রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জনগণ কখনও ভুল করেনি করবে না


স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এ কোন বাংলাদেশকে আমরা দেখছি? সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১২তে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুমের ভয়াবহ খবর তুলে ধরা হয়েছে। দুর্নীতিতে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এই সরকার। গত ২১ এপ্রিলের একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকে বিশ্বব্যাংকের সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়েছে পদ্মা সেতুতে শতকরা ১২ ভাগ ঘুষ হিসেবে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কানাডীয় একটি কোম্পানি এসএনসি লাভালিন পদ্মা সেতুর কাজ পাবার জন্য শতকরা ১২ ভাগ টাকা সরকারের ৫ ব্যক্তিকে ঘুষ হিসেবে দিতে রাজি হয়েছিল। পত্রিকার খবর অনুযায়ী এই ১২ ভাগের মধ্যে ২ ভাগ পাবার কথা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের পাবার কথা ৪ ভাগ। আবুল হাসান চৌধুরী লাভালিনের কর্মকর্তাদেরকে সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ঘুষের ২ ভাগ পাবার কথা নিক্সন চৌধুরীর, যিনি প্রধানমন্ত্রীর ফুফাত ভাই’র ছেলে এবং হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ছোট ভাই। অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের পাবার কথা ১ ভাগ, সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার পাবার কথা ১ ভাগ। আরও ২ ভাগ পাবার কথা এমন এক ব্যক্তির যার কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিশ্বব্যাংক লাভালিনের সাবেক কর্মকর্তা রমেশ শাহ’র ডায়রিতে এ নামগুলো পেয়েছে। যদিও সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বারবার দুর্নীতি তথা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি বলে জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক আবুল হোসেন ও মশিউর রহমানের ব্যাপারে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করলেও দুদক যে মামলা করেছে তাতে তাদের আসামি করা হয়নি। বলা ভালো কানাডার অন্টারিওর সুপিরিয়ার কোর্ট অব জাস্টিস -এ লাভালিনের ঘুষ-দুর্নীতির মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ২১ মে পরবর্তী বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। দৈনিক প্রথম আলো যেদিন এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সেদিন অপর একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১২। উক্ত প্রতিবেদনে গুম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য, দুর্বল কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার, বিচার বহির্ভূত হত্যা, অপহরণ এবং দুর্নীতিকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য ঘটনার মধ্যে গণগ্রেফতার, আটক ও পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে দুর্বল বিচারব্যবস্থা এবং বিচারপূর্ব দীর্ঘ কারাবাসকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকার বাকস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার সীমিত করারও নির্দেশ দিয়েছে।
সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক সহিংসতা ও অব্যাহত দুর্নীতি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির যারা কিছুটা খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন এই প্রতিবেদনে মিথ্যা কিছু বলা হয়নি। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা, জামিন দিতে অস্বীকৃতি, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার, ‘শিবির দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ ইত্যাদি ঘটনাবলী প্রমাণ করে দেশ আজ এক চরম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কী এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? একজন সম্পাদককে আজ তার অধিকারের জন্য অনশন ধর্মঘট পালন করতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৭১ সালে নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশকে চাননি। পরিস্থিতি আজ এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, ১৮ দলকে বারবার হরতাল দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি আজ বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। সিপিডি অর্থনীতিতে অশনি সঙ্কেতের কথা বলেছে। বিদেশী পোশাক আমদানিকারকরা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা নতুন বাজার পেয়েছেন ভিয়েতনাম আর লাওস-এ। মিয়ানমার ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাওয়ায় মার্কিনীদের একটা বড় বাজার হতে যাচ্ছে মিয়ানমারে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু মার্কিন কোম্পানি মিয়ানমারে তাদের অফিস খুলেছে। সেখানে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও বাড়ছে। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এটা তো সত্য সরকারের রাজনৈতিক ‘দস্যুতার’ কারণে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এডিবি তাদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ বলা হয়েছিল প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এখন সেটা কল্পনাতেই থেকে গেল। বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। প্রায় ষোল কোটি মানুষের এই দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটি। প্রতিবছরই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। এদেরকে যদি সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ দেয়া যেতো, তাহলে এরা অর্থনীতিতে একটা বড় অবদান রাখতে পারতো। যেখানে ইউরোপে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমছে, সেখানে আমাদের বাড়ছে। চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চীনে বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, তারা উৎপাদনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না।
