রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই

¦



গত ২ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এটা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল। গত মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরের সময় এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এখন একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদিত হলো। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাশিয়া দেবে ৪ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। এর আগেও বণিক বার্তায় লিখেছিলাম, একটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে থেকেও বাংলাদেশ এসব সিদ্ধান্ত নিল। বিশেষ করে জাপানের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দেশেও ফুকুসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ তারা ঠেকাতে পারেনি। ফুকুসিমায় বিস্ফোরণ জাপানের অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, এ ব্যাপারে মোটামুটিভাবে আমরা সবাই অবগত। এখন যে প্রশ্নটি করা যায়, তা হচ্ছে রূপপুরের এ পারমাণবিক প্রকল্প কি আমাদের জ্বালানি সংকটের কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারবে?
পারমাণবিক প্রকল্প ব্যয়বহুল তো বটেই, চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতেও অনেক সময়ের প্রয়োজন। আমাদের ন্যূনতম ছয় থেকে আট বছর অপেক্ষা করতে হবে এ প্রকল্পটি চালু হতে। অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি ২০২০ সালের আগে রূপপুর থেকে কোনো বিদ্যুৎ পাব না। তাহলে বিদ্যুতের যে বিশাল চাহিদা, তা আমরা পূরণ করব কীভাবে? বিদ্যুৎ উত্পাদনের একটি বিকল্প সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই সম্ভাবনার এখন ‘মৃত্যু’ হতে বসেছে! আমাদের যে বিপুল কয়লাসম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে চাহিদামতো বিদ্যুৎ পেতে পারি। কিন্তু এ কয়লার উত্তোলন আটকে আছে একটি ইস্যুতে— কোন পদ্ধতিতে আমরা কয়লা তুলব? সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে। এখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে জনমত বেশি বলেই মনে হচ্ছে, যদিও একটি জাতীয় কমিটি এর বিরোধিতা করেছে। গত ৪ ডিসেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন (যুগান্তর) থেকে জানা যায়, পরিকল্পনা কমিশন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে অভিমত দিয়েছে। এর আগে একটি সংসদীয় কমিটিও একই ধরনের অভিমত দিয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে কয়লার বিশাল রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও আমরা ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্কের জন্ম হয়েছে। ভারতের কয়লা নিম্নমানের, সেটা একটা সমস্যা। অন্যদিকে খুলনায় যেখানে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উত্পাদন হবে, তা সুন্দরবনের খুব কাছে। এতে করে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড় ঝুঁকির মুখে থাকবে। স্থানীয় পর্যায়ে এর বিরোধিতা রয়েছে। এ বিরোধিতার খবর জাতীয় পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে। বলা ভালো, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় হবে ১৩ হাজার ২০০ কোটি ভারতীয় রুপি, যা কিনা বাংলাদেশী মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার সমান। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমদানি করা কয়লা নিয়ে এই কেন্দ্র দুটিতে বিদ্যুৎ উত্পাদন হবে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারত সমান অংশীদারিত্বে বিদ্যুকেন্দ্র দুটির ব্যয়ভার বহন করবে। চুক্তির বিস্তারিত আমরা জানি না। সংবাদপত্রে তা প্রকাশিতও হয়নি। তবে ভারতীয় কয়লা আমদানি কেন? আমাদের কি কয়লা সম্পদ নেই, যা দিয়ে আমরা বিদ্যুেকন্দ্র দুটি চালাতে পারি?
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে ভালো জাতের বিটুমিনাস কয়লা পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় যে কয়লা পাওয়া গেছে, তা ভূপৃষ্ঠের ১১৯ মিটার থেকে ৫৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। মোট ছয়টি কয়লা স্তর পাওয়া গেছে, যার পুরুত্ব সর্বনিম্ন ৩ মিটার এবং সর্বোচ্চ ৮২ মিটার। মোট মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে কয়লাখনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ভূপৃষ্ঠের ৬৪০ মিটার থেকে ১ হাজার ১৫৮ মিটার গভীরতায় সাতটি কয়লাস্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার এবং আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১ হাজার ৫৩ মিলিয়ন টন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফুলবাড়ীর এ কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৭ সালে এবং কয়লা মজুদ নিশ্চিত হয়েছে ৫৭২ মিলিয়ন টন।