গেল সপ্তাহে সারা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করল তিনটি ঘটনা। লংমার্চ করতে না পারলেও ঢাকায় বিশাল জমায়েত করল হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন। আর এই জমায়েত তথা লংমার্চকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। যদিও তাতে খুব একটা সফল তারা হয়নি। আর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিসহ ২৭টি সাংস্কৃতিক সগঠন হরতাল পালন করল ২৪ ঘণ্টা, ৫ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত। মানুষ প্রত্যক্ষ করল, ছুটির দিনে এবং রাতেও হরতাল হয়। হরতালে গাড়ি-ঘোড়া চলেনি, মানুষ ঘরেই ছিল। বড় ধরনের সহিংসতা হতে পারে- এটা ধারণা করে মানুষ ঘরের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল। এ তিনটি ঘটিনা পরস্পরবিরোধী। এক দল চাচ্ছে লংমার্চ। অন্য দল চাচ্ছে তাদের প্রতিহত করতে। এখন ফলাফল কী? আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব ৬ এপ্রিলের গণজমায়েতকে? এ লংমার্চ কি চলমান রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারবে? পারলে কতটুকু পারবে? প্রথমত, বলতেই হবে, লংমার্চ সফল হয়েছে। শত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার পরও মানুষ হেঁটে শাপলা চত্বরে পৌঁছেছে। আশপাশের এলাকা জনারণ্যে পরিণত হয়েছিল। এই সমাবেশ প্রমাণ করল, হেফাজতে ইসলাম একটি শক্তি। সরকার এই শক্তিকে ব্যবহারও করতে পারে! আবার এই শক্তি সরকারের বিরুদ্ধেও চলে যেতে পারে। এখন তারা সরকারের বিরুদ্ধেই গেল। দ্বিতীয়ত, এই লংমার্চকে সরকার খুব সহজেই এড়িয়ে যেতে পারত। আল্লামা শফীর সঙ্গে আলোচনায় একজন সিনিয়র নেতা বা উপদেষ্টাকে পাঠানো উচিত ছিল। বনমন্ত্রীকে পাঠিয়ে হেফাজতে ইসলামকে কম গুরুত্ব দিয়েছিল সরকার। ফলাফল তারা পেয়েছে। তৃতীয়ত, হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক হিসেবে ঘোষণা করলেও ঘটনাচক্রে তারা একটি শক্তি, তৃতীয় শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে তারা কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এটা সত্য। কিন্তু যাঁরা ক্ষমতায় যেতে চান, তাঁরা চেষ্টা করবেন এই শক্তিকে নিজের হাতে রাখতে। এ ক্ষেত্রে বলতেই হবে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের পাল্লা ভারী। চতুর্থত, হেফাজতে ইসলাম বারবার বলে আসছে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধী নয়। তারা জামায়াতের রাজনীতিরও বিরোধিতা করে। কালের কণ্ঠের সঙ্গে আল্লামা শফীর সাক্ষাৎকারে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে তাঁরা জামায়াতের রাজনীতিকে সমর্থন করেন না। সরকারের কাছে একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তাদের জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার। সরকারের ব্যর্থতা এখানেই যে তারা এই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারল না। পঞ্চমত, গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাদানিকসহ ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা চূড়ান্ত বিচারে সরকারের পক্ষে যায়নি। সরকার তাদের মাঠে নামিয়েছে- এ সত্যই শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হলো। এ ক্ষেত্রে এ দুই পক্ষকে হেফাজতে ইসলামীর বিপক্ষে দাঁড় করানো সঠিক হয়নি। এই সিদ্ধান্ত সরকারের অবস্থান দুর্বল করেছে। ষষ্ঠত, হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে কিংবা পাল্টা হরতাল পালনকারীদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। এটাও চোখে লাগার মতো। সহিংস ঘটনাবলির মধ্য দিয়েই সাধারণত হরতাল শেষ হয়। গাড়িতে আগুন লাগে, পুলিশ গুলিবর্ষণ করে, ককটেল ফোটে- এ হচ্ছে সাম্প্রতিককালের হরতালের চালচিত্র। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে এ রকমটি ঘটেনি। সরকার তাদের জমায়েত করার অনুমতি দিয়ে ভালো কাজ করেছিল। এর পরও চট্টগ্রাম থেকে বাসের কাফেলা আসতে দিলে কিংবা ফেরি চলাচল উন্মুক্ত করে দিলে তাতে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ত বৈ কমত না। সপ্তমত, রাসুলে করিম (সা.)কে নিয়ে ব্লগে যারা কটূক্তি করেছিল, তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে সরকার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, সরকারের এই ইতিবাচক দিকটি হেফাজতের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি। অষ্টমত, সরকার অতিমাত্রায় বামমনা এবং একই সঙ্গে নাস্তিকদের দ্বারা চালিত হচ্ছে, এ ধরনের অভিযোগ কাটিয়ে ওঠার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা সরকার নেয়নি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের এটা একটা বড় ব্যর্থতা যে তাঁরা সাধারণ মানুষের 'পালস' বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। নবমত, একটা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তারুণ্যের প্রতিবাদ হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়েছিল। দীর্ঘস্থায়ী এর প্রয়োজন নেই। গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করলে সরকার তার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে পারত। কিন্তু সরকার তা করেনি, উদ্যোগও নেয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। দু-একজনের চূড়ান্ত রায় আমরা প্রত্যাশা করছি খুব শিগগির। এমনই এক পরিস্থিতিতে গণজাগরণ মঞ্চ যদি আবার সক্রিয় হয়, তাতে বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ আরো শক্তিশালী হবে। দশমত, হেফাজতে ইসলাম জামায়াতের 'সেকেন্ড ফ্রন্ট'- এই অভিযোগ তুলে হাজার হাজার তরুণকে সরকারবিরোধী অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হলো। কারণ হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটি তরুণ প্রজন্ম রয়েছে, যারা আবার জামায়াত-শিবির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
