এ
কোন বাংলাদেশের ছবি আমরা দেখছি। গত ৩ এপ্রিল সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে
দুর্ঘটনার শিকার আন্তঃনগর তূর্ণা নিশীথার ছবি। দুর্বৃত্তরা রেললাইনের
ফিশপ্লেট উপড়ে ফেলায় দুর্ঘটনার শিকার হয় তূর্ণা নিশীথা। এ ঘটনার রেশ শেষ
হয়ে যাওয়ার আগেই পরদিন একই ঘটনা ঘটল বগুড়ায়। হরতাল সমর্থকরা রেললাইনের
প্যান্ডেল ক্লিপ খুলে ফেলে। এতে করে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারত, তা
হয়নি। কিন্তু দুষ্কৃতকারীদের টার্গেট কেন রেল? আর পুলিশ? মানবকণ্ঠ আমাদের
জানাচ্ছে গত পাঁচ মাসে রেলে ৯৮টি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। গত ২৮ ফেব্র“য়ারির পর
থেকে অর্থাৎ যেদিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে
মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় প্রদান করা হয়, সেদিনের পর থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত
রেলের ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি টাকা। আর রেল রাজস্ব হারিয়েছে ৫ কোটি টাকার।
রেলের সম্পদ তো কোনো দলের নয়, সরকারেরও নয়। এই সম্পদ রাষ্ট্রের। এই সম্পদের
যদি ক্ষতি হয়, সেই ক্ষতি তো রাষ্ট্রেরই। আমরা বারবার বলে আসছি সহিংসতা
কোনো রাজনৈতিক সমাধান বয়ে আনতে পারে না। বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট, তার
সমাধান করতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। এক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি
দূরদৃষ্টিতার পরিচয় দিতে না পারেন, তাহলে দেশটি একটি ‘গভীর অনিশ্চয়তার
অন্ধকারে’ পতিত হবে।
সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকেই অসন্তুষ্ট। এটা হতেই পারে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এই বৈরিতা থাকবেই। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই বৈরিতা রয়েছে। ভারতেও আছে, কিন্তু সহিংসতা কেন? কেন রেলের ফিশপ্লেট তুলে ফেলা হবে? যুগ যুগ ধরে রেল হচ্ছে সাধারণ মানুষের অন্যতম বাহন। ঢাকার বাইরের মানুষ অত্যন্ত কম ভাড়ায় রাজধানীতে আসতে পারেন অথবা অন্য স্থানে যেতে পারেন। এখন রেলই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে ক্ষতি তো সাধারণ মানুষেরই হবে। একটি অঞ্চলে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য রেল যোগাযোগ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাতে ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষের। রেলের বগিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে কিংবা ফিশপ্লেট তুলে ফেলে রেল যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ করলেও তাতে করে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না। যারা এই কাজগুলো করছে, হয়তো ক্ষোভে ও প্রতিবাদে করেছে, কিন্তু এটা অন্যায়। এটা অপরাধ। স্বাধীনতার ৪২ বছরে আমরা পা দিয়েছি। অতীতে কখনো এ রকমটি হয়নি। কখনো রেল এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেই সঙ্গে গেল দু’মাসে যে ১৭০ জন সাধারণ মানুষ মারা গেলেন, ৭ জন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন, বেশ কয়েকজন আহত হলেন, এটাও অনাকাক্সিক্ষত। কোথাও কোথাও পুলিশ সদস্যদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে। যে ১৭০ সাধারণ মানুষ মারা গেলেন, তাতে ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু সাধারণ একজন পুলিশ সদস্য তো এর জন্য দায়ী নন। তাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। হুকুম তামিল করতে হয়েছে। আমি তাদের দোষ দিতে পারি না। এখানে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের যে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়ার কথা তা তারা দিতে পারেননি। এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন সংবাদপত্র থেকেই জানলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে আবার আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। অপারেশনের পরেও তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। তিনি পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এই একটি ঘটনা প্রমাণ করে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিএনপি বড় দল। তাদের জনসভায় গুলি হবে কেন? কেনই বা মি. খানের মতো একজন সিনিয়র নেতা আহত হলেন? পুলিশ গুলি চালিয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্তটি এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যার নেতৃত্বে রয়েছেন।
