সাভার
ট্র্যাজেডি আমাদের বিবেক ও রাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। এই
ঝাঁকুনি আমাদের ভবিষ্যৎ পথকে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কতটুকু
প্রভাবিত করবে এটা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও এটা বলা যায়, এই ঘটনার একটি
সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে যাবেই। এই ঘটনায় কত মানুষ মারা গেল, কত মানুষকে
উদ্ধার করা হলো, বিষয়গুলো খুব মানবিক এবং সন্দেহ নেই এই মর্মান্তিক ঘটনা
অর্থাৎ সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য একটি মেসেজ পৌঁছে দিল।
নীতি-নির্ধারকরা এ ব্যাপারে যদি সিদ্ধান্ত নেন তা জাতির জন্য মঙ্গলই বয়ে
আনবে। প্রথমত, এ ধরনের একটি মানবিক বিপর্যয়ে যে সাধারণ মানুষ, ছাত্র,
সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাসহ সবাই এক হয়ে যেতে
পারেন তা আবার প্রমাণিত হলো। এনাম মেডিকেল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাষ্ট্র এই দুই
প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পদকে সম্মানিত করুক এবং অংশগ্রহণকারীদের জাতীয় বীর
হিসেবে ঘোষণা করা হোক। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের একটি মানবিক বিপর্যয়ে দুর্যোগ
ব্যবস্থাপনা অধিদফতর যে ব্যর্থ তা প্রমাণিত হলো। অধিদফতরের কর্মকর্তারা
বিদেশ সফরে যান ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জনের জন্য। কিন্তু দেশের কাজে তারা সেই
অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের তিরস্কৃত করা হোক। দুর্যোগ
ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি ছেড়ে দেয়া হোক সেনাবাহিনীর কাছে। প্রয়োজনে
সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ সেনাকর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরেই আলাদা
একটি ইউনিট তৈরি করা হোক। তৃতীয়ত, স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ট্র্যাজেডির পর
আমরা ২০০ কোটি টাকা দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছিলাম। এখন দেখা গেল
সেগুলো কোনো কাজে লাগল না। আমাদের এখন জোর দিতে হবে ছোট ছোট যন্ত্রপাতি
ক্রয় করার বিষয়ে, যা দিয়ে দ্রুত পাথর (কংক্রিট) কাটা যায়। দুঃখজনক হলেও
সত্য, সাভারে রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আমরা হাতুড়ি আর হ্যাঁচকো ব্লেড দিয়ে
পাথর ও রড কেটে গর্ত করে করে মানুষ উদ্ধার করতে দেখেছি। তাতে সময় পেরিয়ে
গেছে অনেক। দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা না পৌঁছার কারণে মানুষ মারা গেছে।
চতুর্থত, সাভার ট্র্যাজেডিতে আমরা দেখেছি আমাদের নেতারা পার্শ্ববর্তী
দেশগুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি এবং তাদের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেননি। অথচ
এসব ক্ষেত্রে ভারত ও জাপানের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখন প্রয়োজন ওইসব
দেশের বিশেষ বিশেষ সংস্থার সঙ্গে ‘হটলাইন স্থাপন’ করা, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত
তাদের পরামর্শ নেয়া যায়। পঞ্চমত, এটা এখন স্পষ্টতই প্রমাণিত যেসব ভবনে
গার্মেন্টস রয়েছে, সেই ভবনগুলো সুরক্ষিত নয়। প্রায় ৪০০০ গার্মেন্টস রয়েছে,
যার মাঝে প্রায় ৩৫০০টি গার্মেন্টসে নিয়মিত কাজ হয়। এখন খুব দ্রুত প্রতিটি
ভবন পরীক্ষা করা হোক। বুয়েটের সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক ও সেনাবাহিনীর
ইঞ্জিনিয়ার কোরের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হোক একাধিক কমিটি। এক সপ্তাহের মধ্যে
তারা সরকারের কাছে রিপোর্ট দেবে। যেসব ভবন সুরক্ষিত নয় কিংবা বিল্ডিং কোড
অনুসরণ করে তৈরি করা হয়নি, সেসব ভবন বন্ধ করে দেয়া হোক। এখানে কোনো শৈথিল্য
দেখানো যাবে না। প্রতিটি ভবনে একাধিক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, অক্সিজেন
সিলিন্ডার, উন্মুক্ত যাতায়াতের পথের ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটি পোশাক
