হত্যাযজ্ঞের তালিকায় আরেকটি নাম যোগ হলো। রানা প্লাজা। এত মৃত্যু আগে কেউ কখনো দেখেনি। তাজরীন গার্মেন্ট ২০১২, স্পেকট্রাম ২০০৫, তেজগাঁওয়ে ফিনিক্স ভবন ২০০৬, বেগুনবাড়ীতে ভবনধস ২০১০। কিন্তু রানা প্লাজায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ডকে। কত মৃত্যু হলো রানা প্লাজায়? শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ২৯০ ছাড়িয়ে গেছে। এ সংখ্যা আরো বাড়বে। কিন্তু এই মৃত্যু কি আমাদের বিবেককে এতটুকুও স্পর্শ করেছে? করলে কতটুকু করেছে? রাশেদ খান মেনন বললেন, 'রানা প্লাজায় হত্যাকাণ্ড গণহত্যার সমতুল্য' (নতুন বার্তা)। বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ মেনন। শ্রমিকদের নিয়েই তাঁর আজীবনের কাজ। তিনি তুলনা করতেই পারেন। কিন্তু একি কথা শুনলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে! বললেন, 'কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে- ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে' (বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকার, আরটিএন)। বিজ্ঞ মানুষ ম খা আলমগীর। পাকিস্তানি জামানার সিএসপি, একটা পিএইচডিও আছে। কিন্তু তিনি যেমন অবিবেচকের মতো কথা বললেন, এটা আশা করিনি। তবু ভাগ্য ভালো, তিনি 'নাড়াচাড়ার ঘটনাকে' 'সম্ভাব্য একটা কারণ' বলেছেন- 'একমাত্র কারণ' বলেননি! আমাদের দুর্ভাগ্য, এ ধরনের কথা আমাদের শুনতে হয় বারবার। আর এর মধ্য দিয়েই পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। জানা যায়, সেদিন গার্মেন্টকর্মীদের জোর করে কাজে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। গার্মেন্টকন্যারা ছুটি চাইলেও তাদের ছুটি দেওয়া হয়নি। এই মৃত্যুর দায়ভার পোশাক কারখানার মালিকরা এড়াতে পারেন না। পোশাক রপ্তানিকারকরা আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আনেন- সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু 'নিশ্চিত মৃত্যুর' মুখে তৈরি পোশাককর্মীদের ঠেলে দেওয়ার সঙ্গে এই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে আমরা মেলাতে পারব না।
আমরা কতগুলো দৃশ্য ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। একেকটি তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে (অথবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন তৎপর হন। টিভি ক্যামেরার সামনে গর্ব করে বলেন, 'আইন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা হবে।' কিন্তু সেই 'বিচার' আর কোনো দিন হয় না। বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখ প্রকাশ করে। মাথাপিছু এক লাখ (কিংবা দুই লাখ) করে 'মৃত্যু সম্মানী' দেয়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয় একাধিক। এরপর এক সময় মানুষ ভুলে যায় সব। হাজারটা 'সমস্যার' ভিড়ে আমরা মনেও করতে পারি না তাজরীনে কিংবা স্পেকট্রামে কজন গার্মেন্টশ্রমিক মারা গিয়েছিল। আমাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দেয় সংবাদপত্রগুলো। আমাদের হতাশ করে যখন দেখি তাজরীন গার্মেন্ট মালিকের কোনো শাস্তি হয়নি। স্পেকট্রাম গার্মেন্টের মালিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালের পর প্রায় অর্ধশত ভবন ধসে পড়েছে, যার মধ্যে আটটি ভয়াবহ। কোনো একটি ক্ষেত্রেও একজন মালিক তথা ভবন নির্মাণের দুর্নীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তি হয়নি। তাঁরা দায়মুক্তি পেয়ে গেছেন। আজ রানা প্লাজার মালিকও দায়মুক্তি পাবেন- এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। আমরা তখন অপেক্ষা করব একটি অনুষ্ঠানের জন্য- সেখানে মন্ত্রীরা থাকবেন। বিজিএমইএর নেতারা থাকবেন। উপস্থিত থাকবেন পোশাককন্যার মা অথবা বাবা। এক লাখ টাকার একটি চেক তাঁরা পাবেন। টিভি সে দৃশ্য ধারণ করবে। 'সন্তুষ্টচিত্তে' প্রয়াত পোশাককন্যার মা বা বাবা ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। একেকটি মৃত্যুর 'মূল্য' এক লাখ টাকা! কী পরিহাস! 'চিত্রনাট্য' এভাবেই তৈরি করা আছে। তাজরীনের ঘটনায় এভাবেই 'চিত্রায়িত' হয়েছে দৃশ্য। স্পেকট্রামেও তাই হয়েছিল।
