রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সরকারের পদত্যাগই কাম্য


গেল সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে পুনরায় গুলি করে মানুষ হত্যা ও বেগম জিয়া সম্পর্কে সরকার প্রধানের একটি অনাকাক্সিত ও আপত্তিকর মন্তব্যের পর ১৮ দলীয় জোটের সাথে একটি সংলাপের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তার গুরুত্ব ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে সরকারের পদত্যাগ দাবি করা ছাড়া ১৮ দলীয় জোটের কাছে কোনো বিকল্প কিছু নেই। উপরন্তু জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে সরকার একের পর এক ‘ফ্রন্ট ওপেন’ করার মধ্য দিয়ে নিজেরাই সব ধরনের সংলাপের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী  সমাজ, এমনকি দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের প্রায় সবাই একবাক্যে দশম সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করার দাবি জানিয়ে আসলেও সরকার এ পথে হাঁটছে না। প্রকাশ্যে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ প্রতিবাদ করা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অংশ। প্রতিবাদ না হলে কিংবা বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড না থাকলে অথবা না করতে দিলে, সেই  সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। সরকারের বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সরকার এখন একটা ‘যেনতেন ভাবে’ নির্বাচন করতে চায় এবং পুনরায় লুটপাটের জন্য আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়। অনেকেই জানেন সরকার যে রূপকল্প ২০২১ প্রণয়ন করেছে, তার উদ্দেশ্য একটাই যেভাবেই হোক, ক্ষমতায় ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকা। এ ক্ষেত্রে জনমতের প্রতি তাদের এতটুকু শ্রদ্ধাবোধ নেই। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এ দেশের তিনটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক, যারা কী না আবার সরকারি দলের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে, তারা একটি জনমত জরিপ চালিয়েছিল। এই তিনটি সংবাদপত্রের  জনমত জরিপে দেখা গেছে জনগণের একটা বড় অংশ চাচ্ছে আগামী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই দায়িত্বটি দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। যেভাবে ‘পাখির মতো’ গুলি করে সাধারণ মানুষকে  মারা হয়, তা কোনো সভ্য সমাজে বিরল। সরকারের এজেন্ডা এখন একটাই। একদিকে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা দেয়া, অন্যদিকে শিবিরের তরুণ প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান ইন্তিকাল করায় দেশে নতুন করে একটি ‘সঙ্কট’ তৈরি হয়েছে। কে প্রেসিডেন্ট হবেন, এর উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ এবং সেই সাথে দু’জন সিনিয়র সিটিজেন অধ্যাপক বি. চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের অভিমতও গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া প্রয়োজন। দেশের এ দু’জন সিনিয়র সিটিজেন নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথা নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের দৃষ্টি এ দিকে নেই। প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বিএনপি যে সম্মান ও উদারতা দেখিয়েছে, সরকার তার প্রতি এতটুকু সম্মান জানায়নি। গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের তো সরকার ছেড়ে দিতে পারতো। কিন্তু সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং নতুন করে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার নামে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। বগুড়ায় বেগম জিয়ার একটি বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছে সরকারের মন্ত্রীরা। শুধু তাই নয়, অসৌজন্যমূলকভাবে বেগম জিয়ার সমালোচনা করা হয়েছে। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করারও হুমকি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বিএনপির শ্রদ্ধা একটি সংলাপের তথা সমঝোতার সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে বলে ধারণা করছি। ২৭ ও ২৮ মার্চ ১৮ দলের উদ্যোগে আবারও হরতাল পালিত হয়েছে। সেই হরতালেও মানুষ মারা গেছে। হরতালে পুলিশের গুলি এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ১৭৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও ১৮০ কোটি ডলার আমানত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার শর্ত দিয়েছে কাতার। সেই সাথে কুয়েতের ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব পিছিয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দু’টি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব ঝুলে আছে। বিশ্বব্যাংকের সাথে দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সর্বশেষ জের হিসেবে বিশ্বব্যাংক ওয়াসার প্রকল্প থেকে ৯৮ মিলিয়ন ডলার প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সংবাদপত্রে অর্থনীতির নেতিবাচক দিকগুলো প্রকাশিত হলেও সরকারের দৃষ্টি এদিকে নেই। সরকার এখনও ব্যস্ত ‘শাহবাগ আন্দোলন’ নিয়ে। নতুন করে সরকারি উদ্যোগে একটি ‘নাগরিক সমাজ’ গঠিত হয়েছেÑ উদ্দেশ্য একটাই তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা। যেখানে একটি বিচার হচ্ছে, সেখানে এভাবে আন্দোলনকে উসকে দেয়া ‘বিচার বিভাগের ওপর অনেকটা হস্তক্ষেপের সামিল’, এ ধরনের অভিযোগ সুশীল সমাজের কাছ থেকে উচ্চারিত হলেও সরকার ‘অন্ধ’ ও ‘বয়রা’। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আগ্রহ সরকারের নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের বাঁচাতে সরকার একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে। আরো দুঃখজনক সংবাদ হচ্ছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে সরকার ব্যবহার করছে তাদের স্বার্থে। গত ২৮ মার্চ সরকার প্রধান সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই, বাংলাদেশ তো বটেই, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ। কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনী নিজেদের জড়িত করে না। প্রধানমন্ত্রী সেখানে একটি দলের প্রতি ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে কটাক্ষ করা ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করাসহ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সময়োপযোগী নয়। এসব রাজনৈতিক বক্তব্য সেনাকুঞ্জে না দেয়াই মঙ্গল। এ দেশের মানুষ জানে ৩ নভেম্বর (১৯৭৫) এ দেশে কী ঘটেছিল। সেদিন তথাকথিত ‘সিপাই বিপ্লব’ নামে যারা সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, তারা আজ সরকারের শরিক, মন্ত্রীও হয়েছেন। সেনাবাহিনী হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের মদতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, সেদিন সেনাবাহিনী দেশকে রক্ষায় রক্ত দিয়েছিল। দুঃখলাগে যখন দেখি সেদিন যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ করেছিল, সরকার তাদের নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে লালন-পালন করছে। অথচ বেশ কিছু সেনাক্যাম্প গুছিয়ে ফেলা হয়েছে। যার ফলে সেখানে নতুন করে জন্ম হয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
বাংলাদেশ হচ্ছে অদ্ভূত একটা দেশ, যেখানে দুনীতিবাজদের রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় দেয়া হয়। মন্ত্রীকে ঘুষের টাকা পৌঁছে দিতে গিয়ে ধরা পরেছিলেন মন্ত্রীর এপিএস। জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রী পদত্যাগও করেছিলেন। কিন্তু সরকার প্রধান তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে রেখে দিলেন। কিন্তু কেন? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। সরকার দুর্নীতি দমন করছে না, বরং দুর্নীতি লালন করছে। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু সরকারের কোনো উৎসাহ নেই দুর্নীতি দমনের। তাই এ সরকার যত বেশিদিন ক্ষমতায় থাকবে, ততবেশি দুর্নীতি বাড়বে। যারা সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক, তারা লক্ষ্য করেছেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় সরকার বলেনি, কারা এই কাজগুলো করছে। আমরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা বললেও সরকার তা করেনি। অথচ কিছু মিডিয়াকে ব্যবহার করে দোষ চাপানো হচ্ছে বিরোধী দলের উপর। কোনো কোনো সংবাদপত্রে এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছিল যে, মন্দিরে ও বৌদ্ধমঠে সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের কর্মীরা এই আগুন লাগিয়েছে। সরকার এ ক্ষেত্রে পারতো পূর্ণ তদন্ত করে দুষ্কৃতিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে। কিন্তু সরকার তার সমর্থকদের ‘প্রটেকশন’ দিয়ে যাচ্ছে।
গত ৩০ মার্চ আরো একটি উদ্বেগজনক খবর ছাপা হয়েছে একটি অনলাইন সংবাদপত্রে। উক্ত সংবাদে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। পুলিশের হাতে নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গুলি করে মানুষ মারার নির্দেশের পর ‘জাতিসংঘে’র এই উদ্বেগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের আওতায় এই বিশেষজ্ঞ দলটি কাজ করে। তারা সম্প্রতি যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বাক স্বাধীনতা খর্ব করা, ন্যায় বিচারের অনিশ্চয়তার বিষয়টি উঠে এসেছে। উক্ত বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ক্রিস্টোফ হেন্স দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করারও আহ্বান জানিয়েছেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দলের এই প্রতিবেদনটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আমরা বার বার বলে আসছিলাম প্রায় ১৭১ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে মারাত্মকভাবে। একই সাথে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে তারা যে মন্তব্য করেছে ও বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার যে দাবি জানিয়েছে, তা মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগেরই প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশের পক্ষ থেকে এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকার এদিকে দৃষ্টি দিয়েছে কম। কিন্তু দ্রুত তথাকথিত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একাধিক ‘ফ্রন্ট’ তৈরি করেছে। একটি তথাকথিত নাগরিক সমাজও গঠন করা হয়েছে সরকারের সুবিধাভোগী কিছু লোক নিয়ে। সুতরাং এই মুহূর্তে সরকারের কাছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করা অর্থহীন। এই মুহূর্তে দাবি একটাইÑ সরকারের পদত্যাগ। এই দাবির জন্য প্রয়োজনে লাগাতার হরতালের মতো কর্মসূচিও দিতে হবে। জনগণের সাময়িক কষ্ট হবে সত্য। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে মানুষ সাময়িক কষ্ট স্বীকার করতেও রাজি।
05.04.13

0 comments:

Post a Comment