বাংলাদেশের
এক ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন আবদুল হামিদ। স্থানীয় পর্যায়
থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদ দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেন শুধু তার
ন্যায়নিষ্ঠা, সততা আর সর্বজনগ্রহণযোগ্যতার কারণে। কিন্তু এক কঠিন সময় পার
করছে বাংলাদেশ। দুর্নীতিতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যখন
ভূলুণ্ঠিত, সরকার ও বিরোধী দল যখন এক চরম আস্থাহীনতার মধ্যে রাজনীতিকে
এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন সৃষ্টি হয়েছে বড়
অনিশ্চয়তা, তখন গোটা জাতি যে রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে থাকবে তা বলার আর
অপেক্ষা রাখে না। তিনি দায়িত্ব নিলেন এমন একটা সময়, যখন বাংলাদেশের একটি
জনপ্রিয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিন পদ্মা সেতুর
কাজ পাওয়ার জন্য শতকরা ১২ ভাগ টাকা সরকারের ৫ ব্যক্তিকে ঘুষ হিসেবে দিতে
রাজি হয়েছিল। পত্রিকার খবর অনুযায়ী এই ১২ ভাগের মধ্যে ২ ভাগ পাওয়ার কথা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান
চৌধুরীর। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের পাওয়ার কথা ৪ ভাগ। আবুল হাসান
চৌধুরী লাভালিনের কর্মকতাদের সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিয়েছিলেন। ঘুষের ২ ভাগ পাওয়ার কথা নিক্সন চৌধুরীর, যিনি প্রধানমন্ত্রীর
ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে এবং হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ছোটভাই। অর্থ উপদেষ্টা ড.
মসিউর রহমানের পাওয়ার কথা ১ ভাগ, সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার পাওয়ার
কথা ১ ভাগ। আরো ২ ভাগ পাওয়ার কথা এমন এক ব্যক্তির, যার কথা উল্লেখ করা
হয়নি। বিশ্বব্যাংক লাভালিনের সাবেক কর্মকর্তা রমেশ শাইর ডায়রিতে এ নামগুলো
পেয়েছে। যদিও সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান
বারবার দুর্নীতি তথা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। পত্রিকায়
বিজ্ঞাপন দিয়েও তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি বলে জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক আবুল
হোসেন ও মসিউর রহমানের ব্যাপারে তাদের অভিযোগ উপস্থাপন করলেও দুদক যে
মামলা করেছে তাতে তাদের আসামি করা হয়নি। বলা ভালো, কানাডার অন্টারিওর
সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিস-এ লাভালিনের ঘুষ দুর্নীতির মামলার কার্যক্রম
শুরু হয়েছে। আগামী ২১ মে পরবর্তী বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। দৈনিক প্রথম
আলো যে দিন এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে, সেদিন অপর একটি দৈনিকে প্রকাশিত
হয়েছে বাংলাদেশ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১২। ওই
প্রতিবেদনে গুম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য, দুর্বল কর্মপরিবেশ ও
শ্রমিক অধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ এবং দুর্নীতিকে মানবাধিকারের
ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের
অন্যান্য ঘটনার মধ্যে গণগ্রেফতার, আটক ও পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা
রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে দুর্বল বিচার ব্যবস্থা এবং
বিচার-পূর্ব দীর্ঘ কারাবাসকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকার
বাক-স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার সীমিত করারও নির্দেশ দিয়েছে।
অভিযোগ আছে, সাংবাদিকরা সেল্ফ সেন্সরশিপে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিবেদনে আরো
উল্লেখ করা হয় রাজনৈতিক সহিংসতা ও অব্যাহত দুর্নীতি সমস্যা হিসেবে রয়ে
গেছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির যারা কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন
এই প্রতিবেদনে মিথ্যা কিছু বলা হয়নি। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে
মিথ্যা মামলা, জামিন দিতে অস্বীকৃতি, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের
বিচার, শিবির দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ইত্যাদি ঘটনাবলি প্রমাণ করে দেশ আজ
এক চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কী এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম?