এখন যে প্রশ্নটি আমাকে অনেকেই করেছেন, তা হচ্ছে এরপর কী? লংমার্চ হলো। ৮ এপ্রিল হরতালও হলো। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অনেক দেরিতে কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপলব্ধি করলেন! হেফাজতে ইসলামকে 'আন্ডারমাইন' করেছিল সরকার। এখন সরকারের এই উপলব্ধি একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করল। সরকারকে এখন সংলাপে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। অনেক আগেই উচিত ছিল জনাব চৌধুরীকে ব্যবহার করা। জনাব চৌধুরীর সঙ্গে আল্লামা শফীর ব্যক্তিগত 'সখ্য' সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের মধ্যকার সম্পর্কের বরফ গলাতে সাহায্য করতে পারে। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার অনেকগুলো নিয়েই সরকার কথা বলতে পারে। ১ নম্বর দাবিতে সংবিধানে 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করার যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সে ব্যাপারটি সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিতে পারে। এ দাবি অনেকেরই। সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির (এরশাদ) দাবিও এটি। সরকার প্রয়োজনে এ ব্যাপারে একটি কমিটি গঠন করে দিতে পারে। সংশোধিত সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' বজায় রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। আবার অষ্টম অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখা এবং সেই সঙ্গে প্রস্তাবনায় 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' থাকার কারণে সরকার খুব সংগত কারণেই সংবিধানে 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' শব্দটি পুনঃস্থাপন করতে পারে। ২ নম্বর দফায় আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়েছে। সরকার তো ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। ৩ নম্বর দফায় কুৎসা রটনাকারী ব্লগারদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। সরকার তো ইতিমধ্যে কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেপ্তারও করেছে। ৯ নম্বর দফায় টিভিতে ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধের দাবি করা হয়েছে। এটা মনিটর করা কঠিন কিছু নয়। ১৩ নম্বর দফায় গ্রেপ্তারকৃত মাদ্রাসাছাত্রদের মুক্তি দাবি করা হয়েছে। এটাও সরকার করতে পারে। ১১ নম্বর দফায় আলেম-ওলামাদের ওপর হামলা বন্ধের দাবি রয়েছে। ৮ নম্বর দফায় বায়তুল মোকাররমে মুসলি্লদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করার দাবিও রয়েছে। এগুলো মানা সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। তবে ৪ নম্বর দফায় 'নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ' বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক আরবদেশে (মিসর ও তিউনিসিয়া) নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকাও ব্যাপক। হেফাজতে ইসলামের নেতারা নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন। ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে (৭ নম্বর), তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অনেক ইসলামী রাষ্ট্রেও ভাস্কর্য রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি এনজিওদের কর্মকাণ্ড বন্ধের যে দাবি (১০ নম্বর) করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও সরকার উদ্যোগী হয়ে বিষয়টি মনিটর করে দেখতে পারে। মোট কথা, ১৩ দফায় বেশ কিছু দাবি রয়েছে, যা সরকার ইতিমধ্যেই বাস্তবায়ন করেছে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়নের পথে। আল্লামা শফীর সঙ্গে আলোচনায় সরকারের অবস্থানকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আলোচকদের ব্যর্থতা সেখানেই। একই সঙ্গে হেফাজতে ইসলামকে জামায়াতের সঙ্গে তুলনা করে সরকারের মন্ত্রীরা আগে থেকেই এই সংগঠনকে 'শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, এটা ছিল ভুল।
৬ এপ্রিলের গণজমায়েতের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইসলামী গণজাগরণের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। তারা প্রমাণ করেছে, তাদের গ্রহণযোগ্যতায় নিতে হবে। সরকারের উচিত হবে না আরেকটি 'ফ্রন্ট' ওপেন করা। এখন একটি 'সংলাপ'ই পারে সব ধরনের বিভ্রান্তি দূর করতে এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে যেতে। ৬ এপ্রিলের পরও যদি সরকার গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাদানিককে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সরকার আবারও 'ভুল' করবে।Daily Kalerkontho10.04.13
0 comments:
Post a Comment