দুটি মূল রাজনৈতিক ইস্যুতে রাজনীতি এখন আবর্তিত এবং সংকটকে ঘনীভূত করেছে। এর একটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ্বিতীয়টি কোন পদ্ধতিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হোক আমরা সেটা অবশ্যই চাই কিন্তু সেই বিচারটা যেন হয় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। এ ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু যখন বিশেষ আদালতে বিচার চলছে, তখন গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে এবং দিনের পর দিন আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘটনা প্রকারান্তরে বিচার বিভাগের ওপর এক ধরনের ‘চাপ’ সৃষ্টি করার শামিল। সরকার তাদের চাপের মুখে আইনে বেশকিছু পরিবর্তন আনতেও বাধ্য হয়েছে। এরপর আর গণজাগরণ মঞ্চের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি না। এর পরও রুমী ব্রিগেড গঠিত হয়েছে। গঠিত হয়েছে একটি নাগরিক সমাজ। এদের সবার দাবি একটিই-যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। এভাবে কোনো দোষী ব্যক্তিকে চাপের মুখে থেকে কী ফাঁসি দেয়া যায়? আইনকে তার পথে চলতে দেয়া উচিত। বিজ্ঞ বিচারপতিরাই সিদ্ধান্ত নেবেন। এ নিয়ে আর আন্দোলন না করাই মঙ্গল। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমরা জানতে পেরেছি ২৫ অক্টোবর বর্তমান সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। কিন্তু কার কাছে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ ফর্মুলা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে ‘সকল দলের অংশগ্রহণের’ যে নির্বাচন, তা নিশ্চিত করা যাবে না। অক্টোবরের আগেই এ ব্যাপারে সমঝোতা হতে হবে।
ইতিমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে আরো একটি ‘ফ্রন্ট’ তৈরি হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন ‘ইসলামবিরোধী ব্লগ এবং মহানবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) কটূক্তিকারীদের গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তির’ দাবিতে শুক্রবার লংমার্চ করে গতকাল শনিবার ঢাকায় গণজামায়াতে করেছে। হঠাৎ করেই রাজনীতির মঞ্চে এই সংগঠনটি আবির্ভূত হয়েছে এবং এর প্রধান যিনি, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নাম এদেশের মানুষ আগে অতটা জানত না।
সরকার যদিও বেশ কয়েক ব্লগারকে মহানবীকে (সা.) কটূক্তি করে লেখালেখির অভিযোগে গ্রেফতারও করেছে, কিন্তু এটা অনেক দেরি হয়ে গেছে। হেফাজত এর আগে যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছিল, ওই দাবিগুলোকে সরকার যদি ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে দেখত এবং একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে বা উপদেষ্টাকে আল্লামা শফীর সঙ্গে আলোচনার দায়িত্বটি দিত, তাহলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না। পরে ব্লগারদের গ্রেফতার করেও লংমার্চ ঠেকানো যায়নি। এমনকি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ২৫টি সামাজিক সংগঠন শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশে যে হরতাল ডেকেছে, সরকার এ ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিতে পারত। একদিকে হরতাল, অন্যদিকে লংমার্চ পরিস্থিতিকে যে একটি সংঘাতময় অবস্থার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ধারণা করা হচ্ছে এখন হরতাল আর নাশকতার বৃত্ত বন্দি হয়ে পড়বে জনজীবন যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিএনপি ও জামায়াত এই লংমার্চকে সমর্থন করেছে। এই কাজটি যে বিরোধী দল করবে, এটা তো খুব স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সরকারের স্ট্র্যাটেজির অনেক অভাব ছিল।