আমরা কি পারি না একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে? আমরা কি পারি না অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে? অতীতে হয়নি বলে এবারও হবে না, তা তো হতে পারে না। দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি, রানা প্লাজায় হত্যাকাণ্ডের যদি বিচার না হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। কতগুলো বিষয় এখন বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। ১. রানা প্লাজার মালিক কোনোভাবেই দায়মুক্তি পেতে পারেন না। তিনি অন্যায়ভাবে ছয়তলা ভবনকে ৯ তলায় উন্নীত করেছেন। রাজউকের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা হওয়া সত্ত্বেও তিনি অনুমতি নিয়েছেন সাভার পৌরসভা থেকে। এটা অবৈধ। অন্যায়। ২. পৌরসভার অনুমতি নিয়েই ভবনটি হয়েছে। কিন্তু রাজউক কেন এর তদারকির দায়িত্বটি পালন করল না? সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকেও এ মৃত্যুর দায়ভার নিতে হবে। ৩. মঙ্গলবার ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ায় ব্র্যাক ব্যাংক যদি তাদের শাখা বন্ধ করে দিতে পারে, তাহলে গার্মেন্ট মালিকরা কেন কারখানাগুলো বন্ধ করলেন না? তাঁদেরও বিচার করতে হবে হত্যাকাণ্ডের অপরাধে। ৪. সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবীর হোসেন সরদারের বক্তব্য ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। তিনি মঙ্গলবার ফাটল পরিদর্শন করে বলেছেন, 'ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই।' মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তিনি একটা অপরাধ করেছেন। অদক্ষতা ও অকর্মণ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রশাসনে এ ধরনের অযোগ্য লোক যত দিন থাকবে, তত দিন প্রশাসন সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারবে না। মৃত্যুর দায়ভার তাঁরও। দ্রুত তাঁকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। ৫. বারবার নগর উন্নয়ন আইন ১৯৫৩ ও ইমারত বিধিমালা ২০০৮-এর ব্যত্যয় ঘটেছে। এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। এই আইন কেউ মানে না। ৬. পোশাক কারখানাগুলো তদারকির জন্য একটি 'কমিটি' রয়েছে কাগজে-কলমে। হয়তো কর্মকর্তাও রয়েছেন, যাঁরা কাজ না করেই বেতন নিচ্ছেন। এ কমিটিকে আরো তৎপর হতে হবে। ৭. যেহেতু রানা প্লাজার ঘটনায় অনেক মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে, সেহেতু মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। উচ্চ আদালতের কাছে হত্যাকাণ্ডের বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাইতে হবে। ৮. নারী সংগঠনগুলোও তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য এড়াতে পারে না। পোশাককন্যাদের জীবনের নিরাপত্তার দাবিতে তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। ৯. পোশাক কারখানাগুলোয় 'কমপ্লায়েন্স'-এর কথা বারবার বলা হচ্ছে। যেসব কারখানা কমপ্লায়েন্সের নীতিমালা অনুসরণ করবে না, সেই কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। ১০. রানা প্লাজার ঘটনা বিদেশে আমাদের পোশাক শিল্পকে আবারও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এখন 'বাংলাদেশি পোশাক বয়কট'-এর আরো হুমকি আসতে পারে।
রাশেদ খান মেনন যে গণহত্যার কথা বলেছেন, এটিকে আমি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে চাই। এই গণহত্যার বিচার হওয়া প্রয়োজন। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কিংবা সরকারি আনুকূল্য নিয়ে অপরাধীরা যদি পার পেয়ে যায়, তা হবে দুঃখজনক একটি ঘটনা। শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নাম করে আমরা আমাদের সন্তানদের বারবার মৃত্যুকূপে ঠেলে দিতে পারি না।Daily KALERKONTHO27.04.13
0 comments:
Post a Comment