রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

হেফাজতের তের দফা এবং প্রসঙ্গ কথা

সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক অঙ্গনে আন্দোলনের একটি অন্যতম বিষয় হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন ও তাদের তের দফা। সংগঠনটির বয়স মাত্র তিন বছর। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন এটি। এতদিন তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ছাত্রদের মাঝে। ঈমান-আকিদা নিয়েই মূলত এদের কাজ। কিন্তু গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় বিশাল জনসসমাবেশ করে তারা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদিও তারা নিজেরা কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের মনে করেন না। তাদের ভাষায় ‘ইসলাম রক্ষা’ ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি কটূক্তি করার প্রতিবাদেই তাদের এই সমাবেশ। যদিও তারা লংমার্চ করে ঢাকায় আসতে চেয়েছিল, বাধার কারণে তাদের লংমার্চ সফল হয়নি, কিন্তু গণজমায়েত সফল হয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফাকে সামনে রেখেই এই সমাবেশ করেছিল। তাদের এই ১৩ দফা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। বিষয়টি হচ্ছে ‘ব্লাসফেমি’ আইন। এ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ৮ এপ্রিল কথা বলেছেন বিসিবির সঙ্গে। আসলেই কী হেফাজত একটি ‘ব্লাসফেমি’ আইন চায়? হেফাজতের নেতারা কী ‘ব্লাসফেমি’ আইন সম্পর্কে অবগত? আমি ১৩ দফায় কোথাও ‘ব্লাগফেমি’ শব্দটি খুঁজে পাইনি। কিন্তু হেফাজতের এক নেতার বক্তব্যও ছাপা হয়েছে গত ১০ এপ্রিল। তিনি হচ্ছেন হেফাজতের সাহিত্য ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহার। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যদি জনগণের ম্যান্ডেট বুঝে থাকেন, তাহলে ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে ‘ব্লাসফেমি’ আইন করতে হবে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন পবিত্র কোরান ও হাদিসের একাধিক বাণীতে নাস্তিক-মুরতাদদের ন্যায্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা আছে। তাই এ দাবি নতুন কিছু নয়। মুফতি ইজহার সরাসরি ‘ব্লাসফেমি’র কথা বললেও মাওলানা শফী, যিনি হেফাজতে ইসলামের প্রধান, তিনি তার বক্তব্যে কোথাও ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তার বক্তব্য স্পষ্ট। ঢাকার গণজমায়াতের পরেও তিনি বলেছেন, ‘তৌহিদি জনতা ইসলামের ওপর আঘাত মেনে নেবে না।’ তিনি চেয়েছেন যারা ইসলামের ও নবী করিম (সা.)-এর অবমাননা করেছে, তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হোক। তবে প্রধানমন্ত্রী বিসিবির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এই ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটি ব্যবহার করায় আপত্তি জানিয়েছেন মুফতি ফয়জুল্লাহ, যিনি হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব। দৈনিক মানজমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘নাস্তিক-মুরতাদদের জন্য ব্লাসফেমি আইন করার প্রয়োজন নেই। শরিয়তের বিধানমতে এ ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে’। তবে এটা কার্যকর করতে জাতীয় সংসদে একটি আইন প্রণয়ন করার জন্য তিনি দাবি জানান (১০ এপ্রিল)। এসব বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মধ্যে এই ‘ব্লাসফেমি’ আইন নিয়ে একটি বিভ্রান্তি রয়েছে। মুফতি ফয়জুল্লাহর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় তারা আদৌ ব্লাসফেমি আইন চান না। হেফাজতের প্রথম তিনটি দাবির মধ্যেই একটি আইন করার কথা রয়েছে, যা কিনা মুফতি ফয়জুল্লাহর বক্তব্য সমর্থন করে। এখানে ‘ব্লাসফেমি’র কথা বলা হয়নি। ১নং দাবিতে বলা হয়েছে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে। আগে এটি ছিল। সংবিধান সংশোধনে এটি বাতিল করা হয়েছে। আমি মনে করি এই অংশটুকু সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে সরকার হেফাজতকে আস্থায় নিতে পারে। সরকার প্রয়োজনে নতুন একটি কমিটি গঠন করতে পারে, যেখানে হেফাজতের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এই কমিটি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারলে ভালো। পরিবর্তিত সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ রেখে দেয়া হয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে অষ্টম অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূল নীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যেহেতু রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখা ও সেই সঙ্গে প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ থাকার কারণে সরকার খুব সঙ্গতকারণেই সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ শব্দটি পুনঃস্থাপন করতে পারে। ২নং দফায় বলা হয়েছে ‘আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসারোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।’ সম্ভবত এটিকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, হেফাজত ‘ব্লাসফেমি’ আইন চায়।
এখানে ব্লাসফেমি আইন নিয়ে কিছু বলা দরকার। ব্লাসফেমি শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘অশালীন ভাষায় ঈশ্বর বা ধর্মকে আক্রণম করা।’ এক সময় ইউরোপে ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করার জন্য এ ধরনের একটি আইন তৈরি করেছিল। এই আইনটি দীর্ঘদিন ধর্ম অবমানকারী, বিশেষ করে খ্রিস্টীয় ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। শাসকরা এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে গত তিন-চার দশক ধরে ‘ব্লাসফেমি’ আইনের প্রসঙ্গ ও দাবিটি উঠেছে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে। ইউরোপে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে যখন লেখালেখি শুরু হয়, যখন মহানবী হজরত মুহম্মদকে (সা.) নিয়ে মিডিয়ায় কটূক্তি করা হয়, কার্টুন আঁকা হয়, তখন ব্লাসফেমির আইনটি নতুন একটি মাত্রা পায়। একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন, ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারীদের শাস্তির প্রশ্নেই এই দাবি সাম্প্রতিককালে সোচ্চার ছিল। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম কিংবা হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম অবমাননা হয়েছে, এ রকম ঘটনা আদৌ ঘটেনি। আর ঘটলেও খুব একটা প্রচার পায়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সব দেশে কী এই ব্লাসফেমি আইন আছে? সৌদি আরব, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মিসরের মতো দেশে ব্লাসফেমি আইন আছে, যে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আবার আলজেরিয়ার মতো দেশে ব্লাসফেমি আইন নেই, যদিও আলজেরিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও দেশটি একটি ইসলামিক দেশ। এভাবে অনেক মুসলিম দেশে কোনো ব্লাসফেমি আইন নেই। আমি একটু খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি ইউরোপের প্রায় সব দেশে, বিশেষ করে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডে কোনো ব্লাসফেমি আইন নেই। এমনকি ব্রাজিলের মতো দেশেও নেই। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশেও ব্লাসফেমি আইন নেই। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলেও ধর্ম অবমাননাকারী ব্লাসফেমি আইন নেই। যুক্তরাষ্ট্রেও নেই। যুক্তরাজ্যে ২০০৮ সালে এ সংক্রান্ত একটি আইন বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫২ সালে সুপ্রিম কোর্ট Jopepah Burstyn Inc বনাম Wilson মামলায় যে ঐতিহাসিক রায়টি দিয়েছিল এবং তাতে বলা হয়েছিল কেউ যদি ধর্ম সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করে তা কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। ওই সময় The Miracle (ফেল্লিনি অভিনীত) নামে একটি ছবিতে ধর্মকে অপমান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