সরকার এখন একের পর এক অনেক ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করছে। সরকার পরিস্থিতিকে সামাল কীভাবে দেবে, সেটাই দেখার বিষয়। এখানে সরকারের ‘রিয়েল পলিটিকস’ বা বাস্তবমুখী পদক্ষেপের বড় অভাব। হেফাজতে ইসলামকে ‘জামায়াতের আরেকটি ফ্রন্ট’ কিংবা ‘জামায়াতের ফাঁদে হেফাজত পা দিয়েছে’ এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করা যায় বটে, কিন্তু মানুষের আস্থা অর্জন করা যাবে না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আছেন, যারা ইসলাম ধর্ম চর্চা করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিরোধী কথাবার্তা বলা ও নবী করিম (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করা ও ব্লগে এ নিয়ে লেখালেখি করা আর যাই হোক ইসলামপ্রিয় সাধারণ মানুষ এটা গ্রহণ করে নেবে না। সরকারের অনেক আগেই উচিত ছিল হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটা ‘ডায়ালগ’ ওপেন করা। এখন অভিযুক্ত ব্লগারদের গ্রেফতার করেও শেষ রক্ষা হলো না। শুধু তাই নয়, সরকার সমর্থক ২৫টি সংগঠনকে হরতাল পালন করার সুযোগ দিয়ে সরকার পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলল। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বাকি সংগঠনগুলো হরতাল ডাকতেই পারে। এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সমাবেশের পাশাপাশি হরতাল পালন উত্তেজনা আরো বাড়িয়েছে। স্পষ্টতই বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে রয়েছে বামমনা তথা ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মভিত্তিক শক্তি। মূল ধারা মূলত দুটি। এর বাইরে কোনো তৃতীয় ধারার অবস্থান নেই।
বাংলাদেশ এখন এক কঠিন সময় পার করছে। রাজনীতিকদের মাঝে অনাস্থা, অপর পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা, ক্ষমতা ধরে রাখা ও দীর্ঘস্থায়ী করার মানসিকতা স্বাধীনতার ৪২ বছরে এসে দেশকে এক গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। পুলিশকে পিটিয়ে জখম করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা যেমনি বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে রেলের মতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করার এক আত্মঘাতী প্রবণতা। শুভবুদ্ধির মানুষের অভাব যেমনি পরিলক্ষিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি একটি দায়িত্বশীল নেতৃত্বও আমরা দেখছি না। হরতালের পর হরতাল হচ্ছে। অর্থনীতিতে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে এসব কিছুর অবসান অত্যন্ত জরুরি। এই মুহূর্তে সরকার আর বিরোধী পক্ষ ও সেই সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য আরো খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। তাই প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক অথবা ত্রিপাক্ষিক একটি ‘সংলাপ’, যে ‘সংলাপ’-এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা সমাধান খুঁজে পাব ও উত্তেজনা হ্রাস হবে।
Manobkontho
07.04.13
সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকেই অসন্তুষ্ট। এটা হতেই পারে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এই বৈরিতা থাকবেই। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই বৈরিতা রয়েছে। ভারতেও আছে, কিন্তু সহিংসতা কেন? কেন রেলের ফিশপ্লেট তুলে ফেলা হবে? যুগ যুগ ধরে রেল হচ্ছে সাধারণ মানুষের অন্যতম বাহন। ঢাকার বাইরের মানুষ অত্যন্ত কম ভাড়ায় রাজধানীতে আসতে পারেন অথবা অন্য স্থানে যেতে পারেন। এখন রেলই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে ক্ষতি তো সাধারণ মানুষেরই হবে। একটি অঞ্চলে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য রেল যোগাযোগ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাতে ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষের। রেলের বগিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে কিংবা ফিশপ্লেট তুলে ফেলে রেল যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ করলেও তাতে করে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না। যারা এই কাজগুলো করছে, হয়তো ক্ষোভে ও প্রতিবাদে করেছে, কিন্তু এটা অন্যায়। এটা অপরাধ। স্বাধীনতার ৪২ বছরে আমরা পা দিয়েছি। অতীতে কখনো