রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেমন হবে পৌরসভা নির্বাচন

৯ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা। ৩০ ডিসেম্বর ভোট। এই নির্বাচন নিয়ে মাঠে-ঘাটে, বিভিন্ন টকশোতে নানা কথা। নানা মন্তব্য। নির্বাচন ভালো হবে, কী মন্দ হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান বেশ সরগরম। এটা পৌর নির্বাচন। সাধারণ অর্থে এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা করা চলে না। কিন্তু যেহেতু দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনটি হচ্ছে, তাই অনেকটা জাতীয় নির্বাচনের আমেজ এসে গেছে। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন- ‘এটা একটা টেস্ট কেস’, এই পৌর নির্বাচন প্রমাণ করবে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হবে কি-না। মাঠে আছে বিএনপি। সরব। নির্বাচন নিয়ে তাদের শংকা অনেক বেশি। খোদ খালেদা জিয়াও পৌর নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তবে অনেকটা ‘বেকায়দায়’ আছেন সরকারি দলের সংসদ সদস্য তথা মন্ত্রীরা। তারা তাদের প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন না আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে। তবে সেখানেও আছে প্রশ্ন। যুগান্তর আমাদের জানান দিচ্ছে-‘প্রশাসনের হাতে পৌর নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ’। নির্বাচন কমিশনাররা টিভির পর্দায় খুব জোরেশোরেই বলছেন, ‘পৌরসভা নির্বাচন ভোট গ্রহণ পুরোপুরি সুষ্ঠু করতে কঠোর অবস্থানে থাকবে কমিশন।’ এক ধরনের আÍতুষ্টিতেই ভুগছেন নির্বাচন কমিশনাররা- নির্বাচন সুষ্ঠু হবে! কিন্তু অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সুখকর নয়। তাই ‘ঈষাণ কোণে কালো মেঘ’ দেখতে পাচ্ছি। সংবাদপত্রগুলো মাঝে মধ্যে এমন সব খবর দিচ্ছে, যা আমাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা পৌর নির্বাচন হলেও এর ওপর ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, যদি স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য, ভোট কেন্দ্র দখল, সিল মারার প্রবণতা রোধ করা না যায়, তাহলে প্রমাণিত হবে, সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক নয়। বেশকিছু কারণ সৃষ্টি হয়েছে যা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। প্রথম কারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের নিয়ে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন মাঠ প্রশাসনে কর্মরত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। এমনকি মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল মীমাংসার জন্য গঠিত আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬২ জন জেলা কর্তৃপক্ষকে। অথচ এসব কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত নিজস্ব জনবল রয়েছে। তাদের দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যেত। সরকারি কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় এই নির্বাচন কতটুকু ‘সরকারের প্রভাবমুক্ত’ থাকবে- এটা একটা মূল প্রশ্ন এখন। আইন নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিলেও কমিশনারদের ভূমিকা দেখে আমার মনে হয়েছে, তারা যেন এখনও অনেকটা সরকারি কর্মচারীদের মতো ভূমিকা পালন করছেন! তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বলে অনেকেরই ধারণা। কারণ প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় সরকারদলীয় প্রার্থী, সমর্থকরা যখন নির্বাচন বিধি লংঘন করছেন, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশন নির্বিকার। বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, কিংবা তারও আগে উপজেলা নির্বাচনের সময় ব্যাপক অনিয়ম, ভোট কারচুপির সংবাদ গণমাধ্যমে এলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, এমনটি দেখা যায়নি। একটা কথা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উঠেছে যে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ, অর্থাৎ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হোক, যাতে সব পক্ষের মানুষ নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে, বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে। পুলিশি হয়রানি বাড়ছে। তারা সঠিকভাবে মাঠে থাকতে পারছেন না। অনেক সময় দেখা গেছে, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় তাদের বাধা দেয়া হয়েছিল। কোথাও কোথাও বিএনপির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় অথবা তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় সরকারদলীয় প্রার্থীকেই বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সরকারি জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থীও মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যতটা না নির্দেশনা ছিল, স্থানীয় সরকারদলীয় প্রার্থী ও সমর্থকদের ভূমিকা ছিল তার চেয়ে বেশি। ফলে এ শংকা থাকলই যে, নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকছে না। নারী কাউন্সিলরদের প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও যা ঘটেছে, তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের জন্য প্রতীক রাখা হয়েছে চুড়ি, চকলেট, পুতুল, ফ্রক, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি। এটা কী ধরনের মানসিকতা? এ ধরনের প্রতীক মহিলাদের জন্য রেখে নির্বাচন কমিশন শুধু তাদের মূর্খতা ও অযোগ্যতাই প্রমাণ করল না, বরং এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই প্রমাণ রাখল। তারা যে কত অবিবেচক, এটা তারা আবারও প্রমাণ করল। সুতরাং অনেক ‘প্রশ্ন’ ও ‘সম্ভাবনা’কে সামনে রেখে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আজ নির্বাচন কমিশনারের জন্য