একজন সম্পাদককে আজ তার অধিকারের জন্য অনশন- ধর্মঘট পালন করতে হয়। আমাদের
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৭১ সালে নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশকে চাননি।
পরিস্থিতি আজ এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ১৮ দলকে বারবার হরতাল দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি আজ বড় ধরনের হুমকির মুখে। সিপিডি অর্থনীতিতে অশনি সংকেতের কথা বলেছে। বিদেশি পোশাক আমদানিকারকরা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা নতুন বাজার পেয়েছেন ভিয়েতনাম আর লাওসে। মিয়ানমার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় মার্কিনিদের একটা বড় বাজার হতে যাচ্ছে মিয়ানমার। ইতিমধ্যে বেশকিছু মার্কিন কোম্পানি মিয়ানমারে তাদের অফিস খুলেছে। সেখানে বিনিযোগের সম্ভাবনাও বাড়ছে। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এটা তো সত্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এডিবি তাদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলেছে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ বলা হয়েছিল প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এখন সেটা কল্পনাতেই থেকে গেল। বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। প্রায় ষোলো কোটি মানুষের এই দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটি। প্রতি বছর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। তাদের যদি সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ দেয়া যেত, তাহলে তারা অর্থনীতিতে একটা বড় অবদান রাখতে পারত। যেখানে ইউরোপে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমছে, সেখানে আমাদের বাড়ছে। চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চীনে বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা উৎপাদনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এই বয়স্ক নাগরিকদের পেনশনসহ সামাজিক নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের যে অবস্থান (বর্তমানে দ্বিতীয়), তা আগামী কয়েক দশক পর চীন আর তা ধরে রাখতে পারবে না। এক সময় বিআরআইসি দেশগুলো অন্যতম একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিআরআইসি-এ যোগ দেয়ায় এ জোট শক্তিশালী হয়েছিল, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদ জিম ও নীলের মতে (যিনি ২০০১ সালে ব্রিকসের উত্থান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন) বিআরআইসিএস আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই দুর্বল একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। জিম ও নীল নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট এমআইকেটি-এর কথা বলেছেন আর জর্জ ম্যাগন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যাক গ্লোডস্টোন বলেছেন, অপর একটি জোট টিআইএমবিআই’র কথা। বাংলাদেশের বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত শ্রেণীর উত্থান বাংলাদেশকে আগামী দশকে এমআইকেটি অথবা টিআইএমবিআই জোটে নিয়ে যেতে পারত। বলা ভালো, প্রতিটি দেশের প্রথম আসর নিয়ে নতুন জোটকে পরিচিত করা হচ্ছে, অনেকটা বিআরআইসিএস-এর মতো। যেমন এমআইকেটিতে রয়েছে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক। আর টিআইএমবিআই জোটে রয়েছে তুরস্ক, ভারত মেক্সিকো, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এসব দেশের প্রতিটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। ভারতে দারিদ্র্য থাকলেও (২০১০ সালের হিসাব আনুযায়ী জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক ০২ ভাগ লোক দরিদ্র), বিশ্বব্যাংকের মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। তখন বিশ্বঅর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ (২০০৭ সালে মাত্র ২ ভাগ)। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। তুরস্কের প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের ওপর। ইউরোপে যেখানে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে, সেখানে তুরস্কের অর্থনীতিতে তা এতটুকু প্রভাব ফেলেনি। ভারত ও তুরস্ক এটা করতে পেরেছে। কারণ সেখানে রয়েছে বিপুল শিক্ষিত এক জনগোষ্ঠী। রয়েছে রাজনৈতিক সহনশীলতা। আমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারতাম, আমরাও ভারত ও তুরস্কের কাতারে নিজেদের নিয়ে যেতে পারতাম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এখন আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে তারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সরকারের নির্লিপ্ততা এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার মনে হচ্ছে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কিছু ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার জন্য। সংবাদপত্রে হলমার্ক কেলেঙ্কারি বা বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হলেও ‘পর্দার অন্তরালে’ ক্ষমতাবান লোকদের গ্রেফতার করা হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে সরকারি সোনালী ব্যাংক এখন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে যেখানে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন চার বছর। এই মূল্যায়ন গবেষণা সংস্থা সিপিডির। সিপিডির মতে টানা কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের জটিলতার মধ্যে আছে। সিপিডির গর্বেষণাকর্মকে ফেলে দেয়া যাবে না।
