রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

এ দেশে এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই


মাহমুদুর রহমানের পর এবার তার মা মাহমুদা বেগম। তাঁর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধেও। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি অবৈধভাবে  সংগ্রামের (?) প্রেস থেকে দৈনিক আমার দেশ ছাপার অনুমতি দিয়েছিলেন। আর মাহমুদা বেগম, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি আমার দেশ কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে বিনা অনুমতিতে (?) সংগ্রামের প্রেস থেকে দৈনিক আমার দেশ ছেপেছেন। অথচ যতটুকু জানা গেছে মাহমুদা বেগম তথা আমার দেশ কর্তৃপক্ষ আইন মেনেই আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে পত্রিকাটি ছেপেছেন। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে বয়োবৃদ্ধা মাহমুদা বেগমের নামে মামলা, সম্পাদক আবুল আসাদকে জড়ানো মুক্তচিন্তার জগতের জন্য একটি অশনি সঙ্কেত। অতীতে কখনো এ রকমটি হয়নি। আরো দুঃখজনক খবর হচ্ছে আমার দেশ এর ছাপাখানা, যা এখন সিলগালা করা, সেখানকার ১৯ জন সাধারণ কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর তাঁকে ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এই খবরের রেশ ফুরিয়ে যাবার আগেই দৈনিক সংগ্রামের ছাপাখানা থেকে ছাপা হওয়া আমার দেশের কয়েক হাজার কপি জব্দ এবং মামলা করল পুলিশ। এর আগে আমার দেশ-এর ছাপাখানা সিলগালা করে দিয়েছিল পুলিশ। কর্তৃপক্ষ এরপর প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ১০ ধারা মতে আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে পত্রিকাটি সীমিত আকারে প্রকাশ করে আসছিল। এটাও সহ্য হলো না সরকারের।  ১লা বৈশাখ পত্রিকাটি বাজারে যাবার আগেই জব্দ করল ছাপা হওয়া কয়েক হাজার সংখ্যা। এই প্রবণতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সালের কথা। ওই সময় বিরোধী দলের মুখপত্র গণকণ্ঠ অফিসে পুলিশ হামলা করে পত্রিকা অফিস বন্ধ করে দিয়েছিল। পত্রিকার প্লেট ভেঙে ফেলেছিল। গ্রেফতার করেছিল ওই পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে। ওই সময়ও ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। আজো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ওই সময় শেখ মুজিব মস্কোপন্থীদের প্ররোচণায় সিপিবি ও মস্কোপন্থী ন্যাপ (মো.)কে নিয়ে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন করেছিলেন। আজো মস্কোপন্থীরা মন্ত্রিসভায় এবং প্রেসিডিয়ামে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। নীতিনির্ধারণীতে তারা পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অনেকেই এখন প্রশ্ন করেন বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে?
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ সৃষ্টিতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। আসলে কী তিনি তাই করেছেন? এ দেশের সিনিয়র আইনজীবীরা বলেছেন তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তাঁকে গ্রেফতার করে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। ব্যারিস্টার রফিক উল হক মনে করেন মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন মনে করেন জনাব রহমানকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা ও সংবাদপত্রের অধিকার ুণœ করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী মনে করেন সরকার অসাংবিধানিকভাবে সংবাদমাধ্যমের মত প্রকাশের অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতার করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুলের অভিযোগ হচ্ছে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও নির্যাতন সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক ও গণবিরোধী নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেছেন, ‘যে সরকার সংসদ সদস্যের নিজের পিস্তলের গুলিতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে গ্রেফতার করে না, শর্টগান উচিয়ে গুলি করা বা দুর্নীতির  প্রমাণ্য অভিযোগে অভিযুক্ত দলের নেতাদের আটক করে না, নির্মম খুনি ও প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদান করেন, তার মুখে একজন সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার করা আইনের শাসন, এটি শুনলে হাস্যকরই শোনায়। মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার বরং স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্বকারী একটি পদক্ষেপ।’ আর তরুণ আইনজীবী তাজুল ইসলাম মনে করেন মাহমুদুর রহমানকে ১৩ দিনের রিমান্ডে দিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা ৫৫ ডিএলআর ভঙ্গ করা হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ আইনজীবীদের একটা বড় অংশ যখন পত্র-পত্রিকায় তাদের মনোভাব এভাবে প্রকাশ করেন, তখন মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আইনজীবীদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, একজন সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার করা আইনসঙ্গত হয়নি। এখানে বলা ভালো গণজাগরণ মঞ্চ মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছিল।
