গতকাল বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ শপথ গ্রহণ করার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি হামিদ কি জাতির অভিভাবক হতে পারবেন? সবার প্রত্যাশা ছিল মহাজোট সরকার এমন কোন নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করবেন, যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। আবদুল হামিদ নির্দলীয় ব্যক্তি নন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সেই ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি কখনও দলত্যাগ করেননি, এমনকি তথাকথিত ‘এক-এগারো’র সময়ও তিনি সংস্কারবাদীর খাতায় নিজের নাম লেখাননি। একজন বিজ্ঞ ও সৎ রাজনীতিক হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসিন হলেন।
রাষ্ট্রপতির এ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যদি জোটের শরিক দল ও বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করা বা তাদের মতামত নেয়া হতো, তাহলে সেটা শোভন হতো। ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির নেতা এইচএম এরশাদ তার উষ্মা ঢেকে রাখতে পারেননি। আর বিএনপির মতামত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তবে আমার ধারণা, আবদুল হামিদের ব্যাপারে বিএনপির ‘না’ থাকার কথা নয়। কারণ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা যে ভাষায় বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলেন, আবদুল হামিদ সে ভাষায় অতীতে কখনও কথা বলেননি। সংসদে বিএনপির উপস্থিতি ছিল কম। তবুও তিনি বারবার চেষ্টা করে গেছেন বিএনপিকে সংসদে নিয়ে আসতে। কিন্তু পারেননি, এটা সত্য। স্পিকার হিসেবে মাঝেমধ্যে সংসদ ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখতে ব্যর্থ হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ব্যাপারে তিনি বারবার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে গেছেন। যতদূর জানি, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভালো। এখন এক কঠিন সময়ে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বটি গ্রহণ করলেন। তিনি কি পারবেন ‘সনাতন আওয়ামী রাজনীতির মানসিকতা’ থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপির ব্যাপারে একটি ‘নমনীয় মনোভাব’ গ্রহণ করতে? একজন ‘রাজনৈতিক ব্যক্তি’ যখন রাষ্ট্রপতি হন, তখন তার পক্ষে পারাটা কঠিন। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী পারেননি। তার নিজ দলই তাকে অভিশংসনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে একজন ‘পুরাদস্তুর আওয়ামী লীগার’ আবদুল হামিদ পারবেন, তা মনে করারও কোন কারণ নেই। তবে এ কথাটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত।
আমাদের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে রাষ্ট্রপতির কোন ক্ষমতা নেই। ৪৮(৩) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, তার মূল কাজ মূলত দুটি : ক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ (সংসদে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিদের নেতা) ও খ. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। এর বাইরে তিনি যেসব কাজ করবেন, তা ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ’ অনুযায়ীই করবেন। এবং দায়িত্ব নেয়ার দিন থেকে (অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল ২০১৩ থেকে) তিনি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। সাবেক সিনিয়র আমলা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের ভাষায় ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একজন সচিবালয়ের সেকশন অফিসারের চেয়েও কম।’ তিনি খুব একটা মিথ্যা বলেননি। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘কবর জেয়ারতে’র কথাটা নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকার কথা। এখন আবদুল হামিদ যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন, তখন সঙ্গত কারণেই বেশকিছু প্রশ্ন সামনে এসে যায় : ১. বর্তমানে দেশে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে তিনি আদৌ কোন উদ্যোগ নেবেন কি-না? ২. যদি যুক্তি হিসেবে ধরে নেই, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮ দল বিজয়ী হবে, তাহলে ওই সরকার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে দেখতে চাইবে কি-না?