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও তাতে এখন ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয়জন। এরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করছিল। এখানে বলা ভালো, ১৯৯৪ সালে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে সরকার ব্রকেন হিল প্রপার্টি সংক্ষেপে বিএইচপি নামে এক অস্ট্রেলীয় কোম্পানির সঙ্গে অনুসন্ধান চুক্তি করে। পরে ১৯৯৭ সালে ওই কোম্পানি এশিয়া এনার্জি নামে এক ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে লিজিং লাইসেন্স বিক্রি করে। এশিয়া এনার্জি ৩০ বছরের জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের অধিকার লাভ করলেও বিনিময়ে বাংলাদেশ সরকার পাবে রয়েলটি হিসেবে উত্তোলিত কয়লার মাত্র ৬ শতাংশ! এটাও বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশে খনি বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও কোন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা লাভজনক, সে ব্যাপারেও দ্বিমত রয়েছে। একদল উন্মুক্ত পদ্ধতির পক্ষে। অন্যদল সুড়ঙ্গ পদ্ধতির পক্ষে। এমনকি বামমনা রাজনীতিকদের বক্তব্য থেকেও দেখা যায়, তারা সুড়ঙ্গ পদ্ধতির পক্ষে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সুড়ঙ্গ পদ্ধতি আমাদের জন্য কতটুকু লাভজনক? ভারতের সেন্ট্রাল মাইন প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. অজয় কুমার ঘোষ এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা গেলে ফুলবাড়ী থেকে শতকরা ৯০ ভাগ কয়লা তোলা সম্ভব। এমনকি পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ভূতত্ত্ববিদ ড. ইউনুস আকনও এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা সফলভাবে সম্ভব। ভারতে উত্পাদিত কয়লার শতকরা ৮১ ভাগ আসে উন্মুক্ত পদ্ধতি বা ওপেন কাস্ট মাইনিং থেকে। ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা ভাবনা: অপ্রচলিত ধারণা’ শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখেছি, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে শতকরা ২০ ভাগের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হয় না (গবেষণাকর্মটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে)। বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্রের বেলায় দেখা গেছে, শতকরা ১০ ভাগ কয়লা তোলাও সম্ভব হচ্ছে না।
সরকার পারমাণবিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে শুধু একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে দেশের বিপুল জ্বালানি চাহিদা মোকাবেলা করা। চূড়ান্ত বিচারে পারমাণবিক প্রকল্প কোনো সমাধান নয়। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ বিদ্যুৎ উত্পাদনের জন্য কয়লার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল (যেমন অস্ট্রেলিয়া ৭৯ শতাংশ, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২ শতাংশ)। ফুলবাড়ী কয়লাখনি নিয়ে বড় অভিযোগ— কৃষি তথা বসতভিটা অধিগ্রহণ, পানিশূন্যতা, ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ইত্যাদি। জাতীয় কমিটি এ বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তবে পরিকল্পনা কমিশন যে মতামত দিয়েছে, (যুগান্তর) তাতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন
সম্ভব বলে জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সময়কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় ১ হাজার ২০০ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাতে ১০-১২ হাজার বাসিন্দা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তাই রূপপুর প্রকল্প আমাদের জ্বালানিসংকটের কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উত্পাদন হয় গ্যাস থেকে (৮৭ শতাংশ), কয়লা (৩ দশমিক ৭ শতাংশ), বাকি ফার্নেস অয়েল, জলবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য উত্স থেকে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রমাণ হয়েছে, গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারও হচ্ছে না। ফলে কয়লার ব্যাপারে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ এক বড় ধরনের ‘এনার্জি ট্র্যাপ’ বা জ্বালানি ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে যাওয়া আর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় আমাদের বিপুল জ্বালানি চাহিদার উত্স কয়লাই। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প কোনো সমাধান নয়। কয়লাই আমাদের ভরসা।
Bonik Barta
06.14.13

0 comments:

Post a Comment