এই বয়ষ্ক নাগরিকদের পেনশনসহ সামাজিক নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের যে অবস্থান (বর্তমানে দ্বিতীয়) তা আগামী কয়েক দশক পর চীন আর তা ধরে রাখতে পারবে না। এক সময় BRIC দেশগুলো অন্যতম একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা BRIC-এ যোগ দেয়ায় এই জোট শক্তিশালী হয়েছিল, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গোল্ডম্যান ম্যাকস এর অর্থনীতিবিদ জিম ও’ নীল এর মতে (যিনি ২০০১ সালে ব্রিকস এর উত্থান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন) BRICS আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই দুর্বল একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। তার যুক্তি, ‘Economic growth in Russia & China would be hampered by shrinlling working age population, so India and Brazil would be placed with countries that boat growing economics and populations’। তিনি মিথ্যা বলেননি। জিম ও’ নীল নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট MIKT-এর কথা বলেছেন, আর জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যাক প্লোডস্টোন বলেছেন, অপর একটি জোট TIMBI’র কথা। বাংলাদেশের বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত শ্রেণীর উত্থান বাংলাদেশকে আগামী দশকে MIKT অথবা TIMBI জোটে নিয়ে যেতে পারতো। বলা ভালো প্রতিটি দেশের প্রথম অক্ষর নিয়ে নতুন জোটকে পরিচিত করান হচ্ছে, অনেকটা BRIC-এর মতো। যেমন MIKTতে রয়েছে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক। আর TIMBI জোটে রয়েছে তুরস্ক, ভারত, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এসব দেশের প্রতিটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। ভারতে দারিদ্র্যতা থাকলেও (২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক ২ ভাগ লোক দরিদ্র), বিশ্বব্যাংকের মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ (২০০৭ সালে মাত্র ২ ভাগ)। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। তুরস্কের প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের উপরে। ইউরোপে যেখানে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে, সেখানে তুরস্কের অর্থনীতিতে তা এতটুকু প্রভাব ফেলেনি। ভারত ও তুরস্ক এটা করতে পেরেছে। কারণ সেখানে রয়েছে বিপুল শিক্ষিত এক জনগোষ্ঠী। রয়েছে রাজনৈতিক সহনশীলতা। আমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারতাম, আমরাও ভারত ও তুরস্কের কাতারে নিজেদের নিয়ে যেতে পারতাম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এখন আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান।
কিন্তু সরকারের ‘চাপাবাজি’ এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কিছু ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার জন্য। সংবাদপত্রে হলমার্ক কেলেঙ্কারি বা বিসমিল্লাহ গ্রুপ-এর কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হলেও ‘পর্দার অন্তরালে’ ক্ষমতাবান লোকদের গ্রেফতার করা হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে সরকারি সোনালী ব্যাংক এখন দেউলিয়া হয়ে যাবার উপক্রম। বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে যেখানে নিয়ে গেছেন, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন চার বছর। এই মূল্যায়ন গবেষণা সংস্থা সিপিডির। সিপিডির মতে টানা কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ মন্দা চলছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের জটিলতার মধ্যে আছে। সিপিডির গবেষণা কর্মকে ফেলে দেয়া যাবে না।
এখন পরিস্থিতি আমাদের যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক National Intelligence Council (NIC) ২০১২ সালের যে Global trends রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১৫টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় এশিয়ার যে ৩টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মাঝে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। অপর দু’টি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। যুক্তি হিসেবে ঘওঈ উল্লেখ করেছে সংঘাতময় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আমরা কোনোভাবে মেলাতে পারবো না, এটা সত্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৭০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, বিরোধীদলেংুর নেতাদের উপর গুলিবর্ষণ, তাদের আহত করা ও গ্রেফতার, গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জনতার প্রতিবাদ প্রমাণ করে সরকার দমন পীড়নের আশ্রয় নিলেও তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে আসছে। সরকারের ‘বিদায়’ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইতিহাস থেকে এই সরকার কিছু শেখেনি। জোর করে ক্ষমতায় থাকার কোনো ইতিহাস নেই। জনগণ কোনো ভুল করেনি। আগামীতেও করবে না।
26.04.13

0 comments:

Post a Comment