর পক্ষে। কিন্তু রাশিয়া তাঁকে রাখতে চায়। ইরানের অবস্থানও রাশিয়ার পক্ষে। ফলে জটিলতা রয়ে গেছে। আর তাতে সুবিধা পাচ্ছে আইএস। প্যারিসে জঙ্গি হামলার পরপরই যখন মালির রাজধানীতে জঙ্গি হামলা হলো তখন একটা আশঙ্কা তৈরি হয় যে এ ধরনের জঙ্গি হামলা আরো হবে। তাই বিশ্বশক্তি যদি জঙ্গি দমনে ন্যূনতম ইস্যুতে এক না হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য খারাপ খবরই অপেক্ষা করছে। Daily Kaler Kontho 02.12.15
এখানে উলেখ করা প্রয়োজন যে সিরিয়ায় আইএস বা ইসলামিক স্টেটের নাম প্রথম শোনা যায় ২০১৩ সালে। তখন সংগঠনটির নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। এ এলাকার ঐতিহাসিক নাম লেভান্ট। জঙ্গিরা এই নামটি গ্রহণ করেছিল। পরে নামটি পরিবর্তন করে। তবে ১৯৯১ সালে ‘জামাত আল তওহিদ ওয়াল জিহাদ’ নামে একটি সংগঠনের ব্যাপারে মূলত এটি সংগঠিত হয়েছিল। পরে এরা ‘আল-কায়েদা ইন ইরাক’ নাম ধারণ করে। এই সংগঠনটি মূলত সুন্নি প্রভাবাধীন ও সুন্নি সম্প্রদায়নির্ভর। ২০০৬ সালে ইরাকে সুন্নি প্রভাবাধীন মুজাহিদিন শুরা কাউন্সিলে সংগঠনটি যোগ দেয়। ২০১৩ সালে সারা বিশ্ব প্রথমবারের মতো আবু বকর বুগদাদির নাম জানতে পারে। ২০১৪ সালের ২৯ জুন বুগদাদি একটি খেলাফতের ডাক দিলে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন সংগঠনটি নতুন নাম ধারণ করে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। তবে আল-কায়েদার সঙ্গে সংগঠনটির সম্পর্ক কী এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে আইএসের সঙ্গে আল-কায়েদার কোনো সম্পর্ক নেই। আল-কায়েদার রাজনৈতিক দর্শন ও ইসলামিক স্টেটের রাজনীতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। দুটি সংগঠনই মূলত জিহাদি, সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়। আল-কায়েদা জিহাদি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসরণ করলেও খেলাফতের কথা বলেনি কখনো। আইএস খেলাফতের কথা বলেছে। বুগদাদি নিজেকে খলিফা বা আমিরুল মুমেনিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যা আল-কায়েদার নেতা বিন লাদেন যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেননি। বুগদাদি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা বা খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে দাবি করেছেন, সব মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে এই খেলাফতের প্রতি একাÍতা প্রকাশ করা। তিনি মুসলিমপ্রধান দেশগুলো নিয়ে এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। অন্যদিকে আল-কায়েদা স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ছোট ছোট আমিরাত প্রতিষ্ঠা করা। আল-কায়েদা মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অপারেট করে। কিন্তু আইএস তা করে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আল-কায়েদা ও আইএস উভয় সংগঠনই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার জন্ম দেওয়া। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় স্ট্র্যাটেজি রয়েছে। এখানে তার স্বার্থ অনেক। স্বার্থ রয়েছে ফ্রান্সেরও। বাহরাইন ও কাতারে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আমিরাত ও সাইপ্রাসে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সস্তায় তেল পাওয়া যায়। এই তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। লিবিয়ার তেলের ওপর তিনটি পশ্চিমা দেশের নির্ভরশীলতা ইতিমধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ইতালির প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ২৯ শতাংশ আসে লিবিয়া থেকে। ফ্রান্স ও স্পেনের এই নির্ভরশীলতার হার যথাক্রমে ১৪ ও ১০ শতাংশ। তারা চাইবে সস্তায় তেল নিতে। সিরিয়ায় খুব বেশি তেলসম্পদ নেই। কিন্তু এই তেলই এখন ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের আয়ের অন্যতম উৎস। আইএস প্রতিদিন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ৪০ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। কালোবাজারে তা বিক্রি করে। এর মূল্য বছর হিসাবে ৩২ কোটি ডলার। আর প্রতিদিনের তেল বিক্রির অর্থ জমা হচ্ছে ইসলামিক স্টেটের ফান্ডে। এই ফান্ড ব্যবহৃত হয় জঙ্গিদের মাসিক বেতন (৪৩০ ডলার থেকে এক হাজার ডলার) ও সেই সঙ্গে বিদেশে জঙ্গি তৎপরতার কাজে। যেমন বলা যেতে পারে, প্যারিসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায় ৫০ হাজার ডলার ব্যয় হয়েছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা।