এখন পরিস্থিতি আমাদের যে দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স কাউন্সিল ২০১২ সালের যে গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১৫টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় এশিয়ায় যে ৩টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের কথাও রয়েছে। অপর দুটি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। যুক্তি হিসেবে এনআইসি উল্লেখ করেছে সংঘাতময় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আমরা কোনোভাবে মেলাতে পারব না, এটা সত্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৭০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, বিরোধী দলের নেতাদের ওপর গুলিবর্ষণ, তাদের আহত করা ও গ্রেফতার, গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের গাড়িতে আগুন (আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিলে) কিংবা ১২ এপ্রিল খুলনায় ভারতীয় হাইকমিশনারের গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা এ কথাই প্রমাণ করে বাংলাদেশ বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অস্থিরতা একদিকে যেমনি গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে তেমনি জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। এর সঙ্গে এখন যোগ হলো লাগাতার হরতালের বিষয়টি।
এমনি এক পরিস্থতিতে দেশের বিশতম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বটি গ্রহণ করলেন আব্দুল হামিদ। রাজনীতিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞ তিনি। ১৯৭০ সালে তরুণ বয়সে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকে তাকে আর পিছু তাকাতে হয়নি। তিনি তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, সরলতা নিয়ে বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করবেন, এটাই মানুষের প্রত্যাশা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বিরোধী সব দলের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। আজো তিনি সে রকম একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে জাতি আজ বিভক্ত। দেশের সুশীল সমাজ, এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে তাদের অভিমত দিলেও সরকার এখনো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে আন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখেই নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু বিরোধী দল এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা আগামী অক্টোবরে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এই পরিস্থিতি পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান কোনো আশার কথা বলে না। প্রতিনিয়ত মানুষ এক আশঙ্কার মধ্যে থাকে। থাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে। যদিও সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত এবং সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া তিনি কোনো কিছুই করতে পারবেন না আগামীতে। তারপরও তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতি। তিনি জাতির অভিভাবক। সাংবিধানিকভাবে না হলেও সংকটকালীন সময়ে তিনিই পালন করতে পারেন একটি বড় ভূমিকা। এই বাংলাদেশকে আমরা চাইনি। হরতাল আজ আমাদের জন্য একটি অভিশাপ। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। পরস্পর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের রাজনীতি শুরু করা দরকার। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, দারিদ্র্য বিমোচন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমাদের কাম্য। আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক অনৈক্য আমাদের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। দীর্ঘ ৪২ বছর পার করার পর আমাদের উপলব্ধিতে যদি পরিবর্তন না আসে, তা হলে আমরা বিশ্ব আসরে এক সময় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিতি পাব। তাই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা জানি সাংবিধাকভাবে তার ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু জাতির অভিভাবক হিসেবে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আমরা জানি ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকেরই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বেগম জিয়ার সঙ্গেও তার সম্পর্ক চমৎকার। সনাতন আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো তিনি অতীতে কখনো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কটূক্তি করেননি। জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি সবসময় তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন। এটা অনেকেই জানেন সংসদে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এমপিরা যখন সোচ্চার হতেন একসঙ্গে, তখন একপর্যায়ে অনেকটা অসহায়ের মতো তিনি সংসদকে মাছের বাজারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
