রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি সুপারিশ ও কিছু প্রশ্ন


প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় একটি সুপারিশ করা হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল। সংসদীয় এই কমিটি তাগিদ দিয়েছে, সংলাপের মাধ্যমে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংঘাতের গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে। একই সঙ্গে যেকোনো উপায়ে যাতে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চালু থাকে, সেদিকে নজর রাখার কথাও তারা বলেছে। ১৫ এপ্রিলের এই সভাটি ছিল স্থায়ী কমিটির ২২তম সভা। সশস্ত্র বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান) তিন প্রধানও ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে শপথ অনুযায়ী কাজ করবেন বলে কমিটিকে জানিয়েছেন- এ-সংক্রান্ত খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। একাধিক কারণে ১৫ এপ্রিলের সভাটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, দেশের চলমান সংকটের গভীরতা বাড়ছে। বিভিন্ন মহল থেকে একটি সংলাপের কথা বলা হলেও তার জট খুলছে না। এমনি একটি সময়ে ওই সুপারিশটি এলো। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটি ন্যস্ত। এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্বটি বর্তায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তৃতীয়ত, তিন বাহিনীর প্রধানের সভায় উপস্থিতি এবং প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধির সভায় উপস্থিতি এই সভার গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন এইচ এম এরশাদ, যিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেলও বটে। চতুর্থত, এর আগে সেনাবাহিনী নিয়ে প্রথমে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রী একটি মন্তব্য করেছিলেন। এ ধরনের মন্তব্যের পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠক ও সেখানে উপস্থিত তিন বাহিনীর প্রধানের 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা ও শপথ'-এর অঙ্গীকার চলমান রাজনীতিকে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির এই সভা একটি 'মেসেজ' পৌঁছে দিয়েছে। আর তা হচ্ছে, সংঘাত এড়াতে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু আদৌ কি সংলাপ হবে? সংলাপ হলে 'এজেন্ডা' কী? একই সঙ্গে প্রশ্ন আরো আছে- হেফাজতে ইসলাম অন্যতম 'শক্তি' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এখন সরকার কী তাদের সঙ্গেও সংলাপ করবে? রাজনীতিতে মূল 'স্টেকহোল্ডার' সরকার ও বিরোধী দল। আর এজেন্ডা একটিই- সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এমন একটি পদ্ধতি বের করা, যাতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। সরকার সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে রেখে আগামী নির্বাচনের কথা বলছে। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা সংবিধান এভাবেই সংশোধিত হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে থেকে যান, এতে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হতে পারে। গেল চার বছরে প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে 'দলীয় আনুগত্য' প্রদর্শন করেছেন, তাতে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী'নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্র্যাডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরো একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই (তিন মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ- নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের রেখেই নির্বাচন হবে। এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার'-এর ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। টিআইবি একটি ফর্মুলা দিয়েছে; যদিও তাদের ফর্মুলায় বেশ ত্রুটি রয়েছে। টিআইবি অনেকটা দায়সারা গোছের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে তাদের আরো 'কাজ' করার সুযোগ ছিল। বিএনপি এখনো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে, যা এখন আর সংবিধান অনুমোদন করে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হতে পারে। তারা তাদের 'থিংক ট্যাংকে'র মাধ্যমেও একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করতে পারে, যাতে একটা সংলাপ শুরু করা যায়। সরকার যে 'গোঁ' ধরে রেখেছে, তা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এমনকি সরকারের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক যেভাবে আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শন করছেন, তাতে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। সরকার যদি তার একক সিদ্ধান্তে এককভাবে নির্বাচন করে, সেটাও তার জন্য সুখের হবে না। আমাদের দেশে এককভাবে নির্বাচন করার কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও শুধু বিএনপির অংশ না নেওয়ার কারণে সেই সংসদ পাঁচ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেওয়ায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশ পুনরায় একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে কি না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে, সরকারের দায়দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি 'গোঁ' ধরে থাকে, তাতে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তোফায়েল আহমেদের মতো সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও মনে করছেন, আদৌ সংলাপ হবে না! কেননা কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে তা-ই মনে হওয়া স্বাভাবিক। 'কিছু না হলেও' সংলাপ করতে হবে এবং সংলাপের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সবাই যদি জেলে থাকেন, তাহলে সংলাপ যে হবে না, তা বলাই বাহুল্য। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকেও কিছু ছাড় দিতে হবে। 'সব কিছু ভুলে' জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে মুক্ত মন নিয়ে বিএনপিকেও এগিয়ে আসতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সিপিডি, টিআইবি এবং সর্বশেষ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ প্রমাণ করে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান চান সবাই। একটি বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। অতীত ভুলে সামনে তাকানো খুবই জরুরি। রাজনীতিতে এরই মধ্যে আবির্ভূত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, হেফাজত মূলত জামায়াতে ইসলামীরই সৃষ্টি। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমি বলতে পারব না। কিন্তু কালের কণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হেফাজতের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফী যখন বলেন, তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই, তখন এই আন্দোলনকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। ঢাকায় যে বিশাল সমাবেশ তারা করেছে, তা নিঃসন্দেহে ১৮ দলীয় জোট ও সরকারের মধ্যে চিন্তার কারণ। জামায়াত বা ১৮ দলীয় জোট এই আন্দোলন থেকে ফায়দা ওঠাতে পারে। সরকারের দায়িত্বটি এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি। হেফাজতে ইসলাম মূলত একটি ধর্মীয় সংগঠন। ইসলাম ও আকিদা নিয়েই এদের কর্মকাণ্ড। এরা ১৩ দফা দিয়েছে। ওই ১৩ দফার মধ্যে কোথাও 'ব্লাসফেমি' শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, এই ১৩ দফাটিই হচ্ছে 'ব্লাসফেমি'। একুশ শতকে এসে 'ব্লাসফেমি' আইন যে করা যায় না কিংবা পাকিস্তানের মতো দেশে যেখানে 'ব্লাসফেমি' আইনের অপব্যবহার হয়েছে, সেখানে এই মেসেজটি হেফাজতের নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। তবে ১ নম্বর ধারা (আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন) কিংবা ১২ ও ১৩ নম্বর ধারা (কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের মুক্তি) নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে আলোচনা করা যায়। সরকারের উচিত হবে না আরেকটি 'ফ্রন্ট' ওপেন করার।
রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বাড়ছে সংঘাত। এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংলাপের সুপারিশ সংলাপের জন্য একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। মূল বিষয় একটি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? তবে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে যেকোনো নামেই হোক না কেন, বিএনপি তা মেনে নেবে। তাই আলোচনাটা জরুরি। আর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই।Daily Kalerkontho21.4.13

0 comments:

Post a Comment