রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বাধা কোথায়

 


দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ পাকিস্তান ও নেপাল আগামী সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও বাংলাদেশে আগামী দশম সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে এখনও একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এ প্রশ্নে সরকার, বিরোধী দল আর সুশীল সমাজের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সরকারের অবস্থান পরিষ্কার_ সংবিধানে যেখানে একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের' কথা বলা হয়েছে, সেখানে নির্বাচন হবে 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র আওয়ায়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন। বিরোধী দলের দাবি একটি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্যথায় নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে না। আর সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে টিআইবি একটি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব করেছে। তবে সরকার এতটুকুও নমনীয় হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি বর্তমান সরকার। এখন একটি 'সমঝোতা' যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। বিরোধী দল বলছে, তারা অক্টোবর থেকে অসহযোগ আন্দোলনে যাবে। বিরোধী দল তত্ত্বাবধাক সরকারের দাবিতে হরতাল করেছে। ২৩ ও ২৪ এপ্রিল আবারও হরতাল। কিন্তু হরতালে সরকারের মনোভাবে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখন 'অসহযোগ আন্দোলনের' হুমকিতে সরকারের মনোভাবে পরিবর্তন আসবে, তা মনে করারও কোনো কারণ নেই। সরকার স্পষ্টতই হার্ডলাইনে গেছে।
পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো পার্থক্য নেই। পাকিস্তানে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগের (নওয়াজ শরিফ) মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। পিপিপি নেত্রী বেনজির ভুট্টো দু'দু'বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু টার্ম পূরণ করতে পারেননি। ঠিক তেমনি মুসলিম লীগ নেতা নওয়াজ শরিফও দু'দু'বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কোনোবারই তার টার্ম শেষ করতে পারেননি। এমনি এক পরিস্থিতিতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নির্বাচনে পিপিপি বিজয়ী হয়। গত ১৭ মার্চ পিপিপি তাদের ৫ বছরের টার্ম শেষ করেছে। একই কথা প্রযোজ্য নেপালের ক্ষেত্রে। নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে যে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে কোনো ঐক্য ছিল না। সাংবিধানিক পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নয়া সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে। কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ গত ২৪ মার্চ পাকিস্তানে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তার ফিরে আসাটা খুব সুখের হয়নি। নির্বাচন কমিশন তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। শুধু তাই নয়, কোর্ট তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। তাকে তার নিজ বাড়িতেই অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। তাকে ১৪ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় আরও একবার প্রমাণিত হলো, সাবেক বিচারপতি মির হাজার খান খোসোর নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সত্যিকার অর্থেই 'নিরপেক্ষ' থাকার চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশন যে কোনো ধরনের প্রভাবের বাইরে থেকে আইন অনুযায়ী তাদের 'অধিকার' প্রয়োগ করছে। নির্বাচনে কী হবে, সেটা বলা কঠিন। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যাচ্ছে, তারা নিরপেক্ষভাবেই কার্য সম্পাদন করছেন।
নেপালে গঠিত হয়েছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আগামী ২১ জুন সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এ লক্ষ্যে গত ১৪ মার্চ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন নেপাল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিলরাজ রেগমি। প্রায় ১০ মাস ধরে সেখানে রাজনীতিতে অচলাবস্থা চলে আসছিল। নেপালে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছিল। মূলত চারটি প্রধান দলের পক্ষ থেকেই গত দশ মাসে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু পার্লামেন্টের সমর্থন না পাওয়ায় কেউই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি। গত মে মাসে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু ওই সময় নেপালের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধান চারটি দল একটি অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকারের পক্ষে নীতিগতভাবে একমত হয় ও বিচারপতি রেগমিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করে। রেগমি ইতিমধ্যে শপথও নিয়েছেন। তার প্রধান ও একমাত্র কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা। এখানে মূল সমস্যা ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিলেন না। এমনকি মাওবাদীদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছিল। যারা বিশ্ব রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন অতি সম্প্রতি ইউরোপের একটি দেশ বুলগেরিয়ায় সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোজেন প্লোভনেলিয়েভ সাবেক কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। রায়কভ মে মাস পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন এবং মে মাসে তিনি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবেন। অনেকের মনে থাকার কথা, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রিসে পাপেন্দ্র সরকারের পতন ঘটেছিল। পরে সেখানে একজন বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং তিনি ইতিমধ্যে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেমানান। কিন্তু কখনো-সখনো রাষ্ট্রকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। গ্রিসে যেখানে এক সময় গণতন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেখানেও পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা গ্রহণ করতে। ২০০৭ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছিল, অথচ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। বৃহত্তর ঐক্য ও সংকট এড়াতে সরকারকে সংবিধানবহির্ভূত অনেক সিদ্ধান্তই নিতে হয়। এসব ঘটনা থেকে আমরা কী শিখেছি? বাংলাদেশে আন্দোলনের ফলশ্রুতি ছিল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেটা ১৯৯৩-এর পরবর্তী সময়ের কথা। জামায়াতও সেদিন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। খালেদা জিয়া প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীকালে সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়। এরপর সংবিধানে সংশোধনী এনে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি রায় একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দশম সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে? সরকার সংবিধান অনুসরণ করবে_ এটাই স্বাভাবিক। আর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো সুযোগ নেই। এটাও সত্য, সকল দলের বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না হোক, একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানে কোনো সংশোধনী না এনেও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এটা নিয়ে সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে_ ১. নবম সংসদে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার বয়স হবে মাত্র ৩ মাস। এই তিন মাসের মধ্যে ওই সরকার নির্বাচন পরিচালনা সম্পন্ন করতে বাধ্য থাকবে; ২. প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন মাস আগে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন; ৩. দুটি প্রধান দলের পক্ষ থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে ওই সরকার গঠিত হবে; ৪. নিরপেক্ষতার স্বার্থে সংসদের একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্যকে এ দায়িত্বটি দেওয়া যায়। অথবা সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পেঁৗছলে তিনি শূন্য আসনে বিজয়ী হয়ে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এই দায়িত্বটি পালন করবেন। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আরপিওতে থাকতে হবে, যা সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে; ৫. নির্বাচন-পূর্ব তিন মাস প্রধান দুই দলের নেত্রী সমমর্যাদা ভোগ করবেন। মোটা দাগে যে কথাটা বলা যায় তা হচ্ছে, নির্বাচন-পূর্ব তিন মাস প্রধানমন্ত্রী নিজেকে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে ঘোষণা করলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো ফর্মুলাই জট খুলবে না। নেপালে রাজনীতিবিদরা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাকিস্তানেও সেই পথে গেছে। এখন আমরা যদি এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিই, আমরা বড় ধরনের একটা সংকট এড়াতে পারব।
Daily SAMAKAL
23.04.13

0 comments:

Post a Comment