এই মুহূর্তে আমার বিবেচনায় কয়েকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ক. পুলিশের ভূমিকাকে ‘আগ্রাসী’ অবস্থান থেকে ‘মানবিক’ অবস্থানে নিয়ে আসা। পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারবে, বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মামলা করে তাদের জেলে পুড়বে, তা কাম্য নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেন, তাও শোভন নয়। খ. একটি নির্বাচন হবে। সরকার চাচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘আন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখে নির্বাচনের আয়োজন করতে। এটা যে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না, তা সরকারের নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করতে পারছেন না। বর্তমান ফর্মুলায় নিবার্চন হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে না। বিদেশিরাও এই নির্বাচনকে স্বীকার করে নেবে না। বিদেশি দাতাগোষ্ঠীও সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের পক্ষে।
কিন্তু সরকার এককভাবে নির্বাচন করলে সংকট আরো গভীরতর হবে, যা চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীন মহাজোটের জন্যও কোনো ভালো খবর হবে না। গ. একটি ইসলামপ্রিয় শক্তির উত্তান ঘটেছে বাংলাদেশ। হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড. তাদের ঢাকা অবরোধ ও ঢাকার শাপলা চত্ব¡রে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি জানান দিয়ে গেল তারা একটি ‘শক্তি’ এই শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশে ‘আস্তিক’ ও ‘নাস্তিক’-এর একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। হঠাৎ করে হেফাজতে ইসলাম কেন রাজনৈতিক ময়দানে আবির্ভূত হলো, এটাও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। খুব সহজেই হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে আলোচনা করা যায়। জাতির অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এই তিনটি সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না সত্য, তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উপদেশ ও পরামর্শ দিতে পারেন এবং সরকারের সম্মতি সাপেক্ষে একটি ‘সংলাপ’-এর উদ্যোগ নিতে পারেন। ইতিহাস অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদকে সে রকম একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবেই দেখতে চায়, যিনি চরম সংকটের মুহূর্তে ‘হাল’ ধরেছেন এবং সংকট সমাধানের উদ্যোগী হয়েছেন।
তিনি কতটুকু পারবেন আমরা জানি না। কিন্তু জাতি তার কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশা করে। তিনি সংকট সমাধানে উদ্যোগী হবেন না, এটা প্রত্যাশিত নয়। সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও উচিত হবে রাষ্ট্রপতিকে এই দায়িত্বটি দেয়া। আমার ধারণা রাষ্ট্রপতির যে কোনো উদ্যোগকে বিএনপি ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ তার ইতিহাসে এক কঠিন সময় পার করছে। রাজনীতি ‘নো রিটার্নের’ পর্যায়ে চলে গেছে। কেউই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সরে আসছে না। জাতি উৎকণ্ঠিত। হরতালের পর হরতাল আমাদের জনজীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। তাই রাষ্ট্রপতির একটি ‘উদ্যোগ’ প্রত্যাশিত। গোটা জাতি এখন তাকিয়ে আছে বঙ্গভবনের দিকে।
Daily Manobkontho
25.04.13
পরিস্থিতি আজ এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ১৮ দলকে বারবার হরতাল দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি আজ বড় ধরনের হুমকির মুখে। সিপিডি অর্থনীতিতে অশনি সংকেতের কথা বলেছে। বিদেশি পোশাক আমদানিকারকরা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা নতুন বাজার পেয়েছেন ভিয়েতনাম আর লাওসে। মিয়ানমার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় মার্কিনিদের একটা বড় বাজার হতে যাচ্ছে মিয়ানমার। ইতিমধ্যে বেশকিছু মার্কিন কোম্পানি মিয়ানমারে তাদের অফিস খুলেছে। সেখানে বিনিযোগের সম্ভাবনাও বাড়ছে। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এটা তো সত্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এডিবি তাদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলেছে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ বলা হয়েছিল প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এখন সেটা কল্পনাতেই থেকে গেল। বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। প্রায় ষোলো কোটি মানুষের এই দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটি। প্রতি বছর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। তাদের যদি সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ দেয়া যেত, তাহলে তারা অর্থনীতিতে একটা বড় অবদান রাখতে পারত। যেখানে ইউরোপে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমছে, সেখানে আমাদের বাড়ছে। চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চীনে বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা উৎপাদনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এই বয়স্ক নাগরিকদের পেনশনসহ সামাজিক নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের যে অবস্থান (বর্তমানে দ্বিতীয়), তা আগামী কয়েক দশক পর চীন আর তা ধরে রাখতে পারবে না। এক সময় বিআরআইসি দেশগুলো অন্যতম একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিআরআইসি-এ যোগ দেয়ায় এ জোট শক্তিশালী হয়েছিল, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদ জিম ও নীলের মতে (যিনি ২০০১ সালে ব্রিকসের উত্থান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন) বিআরআইসিএস আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই দুর্বল একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। জিম ও নীল নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট এমআইকেটি-এর কথা বলেছেন আর জর্জ ম্যাগন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যাক