সুযোগ এসেছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। নির্বাচনে অনিয়ম রোধ, স্থানীয় মাস্তানদের নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠে সমঅবস্থানের সুযোগ করে দেয়া, আচরণবিধি লংঘনের ব্যাপারে কঠোর হওয়া- নির্বাচন কমিশন এই কাজগুলো যদি নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে এ দেশে ‘নির্বাচনী সংস্কৃতি’র মৃত্যু ঘটবে! দায়টা তখন সরকারের চেয়েও নির্বাচন কমিশনের ওপর বেশি বর্তাবে। আমরা এক ‘অদৃশ্য অরাজনৈতিক সংস্কৃতি’তে আটকে আছি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যে বহুমত বিকশিত হয়, ব্যক্তি তার অধিকার নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করতে পারে, প্রশাসন সেখানে থাকে নিরপেক্ষ- এই সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এখানে বিলুপ্ত হচ্ছে! বহুমতকে এভাবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব বাড়ছে। যেনতেন প্রকারেই হোক, ক্ষমতা ধরে রাখাই হচ্ছে মুখ্য। আমরা যদি এ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। এ নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করতে পারি। কিন্তু তাতে করে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। মূলধারার রাজনীতিতে যদি বড় দলগুলো বাইরে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক জটিলতা বৃদ্ধি পায়। সংকটের মাত্রা বাড়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন এবং পরে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন (মেয়র ও কাউন্সিলর) একটা ‘সম্ভাবনা’ তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই ‘সম্ভাবনা’কেও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি অতি উৎসাহীদের অগণতান্ত্রিক আচরণের জন্য। বুথ কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে প্রকাশ্যে সিল মারা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া- এসব ঘটনার যে দৃশ্য জাতি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে দেখেছে, তা কোনো সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য ভালো খবর নয়। এখন শুধু বিএনপিই বলছে না, বরং সরকারের ‘মিত্র’ এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও অনেকটা হতাশার সুরে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র চর্চার কোনো সুযোগ নেই। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে দৃশ্য আমরা দেখেছি, সেই দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না। পৌর নির্বাচনে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হোক, এটা আমরা কেউই চাই না। পৌরসভা নির্বাচন সরকারের জন্যও একটা প্লাস পয়েন্ট। এ নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নিয়েছে- এতে ‘সব দলের অংশগ্রহণের’ যে সংস্কৃতি, তা নিশ্চিত করে সরকার তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে, সরকারি প্রভাব থাকলে সরকারের ভূমিকা দুর্বল হবে। বহির্বিশ্বে সরকারের ভূমিকা নিয়ে আরও ‘প্রশ্ন’ উঠবে। বিদেশী বন্ধুদের কাছে সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা আরও হারাবে। আমার ধারণা, প্রভাবমুক্ত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ভালো করবে। কেননা গত সাত বছরে সরকারের বেশ কিছু উন্নয়নের দাবিদার এখন সরকারি দলের প্রার্থীরা। এটাকে পুঁজি করে সরকারি দল সাধারণ ভোটারদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। এই নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় এবং তাতে যদি আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী হন, তাহলে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে। সরকার তার জনপ্রিয়তা যাচাই করে (যা পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিফলিত হবে) আবারও ৫ বছরের জন্য ম্যান্ডেট নিতে পারে। সে কারণে ২০১৭-এর প্রথম দিকে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনাকে আমি উড়িয়ে দিতে পারি না। সরকার তখন আগামী এক বছর ব্যাপক উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়ে, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করে এবং স্থিতিশীলতা বজায় রেখে, দুর্নীতি রোধ করে সরকারি দলের জন্য একটা ‘ক্ষেত্র’ সৃষ্টি করতে পারে। এটাকে পুঁজি করেই সরকারি দল নির্বাচনে যেতে পারে। এ কারণেই আমার বিবেচনায় পৌর নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে একটি ‘টেস্ট কেস’, যাতে সরকারি মনোভাব বোঝা যাবে। কিন্তু যদি নির্বাচনটি ভালো না হয়, যদি শেষ মুহূর্তে বিএনপি আবারও নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয়(!), তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে নতুন যে ‘মাত্রা’ যোগ হল, তা আমাদের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে না। আমাদের জন্য সেটা হবে দুঃখের কথা। নির্বাচনে বিএনপিকে রাখাই হবে সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনে হেরে গেলেও(!) সরকার পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রায় সাত বছর পর ‘নৌকা’ আর ‘ধানের শীষে’র মধ্যে ‘ভোটযুদ্ধ’ শুরু হতে যাচ্ছে। এই প্রথমবার ভোটাররা দলীয়ভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। ব্যক্তি এখানে মুখ্য হবে না। ফলে ভোটের এ রায় প্রমাণ করবে আওয়ামী লীগ তার জনপ্রিয়তা কতটুকু বাড়াতে পেরেছে কিংবা বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন কতটুকু আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দুটি বড় দলই হচ্ছে বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে বোধ করি আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। Daily Jugantor 11.12.15

0 comments:

Post a Comment