এ রকমটি হয়নি। কখনো রেল এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেই সঙ্গে গেল দু’মাসে যে ১৭০ জন সাধারণ মানুষ মারা গেলেন, ৭ জন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন, বেশ কয়েকজন আহত হলেন, এটাও অনাকাক্সিক্ষত। কোথাও কোথাও পুলিশ সদস্যদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে। যে ১৭০ সাধারণ মানুষ মারা গেলেন, তাতে ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু সাধারণ একজন পুলিশ সদস্য তো এর জন্য দায়ী নন। তাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। হুকুম তামিল করতে হয়েছে। আমি তাদের দোষ দিতে পারি না। এখানে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের যে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়ার কথা তা তারা দিতে পারেননি। এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন সংবাদপত্র থেকেই জানলাম বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে আবার আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। অপারেশনের পরেও তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছে না। তিনি পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এই একটি ঘটনা প্রমাণ করে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিএনপি বড় দল। তাদের জনসভায় গুলি হবে কেন? কেনই বা মি. খানের মতো একজন সিনিয়র নেতা আহত হলেন? পুলিশ গুলি চালিয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্তটি এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যার নেতৃত্বে রয়েছেন।
দুটি মূল রাজনৈতিক ইস্যুতে রাজনীতি এখন আবর্তিত এবং সংকটকে ঘনীভূত করেছে। এর একটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ্বিতীয়টি কোন পদ্ধতিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হোক আমরা সেটা অবশ্যই চাই কিন্তু সেই বিচারটা যেন হয় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। এ ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু যখন বিশেষ আদালতে বিচার চলছে, তখন গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে এবং দিনের পর দিন আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘটনা প্রকারান্তরে বিচার বিভাগের ওপর এক ধরনের ‘চাপ’ সৃষ্টি করার শামিল। সরকার তাদের চাপের মুখে আইনে বেশকিছু পরিবর্তন আনতেও বাধ্য হয়েছে। এরপর আর গণজাগরণ মঞ্চের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি না। এর পরও রুমী ব্রিগেড গঠিত হয়েছে। গঠিত হয়েছে একটি নাগরিক সমাজ। এদের সবার দাবি একটিই-যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি। এভাবে কোনো দোষী ব্যক্তিকে চাপের মুখে থেকে কী ফাঁসি দেয়া যায়? আইনকে তার পথে চলতে দেয়া উচিত। বিজ্ঞ বিচারপতিরাই সিদ্ধান্ত নেবেন। এ নিয়ে আর আন্দোলন না করাই মঙ্গল। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আমরা জানতে পেরেছি ২৫ অক্টোবর বর্তমান সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। কিন্তু কার কাছে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ ফর্মুলা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে ‘সকল দলের অংশগ্রহণের’ যে নির্বাচন, তা নিশ্চিত করা যাবে না। অক্টোবরের আগেই এ ব্যাপারে সমঝোতা হতে হবে।
ইতিমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে আরো একটি ‘ফ্রন্ট’ তৈরি হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন ‘ইসলামবিরোধী ব্লগ এবং মহানবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) কটূক্তিকারীদের গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তির’ দাবিতে শুক্রবার লংমার্চ করে গতকাল শনিবার ঢাকায় গণজামায়াতে করেছে। হঠাৎ করেই রাজনীতির মঞ্চে এই সংগঠনটি আবির্ভূত হয়েছে এবং এর প্রধান যিনি, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নাম এদেশের মানুষ আগে অতটা জানত না।