গ্লোডস্টোন বলেছেন, অপর একটি জোট টিআইএমবিআই’র কথা। বাংলাদেশের বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত শ্রেণীর উত্থান বাংলাদেশকে আগামী দশকে এমআইকেটি অথবা টিআইএমবিআই জোটে নিয়ে যেতে পারত। বলা ভালো, প্রতিটি দেশের প্রথম আসর নিয়ে নতুন জোটকে পরিচিত করা হচ্ছে, অনেকটা বিআরআইসিএস-এর মতো। যেমন এমআইকেটিতে রয়েছে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক। আর টিআইএমবিআই জোটে রয়েছে তুরস্ক, ভারত মেক্সিকো, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এসব দেশের প্রতিটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। ভারতে দারিদ্র্য থাকলেও (২০১০ সালের হিসাব আনুযায়ী জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক ০২ ভাগ লোক দরিদ্র), বিশ্বব্যাংকের মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। তখন বিশ্বঅর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ (২০০৭ সালে মাত্র ২ ভাগ)। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। তুরস্কের প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের ওপর। ইউরোপে যেখানে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে, সেখানে তুরস্কের অর্থনীতিতে তা এতটুকু প্রভাব ফেলেনি। ভারত ও তুরস্ক এটা করতে পেরেছে। কারণ সেখানে রয়েছে বিপুল শিক্ষিত এক জনগোষ্ঠী। রয়েছে রাজনৈতিক সহনশীলতা। আমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারতাম, আমরাও ভারত ও তুরস্কের কাতারে নিজেদের নিয়ে যেতে পারতাম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এখন আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে তারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সরকারের নির্লিপ্ততা এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার মনে হচ্ছে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কিছু ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার জন্য। সংবাদপত্রে হলমার্ক কেলেঙ্কারি বা বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হলেও ‘পর্দার অন্তরালে’ ক্ষমতাবান লোকদের গ্রেফতার করা হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে সরকারি সোনালী ব্যাংক এখন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে যেখানে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন চার বছর। এই মূল্যায়ন গবেষণা সংস্থা সিপিডির। সিপিডির মতে টানা কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের জটিলতার মধ্যে আছে। সিপিডির গর্বেষণাকর্মকে ফেলে দেয়া যাবে না।
এখন পরিস্থিতি আমাদের যে দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স কাউন্সিল ২০১২ সালের যে গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১৫টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় এশিয়ায় যে ৩টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের কথাও রয়েছে। অপর দুটি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। যুক্তি হিসেবে এনআইসি উল্লেখ করেছে সংঘাতময় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আমরা কোনোভাবে মেলাতে পারব না, এটা সত্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৭০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, বিরোধী দলের নেতাদের ওপর গুলিবর্ষণ, তাদের আহত করা ও গ্রেফতার, গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের গাড়িতে আগুন (আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিলে) কিংবা ১২ এপ্রিল খুলনায় ভারতীয় হাইকমিশনারের গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা এ কথাই প্রমাণ করে বাংলাদেশ বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অস্থিরতা একদিকে যেমনি গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে তেমনি জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। এর সঙ্গে এখন যোগ হলো লাগাতার হরতালের বিষয়টি।
এমনি এক পরিস্থতিতে দেশের বিশতম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বটি গ্রহণ করলেন আব্দুল হামিদ। রাজনীতিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞ তিনি। ১৯৭০ সালে তরুণ বয়সে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকে তাকে আর পিছু তাকাতে হয়নি। তিনি তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, সরলতা নিয়ে বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করবেন, এটাই মানুষের প্রত্যাশা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বিরোধী সব দলের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। আজো তিনি সে রকম একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে জাতি আজ বিভক্ত। দেশের সুশীল সমাজ, এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে তাদের অভিমত দিলেও সরকার এখনো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে আন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখেই নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু বিরোধী দল এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা আগামী অক্টোবরে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এই পরিস্থিতি পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান কোনো আশার কথা বলে না। প্রতিনিয়ত মানুষ এক আশঙ্কার মধ্যে থাকে। থাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে। যদিও সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত এবং সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া তিনি কোনো কিছুই করতে পারবেন না আগামীতে। তারপরও তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতি। তিনি জাতির অভিভাবক। সাংবিধানিকভাবে না হলেও সংকটকালীন সময়ে তিনিই পালন করতে পারেন একটি বড় ভূমিকা। এই বাংলাদেশকে আমরা চাইনি। হরতাল আজ আমাদের জন্য একটি অভিশাপ। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। পরস্পর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের রাজনীতি শুরু করা দরকার। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, দারিদ্র্য বিমোচন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমাদের কাম্য। আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক অনৈক্য আমাদের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। দীর্ঘ ৪২ বছর পার করার পর আমাদের উপলব্ধিতে যদি পরিবর্তন না আসে, তা হলে আমরা বিশ্ব আসরে এক সময় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিতি পাব। তাই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা জানি সাংবিধাকভাবে তার ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু জাতির অভিভাবক হিসেবে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আমরা জানি ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকেরই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বেগম জিয়ার সঙ্গেও তার সম্পর্ক চমৎকার। সনাতন আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো তিনি অতীতে কখনো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কটূক্তি করেননি। জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি সবসময় তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন। এটা অনেকেই জানেন সংসদে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এমপিরা যখন সোচ্চার হতেন একসঙ্গে, তখন একপর্যায়ে অনেকটা অসহায়ের মতো তিনি সংসদকে মাছের বাজারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
এই মুহূর্তে আমার বিবেচনায় কয়েকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ক. পুলিশের ভূমিকাকে ‘আগ্রাসী’ অবস্থান থেকে ‘মানবিক’ অবস্থানে নিয়ে আসা। পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারবে, বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মামলা করে তাদের জেলে পুড়বে, তা কাম্য নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেন, তাও শোভন নয়। খ. একটি নির্বাচন হবে। সরকার চাচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘আন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখে নির্বাচনের আয়োজন করতে। এটা যে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না, তা সরকারের নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করতে পারছেন না। বর্তমান ফর্মুলায় নিবার্চন হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে না। বিদেশিরাও এই নির্বাচনকে স্বীকার করে নেবে না। বিদেশি দাতাগোষ্ঠীও সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের পক্ষে।
কিন্তু সরকার এককভাবে নির্বাচন করলে সংকট আরো গভীরতর হবে, যা চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীন মহাজোটের জন্যও কোনো ভালো খবর হবে না। গ. একটি ইসলামপ্রিয় শক্তির উত্তান ঘটেছে বাংলাদেশ। হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড. তাদের ঢাকা অবরোধ ও ঢাকার শাপলা চত্ব¡রে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি জানান দিয়ে গেল তারা একটি ‘শক্তি’ এই শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশে ‘আস্তিক’ ও ‘নাস্তিক’-এর একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। হঠাৎ করে হেফাজতে ইসলাম কেন রাজনৈতিক ময়দানে আবির্ভূত হলো, এটাও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। খুব সহজেই হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে আলোচনা করা যায়। জাতির অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এই তিনটি সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না সত্য, তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উপদেশ ও পরামর্শ দিতে পারেন এবং সরকারের সম্মতি সাপেক্ষে একটি ‘সংলাপ’-এর উদ্যোগ নিতে পারেন। ইতিহাস অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদকে সে রকম একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবেই দেখতে চায়, যিনি চরম সংকটের মুহূর্তে ‘হাল’ ধরেছেন এবং সংকট সমাধানের উদ্যোগী হয়েছেন।
তিনি কতটুকু পারবেন আমরা জানি না। কিন্তু জাতি তার কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশা করে। তিনি সংকট সমাধানে উদ্যোগী হবেন না, এটা প্রত্যাশিত নয়। সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও উচিত হবে রাষ্ট্রপতিকে এই দায়িত্বটি দেয়া। আমার ধারণা রাষ্ট্রপতির যে কোনো উদ্যোগকে বিএনপি ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ তার ইতিহাসে এক কঠিন সময় পার করছে। রাজনীতি ‘নো রিটার্নের’ পর্যায়ে চলে গেছে। কেউই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সরে আসছে না। জাতি উৎকণ্ঠিত। হরতালের পর হরতাল আমাদের জনজীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। তাই রাষ্ট্রপতির একটি ‘উদ্যোগ’ প্রত্যাশিত। গোটা জাতি এখন তাকিয়ে আছে বঙ্গভবনের দিকে।
Daily Manobkontho
25.04.13
0 comments:
Post a Comment