কাকতালীয়ভাবে ২০০১ সালের ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার সঙ্গে প্যারিসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের অনেক মিল আছে। দীর্ঘ ১৪ বছর পরও ‘টুইন টাওয়ার’ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ‘রহস্য’ আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। কেন ‘টুইন টাওয়ার’ হামলায় একজন ইহুদিও মারা গেল না, কারা অভিযুক্ত সৌদি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, এর পেছনে কাদের আর্থিক স্বার্থ বেশি ছিল, একটা মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করে কারা লাভবান হয়েছে, কেন সৌদি আরব রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না-এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আমাদের জানা নেই। আমি ইতিমধ্যে কালের কণ্ঠে ৯/১১ নিয়ে একাধিক নিবন্ধ লিখেছি। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলার চেষ্টা করেছি ৯/১১-এর ঘটনাবলি ছিল একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্রেরই ফল। আজ যখন ভিন্ন আঙ্গিকে প্যারিস ট্র্যাজেডি সংঘটিত হতে দেখি, তখন স্পষ্টতই আবারও সেই ষড়যন্ত্রের কথাই মনে হয়ে যায়। আল-কায়েদার চ্যাপ্টার এখন ‘শেষ’। ওসামা বিন লাদেন এখন ইতিহাস। রাজনীতির মঞ্চে এখন আছেন বুগদাদি, আর ইসলামিক স্টেট। কে এই বুগদাদি, কারা আইএস তৈরি করল-এ নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরাই বলেন, এটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সৃষ্টি। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মিসেল চসসুডোভসকি তো স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছেন, প্যারিস ট্র্যাজেডি হচ্ছে ৯/১১ ফ্রেন্স স্টাইল (Le 11 September a la francaise)। যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই Greater Middle East Policy সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। কয়েক বছর আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক সাতটি দেশের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন। ওই সাতটি দেশ হচ্ছে-ইরান, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরাক। ইতিমধ্যে লিবিয়া ও ইরাকে পরিবর্তন হয়েছে। সিরিয়া পরিবর্তনের পথে। ২০২০-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে মানচিত্র আঁকতে হবে। সৌদি আরব ভেঙে যাওয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া ও ইরাক একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়া-এ সবই এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে। আর সূ²ভাবে দেখলে দেখা যাবে, এ থেকে উপকৃত হচ্ছে একমাত্র ইসরায়েল। আজ তাই কোনো কোনো পক্ষের কাছে যেমনি প্রয়োজন ছিল ৯/১১-এর জন্ম দেওয়ার, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ছিল প্যারিস ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করার। আর এর রেশ ধরেই মালির রাজধানী বামাকোতে ঘটল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এর মধ্য দিয়েই এখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শেষ হয়ে যাবেÑএটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা আইএসের ট্র্যাটেজি হচ্ছে ‘সন্ত্রাসের মধ্যে বিজয় অর্জন’। বুগদাদি এই স্ট্র্যাটেজি রচনা করেছেন। সন্ত্রাসের মাধ্যমে তিনি সিরিয়া ও ইরাকের বিশাল এলাকায় আইএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন বটে; কিন্তু তা বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্যারিসে ১২৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আইএস ঘৃণাই অর্জন করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড পছন্দ করছে না। বুগদাদি তাঁর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আফ্রিকায়ও ছড়িয়ে দিতে চান। আর তাই মালির রাজধানী বামাকোতে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটল, তা সমর্থন পাবে না। তবে একটা ভয়ের আবহ ছড়িয়ে দিল।
এর শেষ কোথায়? আইএস হোয়াইট হাউস উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন মালির রাজধানীতে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিল ইসলাম নয়, বরং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই তারা ‘বিজয়’ অর্জন করতে চায়! আইএসের বিরুদ্ধে একটি সর্বাÍক ‘যুদ্ধ’ শুরু করা জরুরি। সিরিয়ায় স্থলবাহিনী পাঠানো হবে কি না এটা নিয়ে বিশ্ব আজ দ্বিধাবিভক্ত। ওবামা প্রশাসন এখনো সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ওবামার যেকোনো সিদ্ধান্ত ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। রিপাবলিকানদের হাত এতে শক্তিশালী হবে। আইএসের শিবিরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া বোমাবর্ষণ করে দেশ দুটি আলাদা আলাদাভাবে সিরিয়ায় তাদের ‘অভিযান’ অব্যাহত রেখেছে। সমস্যা আছে আসাদকে রাখা আর না রাখা নিয়ে। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র আসাদকে সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে সরানোর পক্ষে। কিন্তু রাশিয়া তাঁকে রাখতে চায়। ইরানের অবস্থানও রাশিয়ার পক্ষে। ফলে জটিলতা রয়ে গেছে। আর তাতে সুবিধা পাচ্ছে আইএস। প্যারিসে জঙ্গি হামলার পরপরই যখন মালির রাজধানীতে জঙ্গি হামলা হলো তখন একটা আশঙ্কা তৈরি হয় যে এ ধরনের জঙ্গি হামলা আরো হবে। তাই বিশ্বশক্তি যদি জঙ্গি দমনে ন্যূনতম ইস্যুতে এক না হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে আমাদের জন্য খারাপ খবরই অপেক্ষা করছে। Daily Kaler Kontho 02.12.15
0 comments:
Post a Comment