সমাজ উন্নয়নে, সমাজ বিকাশে সংবাদপত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। যুগে যুগে সংবাদপত্রের এ ভূমিকা স্বীকৃত। বস্তুত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও স্বাধীন সংবাদপত্র পরস্পর পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের সংবিধানেও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদের ৩৯ (২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দু’টো আরো স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার কথা এব ‘খ’তে রয়েছে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯ নং ধারাটিতে একজন সংবাদ কর্মীকে যেমনি অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সাথে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হবার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষাকবজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের ঘটনায় এই ধারাটি লঙ্ঘিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাকে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনারও স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলায় নিম্ন আদালতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোনো ব্যক্তিকে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারবে।’ কিন্তু দেখা গেল নিম্ন আদালতে মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। উচ্চ আদালতের ওই রায়টি ছিল ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল। ব্লাট বনাম বাংলাদেশ মামলায় বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন একটি ডিভিশন বেঞ্চ ওই সময় রায়টি দিয়েছিলেন। যা ডিএলআর ৫৫ নামে পরিচিত। ‘তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর সংক্রান্ত’ হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়। আপিল বিভাগও হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। উক্ত রায়ে বলা হয়েছিল : ১. আটকাদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না; ২. কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে; ৩.  অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা কাছের কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করতে হবে; ৪. গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে; ৫. গ্রেফতারের ৩ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে কারণ জানাতে হবে; ৬. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃতর নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তা বাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে; ৭. গ্রেফতারকৃতকে  তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে; ৮. জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী বা পরিচিত কারও উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে; ৯. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রযোজনীয় তথ্য না পাওয়া গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্টেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। আইনজীবীরা বলেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এসব নির্দেশনার একটিও মানা হয়নি।
মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তিনি বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপি সংলাপ (বেলজিয়ামে বসবাসকারী একজন আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমদ জিয়াউদ্দীনের সাথে) প্রকাশ করেছেন ধারাবাহিকভাবে। এই সংলাপের বিষয়বস্তু তো আমার দেশে প্রকাশিত হবার আগেই  লন্ডনের সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট প্রকাশ করেছিল এবং সেই সাথে তা ইউটিউবেও প্রকাশিত হয়েছিল। সবাই জানেন দীর্ঘ প্রায় চার মাস তিনি আমার দেশ পত্রিকায় একরকম বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগে তিনি গত ১৩ ডিসেম্বর ফার্মগেট এলাকায় গিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করেছেন! এর আগেও ‘আদালত অবমাননা’ মামলায় তিনি দীর্ঘ প্রায় দশ মাস জেল খেটেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ৬০টিরও অধিক মামলা করা হয়েছিল। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার মনে করেন ‘অন্যায় দুর্নীতির সমালোচনা করায় মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে’। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, মাহমুুদুর রহমানের সাথে সাথে তাঁর মা মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদও অভিযুক্ত হলেন।
আমরা আমাদের সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এই দেশটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আজ এত বছর পর এসে দেখা গেল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। আমার দেশ প্রকাশনাও এখন বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার পর এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। বহিঃবিশ্বে মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের ঘটনাটি ভালো চোখে দেখেনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে এর নিন্দা জানানো হয়েছে। এখন সরকারের উচিত হবে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করা ও তাঁকে মুক্তি দেয়া।
19.04.13

0 comments:

Post a Comment