সরকার যদিও বেশ কয়েক ব্লগারকে মহানবীকে (সা.) কটূক্তি করে লেখালেখির অভিযোগে গ্রেফতারও করেছে, কিন্তু এটা অনেক দেরি হয়ে গেছে। হেফাজত এর আগে যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছিল, ওই দাবিগুলোকে সরকার যদি ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে দেখত এবং একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে বা উপদেষ্টাকে আল্লামা শফীর সঙ্গে আলোচনার দায়িত্বটি দিত, তাহলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না। পরে ব্লগারদের গ্রেফতার করেও লংমার্চ ঠেকানো যায়নি। এমনকি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ২৫টি সামাজিক সংগঠন শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশে যে হরতাল ডেকেছে, সরকার এ ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিতে পারত। একদিকে হরতাল, অন্যদিকে লংমার্চ পরিস্থিতিকে যে একটি সংঘাতময় অবস্থার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ধারণা করা হচ্ছে এখন হরতাল আর নাশকতার বৃত্ত বন্দি হয়ে পড়বে জনজীবন যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিএনপি ও জামায়াত এই লংমার্চকে সমর্থন করেছে। এই কাজটি যে বিরোধী দল করবে, এটা তো খুব স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সরকারের স্ট্র্যাটেজির অনেক অভাব ছিল।
সরকার এখন একের পর এক অনেক ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করছে। সরকার পরিস্থিতিকে সামাল কীভাবে দেবে, সেটাই দেখার বিষয়। এখানে সরকারের ‘রিয়েল পলিটিকস’ বা বাস্তবমুখী পদক্ষেপের বড় অভাব। হেফাজতে ইসলামকে ‘জামায়াতের আরেকটি ফ্রন্ট’ কিংবা ‘জামায়াতের ফাঁদে হেফাজত পা দিয়েছে’ এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করা যায় বটে, কিন্তু মানুষের আস্থা অর্জন করা যাবে না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আছেন, যারা ইসলাম ধর্ম চর্চা করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিরোধী কথাবার্তা বলা ও নবী করিম (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করা ও ব্লগে এ নিয়ে লেখালেখি করা আর যাই হোক ইসলামপ্রিয় সাধারণ মানুষ এটা গ্রহণ করে নেবে না। সরকারের অনেক আগেই উচিত ছিল হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটা ‘ডায়ালগ’ ওপেন করা। এখন অভিযুক্ত ব্লগারদের গ্রেফতার করেও শেষ রক্ষা হলো না। শুধু তাই নয়, সরকার সমর্থক ২৫টি সংগঠনকে হরতাল পালন করার সুযোগ দিয়ে সরকার পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলল। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বাকি সংগঠনগুলো হরতাল ডাকতেই পারে। এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সমাবেশের পাশাপাশি হরতাল পালন উত্তেজনা আরো বাড়িয়েছে। স্পষ্টতই বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে রয়েছে বামমনা তথা ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা, অন্যদিকে রয়েছে ধর্মভিত্তিক শক্তি। মূল ধারা মূলত দুটি। এর বাইরে কোনো তৃতীয় ধারার অবস্থান নেই।
বাংলাদেশ এখন এক কঠিন সময় পার করছে। রাজনীতিকদের মাঝে অনাস্থা, অপর পক্ষকে সহ্য না করার মানসিকতা, ক্ষমতা ধরে রাখা ও দীর্ঘস্থায়ী করার মানসিকতা স্বাধীনতার ৪২ বছরে এসে দেশকে এক গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে। পুলিশকে পিটিয়ে জখম করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা যেমনি বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে রেলের মতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করার এক আত্মঘাতী প্রবণতা। শুভবুদ্ধির মানুষের অভাব যেমনি পরিলক্ষিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি একটি দায়িত্বশীল নেতৃত্বও আমরা দেখছি না। হরতালের পর হরতাল হচ্ছে। অর্থনীতিতে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে এসব কিছুর অবসান অত্যন্ত জরুরি। এই মুহূর্তে সরকার আর বিরোধী পক্ষ ও সেই সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য আরো খারাপ খবর অপেক্ষা করছে। তাই প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক অথবা ত্রিপাক্ষিক একটি ‘সংলাপ’, যে ‘সংলাপ’-এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা সমাধান খুঁজে পাব ও উত্তেজনা হ্রাস হবে।
Manobkontho
07.04.13
0 comments:
Post a Comment