 তবে প্রতিটি দেশেই ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। যেমন ভারতের পেনাল কোডের ধারা ২৯৫-এ, ইন্দোনেশিয়ায় পেনাল কোডের ১৫৬ ধারা, ইসরাইলের পেনাল কোডের ১৭০ ও ১৭৩ ধারা, ডেনমার্কের পেনাল কোডের ১৪০ ধারায় ধর্ম অবমাননাকারীদের শাস্তির বিধান রয়েছে। হেফাজতের ৩নং ধারায় কুৎসা রটনাকারী ব্লগারদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। সরকার তো ইতিমধ্যে কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতারও করেছে। ৯নং দফায় টিভিতে ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধের দাবি করা হয়েছে। এটা মনিটর করা কঠিন কিছু নয়। ১৩নং দফায় গ্রেফতারকৃত মাদ্রাসা ছাত্রদের মুক্তির দাবি করা হয়েছে এটাও সরকার করতে পারে। ১১নং দফায় আলেম-ওলামাদের ওপর হামলা বন্ধের দাবি রয়েছে। ৮নং দফায় বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের নির্বিঘেœ নামাজ আদায় করার দাবিও রয়েছে। এগুলো মানা সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। তবে ৪নং দফায় ‘নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ’ বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক আরব দেশে (মিসর ও তিউনিশিয়া) নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকাও ব্যাপক। হেফাজতে ইসলামের নেতারা নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন। ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে (৭নং), তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অনেক ইসলামিক রাষ্ট্রেও ভাস্কর্য রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি এনজিওদের কর্মকাণ্ড বন্ধের যে দাবি (১০নং দাবি) করা হয়েছে এ ক্ষেত্রেও সরকার উদ্যোগী হয়ে বিষয়টি মনিটর করে দেখতে পারে। মোট কথা ১৩ দফায় বেশকিছু দাবি রয়েছে, যা সরকার ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়নের পথে। আল্লামা শফীর সঙ্গে আলোচনায় সরকারের অবস্থানকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আলোচকদের ব্যর্থতা সেখানেই। একই সঙ্গে হেফাজতে ইসলামকে জামায়াতের সঙ্গে তুলনা করে সরকারের মন্ত্রীরা আগে থেকেই এই সংগঠনটিকে ‘শত্র“’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এটাও ছিল ভুল কৌশল। ৬ এপ্রিলের গণজমায়েতের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইসলামিক গণজাগরণের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। এরা প্রমাণ করেছে এদের গ্রহণযোগ্যতায় নিতে হবে। সরকারের উচিত হবে না আরেকটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করার। এখন একটি ‘সংলাপ’ই পারে সব ধরনের বিভ্রান্তি দূর করতে ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে যেতে। ৬ এপ্রিলের পরও যদি সরকার গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাদানিককে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সরকার আবারো ‘ভুল’ করবে। ইতিমধ্যে ব্লাসফেমি আইনটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন বটে, কিন্তু ১৩ দফায় যেহেতু বিষয়টি (ব্লাসফেমি) নেই, সেহেতু এটা নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য না করাই শ্রেয়। আমাদের দেশে ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন (৫৭ ধারা) বিশেষ ক্ষমতা আইন, ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে (২৯৫-এ) স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেউ যদি ধর্ম অবমাননা করে, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন প্রয়োজনে এসব আইনে আরো কিছু সংশোধনী আনতে পারে সরকার, যাতে করে ধর্ম অবমাননাকারী কিংবা রাসুলে করিম (সা.) সম্পর্কে অপমানজনক উক্তিকারীদের কঠিন শাস্তি দেয়া যায়। হেফাজতে ইসলামের দাবি মূলত এটিই। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন (কালেরকণ্ঠ, ১১ এপ্রিল) সরকার ও হেফাজতকে একটি মুখোমুখি অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আইন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্রের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘হেফাজতের দাবি অযৌক্তিক ও সংবিধান পরিপন্থী।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সেই অবস্থানপত্রটি তৈরি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এটা সত্য, আমাদের সংবিধানের বেশকিছু ধারার সঙ্গে ১৩ দফার কিছু কিছু ধারা সাংঘর্ষিক। যেমন সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৬নং ধারা (চলাফেরার স্বাধীনতা), ৩৭নং ধারা (সমাবেশের স্বাধীনতা), ৩৮নং ধারা (সংগঠনের স্বাধীনতা), ৩৯নং ধারা (চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা) কিংবা ৪০নং ধারা (পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা), ৪১নং ধারায় (ধর্মীয় স্বাধীনতা) আমাদের অধিকার স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে হেফাজতের ১৩ দফার বিরুদ্ধে এসব ধারা উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাই কাম্য। এ মুহূর্তে এ ধরনের একটি অবস্থানপত্র তৈরি করার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। কেননা সরকার যখন হেফাজতের সঙ্গে কথাবার্তা বলার কথা বলছে এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিবিসির সঙ্গে আলাপে যে কোনো সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি, সে ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘নীরবতা’ অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকাণ্ড নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। সরকার যে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হেফাজতে ইসলামকে ‘শান্ত’ করার জন্য যথেষ্ট। প্রথমটি হচ্ছে সরকার চার ব্লগারকে গ্রেফতার করেছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। এখন তদন্তেই  বেরিয়ে আসবে তারা ধর্ম অবমাননার সঙ্গে কতটুকু জড়িত ছিল। যদি তারা সত্যি সত্যিই ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করে থাকে কিংবা মহানবী (সা.) সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা অন্যায় করেছে। মুক্ত চিন্তার নামে যা কিছু ব্লগে লেখার অধিকার তাদের কেউ দেয়নি। এখন প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হতে পারে। দ্বিতীয় যে কাজটি সরকার করেছে তাও প্রশংসার যোগ্য। সরকারের কাছে ফেসবুক পেজ ‘বাঁশের কেল্লা’ ও ‘ব্লগ নুরানী চাপা’ পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ধর্মীয় অবমাননা’ পর্যবেক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত বিশেষ কমিটি এই সুপারিশটি করেছে। এছাড়া কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না বলেও কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘বাঁশের কেল্লা’ ও ‘নুরানী চাপা’ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। কমিটির ‘বন্ধ করে দেয়ার’ সুুপারিশ গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে এ ধরনের মন্তব্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তও মঙ্গল। কেননা যে কোনো মন্তব্য কোনো গণমাধ্যমে যদি প্রকাশ পায় তা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে প্রণোদনা জোগাতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক ও ব্লগারের পক্ষে। আধুনিক যুগে এগুলো যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। এর সুফল অনেক। আমরা এ সুফল থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। তবে ব্লগে লেখালেখি মনিটর করা যেতে পারে। আর আইন যদি কঠোর হয়, আমার ধারণা অনেকেই আর ধর্ম সম্পর্কে ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে সাহস পাবে না।
এমনিতেই রাজনীতিতে নানা সংকট চলছে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় সব নেতা এখন জেলে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ ও রাষ্টদ্রোহের অভিযোগে। তাকে ১৩ দিনের রিমান্ডেও নেয়া হয়। এদেশে অনেকেই আছেন, যারা এই গ্রেফতারকে পছন্দ করবেন না। আমরা বারবার বলছি সরকার আর বিরোধী দলের মাঝে একটা সমঝোতার কথা। কিন্তু কোনো সমঝোতাও হচ্ছে না। কোনো সংলাপও হচ্ছে না। সরকার ধীরে ধীরে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও ঢাকায় মহাসমাবেশ জানান দিয়ে গেল তারা একটি ‘শক্তি।’ তারা কারো ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বটে, কিন্তু তাদের ‘উপস্থিতিকে’ অস্বীকার করা যাবে না। সুতরাং তারা যে ১৩ দফা দিয়েছে, সেই দফা নিয়ে আলোচনা হোক। বনমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে আল্লামা শফীর আত্মীয়। সরকার এই ‘আত্মীয়তাকে’ ব্যবহার করতে পারে। তাদের কিছু ভালো পরামর্শও সরকার গ্রহণ করতে পারে। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আস্থায় নেয়া জরুরি। একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে আল্লামা শফী নিজে এবং তার সংগঠন জামায়াতবিরোধী। সরকার এটা কাজে লাগাতে পারে। তারা ৫ মে ঢাকা অবরোধের কথা বলেছে। তার আগেই হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সংলাপ ‘ওপেন’ করা প্রয়োজন।
Manobkontho
20.4.13

0 comments:

Post a Comment