এটা সত্য, মানুষের প্রত্যাশা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সংকট নিরসনে একটি উদ্যোগ নেবেন। জাতির অভিভাবক হিসেবে তার এ কাজটি করা উচিত। কিন্তু তিনি তখনই তা করবেন, যখন এ ধরনের ‘সংলাপে’ প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া তিনি এক চুলও যেতে পারবেন না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি একজন বহুল আলোচিত ও কোন কোন ক্ষেত্রে বিতর্কিত বিচারপতির আপিল বিভাগে পদোন্নতির ফাইলে স্বাক্ষর করেছিলেন। অথচ মাত্র কিছুদিন আগে স্পিকার হিসেবে তিনি ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে একটি রুলিং দিয়েছিলেন। সেই বিচারপতির পদোন্নতির ফাইল যখন তার সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি ‘বিবেক দ্বারা’ চালিত হতে পারেননি। উত্থাপিত ফাইলে তিনি স্বাক্ষর করতে ‘বাধ্য’। রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আছে। তার স্বউদ্যোগে করার কিছু নেই। অতীতে যারাই ‘কিছু’ করতে গেছেন, তারাই বিতর্কিত হয়েছেন। বিতর্কিত হয়েছিলেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও। এমনকি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে নিয়োগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সমালোচনা করতে এতটুকুও দ্বিধাবোধ করেননি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। ওই ‘সংলাপে’ বিএনপিও যোগ দিয়েছিল। তবে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রপতির ওই উদ্যোগের পেছনে ব্যক্তি জিল্লুর রহমানের চেয়ে সরকার তথা সরকারপ্রধানের আগ্রহ ছিল বেশি। তাই তিনি ‘সংলাপ’ করতে পেরেছিলেন।
এখন সে ধরনের একটি ‘সংলাপে’র সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও রাষ্ট্রপতি ওই ‘সংলাপ’ করবেন যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি ‘গ্রিন সিগনাল’ পাওয়া যায়। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে তিনি আদৌ কোন উদ্যোগ নেবেন, এটা মনে হয় না। তবে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি বিরোধী দল জয়ী (?) হয়, তাহলে একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে তখন। সংবিধানের ৫২(১) ধারায় রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের বিধান রয়েছে বটে, কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। ৫৩(১) ধারায় রাষ্ট্রপতিকে ‘অসামর্থ্যরে’ কারণে অপসারণ করা যায়। রাষ্ট্রপতি যদি শারীরিক বা মানসিকভাবে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তাহলে তাকে অপসারণ করা যায়। এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজন ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সংসদ সদস্যের সমর্থন (এক্ষেত্রে অবশ্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থনের কথা বলা হয়নি)। তবে এ প্রক্রিয়াও জটিল। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি একটি ‘চিকিৎসা পর্ষদ’ গঠন করবেন। ‘চিকিৎসা পর্ষদ’ সব ক্ষেত্রে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের পক্ষে থাকবে, তা বলা যাবে না। সুতরাং একটি জটিলতা আছেই। তাই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যে আগামী দিনগুলোতে আলোচনায় থাকবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
তিনি স্থানীয় পর্যায় থেকে উঠে এসেছেন। একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ নেই। অত্যন্ত সৎ ও সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এ মানুষটি আমাদের রাজনীতিকদের জন্য একটি ‘প্রেরণার উৎস’ হয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জাতির। আমাদের রাজনীতিকরা, বিশেষ করে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অনেকেই নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে যান। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান মহাজোট সরকারের বেশ ক’জন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাম ঘরানার এক মন্ত্রী, যিনি কোনদিন সংসদ নির্বাচনে ২ থেকে ৩ হাজারের বেশি ভোট পাননি, তিনি মন্ত্রী হয়ে একাধিক প্লট ও গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন! তাদের কাছে আবদুল হামিদ কোন আদর্শ নন। তার সন্তানরা কোনদিন আলোচনায়ও আসেননি। তবে প্রশ্ন তো থেকেই যায়Ñ নির্লোভ মানুষটি বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মুখে আদৌ হাসি ফোটাতে পারবেন কি-না?
এ দেশটির সম্ভাবনা প্রচুর। বিপুল জনশক্তির এ দেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ হবে আগামী দশকের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। গওকঞ ও ঞওগই অর্থনৈতিক জোট নিয়ে যে সম্ভাবনা দেখছেন অর্থনীতিবিদরা, বাংলাদেশ খুব সহজেই এ দুটি জোটে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। এজন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এ দুটিতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ক্ষমতায় থাকবেন ২০১৮ সাল পর্যন্ত। তার ক্ষমতা সীমিত, আমরা জানি। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের তিনি বোঝাতে পারেন, এ মুহূর্তে সংঘাত নিরসনে একটি উদ্যোগ নেয়া বড় প্রয়োজন। আর দায়িত্বটি সরকারের ঘাড়েই বর্তায়। বিরোধী দল অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলেছে। হেফাজতে ইসলাম ৫ মে ঢাকা অবরোধের ডাক দিয়েছে। এর আগে তাদের ঢাকা অবরোধ সরকারের বাধার কারণে সফল হয়নি। কিন্তু ঢাকার শাপলা চত্বরে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতি জানান দিয়ে গিয়েছিল,পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা একটি ‘শক্তি’। তাদের এ উত্থান পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভিন্ন ‘ব্যাখ্যা’ পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান (?) নিয়েও শংকিত পশ্চিমা বিশ্ব।
এমনই এক পরিস্থিতিতে নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার যদি কিছুটা ‘নমনীয়’ না হয়, তাহলে সংঘাত বাড়বে বৈ কমবে না। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন তাই জরুরি। রাষ্ট্রপতিকে ‘সুযোগ’ দেয়া হলে তিনি একটি ‘সংলাপ’ শুরু করতে পারেন। আমার বিশ্বাস বিএনপি ওই ‘সংলাপে’ যোগ দেবে এবং তাদের মতামত তুলে ধরবে, যেমনটি করেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই।
Daily JUGANTOR
24.04.13
0 comments:
Post a Comment