কর্মীর জীবন বীমা (১০ লাখ টাকা ন্যূনতম) বাধ্যতামূলক করা হোক। ষষ্ঠত, তৈরি
পোশাক শিল্প আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস। এই খাতকে প্রায়োরিটি দেয়া
হোক। বছরে প্রায় ২০ কোটি ডলারের বাজার এই তৈরি পোশাকের। সস্তা শ্রমের কারণে
ও তৈরি পোশাকের কম মূল্য হওয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা থাকবেই। তাই এখানে
গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে যদি ‘কমপ্লায়েন্স’-এর নীতিমালা অনুসরণ করা না
হয়, তাহলে অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা
আসবে। সাভারের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে, কানাডার
টরেন্টোতে বিক্ষোভ হয়েছে। মার্কিন ট্রেড ইউনিয়নগুলো তৎপর হয়েছে। বাংলাদেশ
যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে বাংলাদেশ এক কঠিন সময়ের মধ্যে পড়বে।
সপ্তমত, একসময় যে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে আমরা
সক্ষম হব। কিন্তু ক্ষত রয়ে যাবে। পা হারানো, হাত কাটা পঙ্গু পোশাক কর্মীদের
পুনর্বাসন খুবই জরুরি। সরকার একটি ফান্ড গঠন করুক, যাতে সহযোগিতা করবেন
ব্যাংকাররাসহ সব ব্যবসায়ী। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে যেসব সেনা অফিসার প্রাণ
হারিয়েছিলেন, তাদের পরিবারের জন্য এককালীন ও মাসোহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে,
সে রকম ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রেও করা হোক। ব্যাংকগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার
আওতায় এই ফান্ডে নিয়মিত টাকা দিয়ে যাচ্ছে। সাভার ট্র্যাজেডিতে যারা প্রাণ
হারিয়েছেন এবং যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের এককালীন ও প্রতি মাসে একটা
ভাতার ব্যবস্থা করা হোক। আর বাচ্চাদের জন্য ব্যবস্থা করা হোক সরকারি
বৃত্তির। আমার ধারণা এদেশের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি রয়েছেন, বিশেষ করে যারা
তৈরি পোশাক রফতানি করে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়েছেন; তারা এই বৃত্তির টাকা দিতে
পারেন। তাদের নামে বৃত্তি চালু হতে পারে। উদ্যোগটি নিতে হবে বিজিএমইএকেই।
অষ্টমত, সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য একটা ‘ওয়েকআপ’ কল। ঢাকা শহরে এখন
হাইরাইজ ভবনের সংখ্যা অনেক। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে
তোলা হয়েছে জাপান গার্ডেন সিটি। একাধিক বহুতল ভবন রয়েছে এখানে। আমার নিজের
চোখে দেখা দশ বছর আগেও ছিল এটি ইটখোলা, ডোবানালা বৈশিষ্ট্য পরিত্যক্ত একটি
এলাকা। যে কোনো সময় এখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাভার ট্র্যাজেডি
প্রমাণ করল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো প্রশিক্ষিত জনশক্তি এবং যন্ত্রপাতি
আমাদের নেই। এটা এখন আমাদের সবার জন্যই ভাবনার ব্যাপার। সরকার একটি
‘ন্যাশনাল ডিজেস্টার ফোর্স’ গঠন করতে পারে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া
তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে, যাতে তারা দুর্যোগের
সময় এগিয়ে আসতে পারে। সেই সঙ্গে এদের প্রাথমিক চিকিৎসায় অভিজ্ঞ করে তুলতে
হবে। নবমত, সরকার ‘রানা প্লাজার’ জায়গা অধিগ্রহণ করুক এবং সেখানে একটি
স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হোক, যারা মারা গেছেন তাদের স্মরণে। এ ধরনের
স্মৃতিস্তম্ভ আমি ওয়াশিংটনে দেখেছি। দেখেছি জার্মানিতেও। সেখানে নতুন
প্রজšে§র মানুষ তাদের ইতিহাস জানে। তারা কেন শহীদ হয়েছিলেন, তারা
স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সেসব ইতিহাস জানতে পারে। ওয়াশিংটন ডিসির ভিয়েতনাম
ভ্যাটার্ন মেমোরিয়ালের কথা বলতেই হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেসব আমেরিকান সৈন্য
নিহত বা নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাদের স্মরণে এটি নির্মিত হয়েছে। আমাকে যা অবাক
করেছে, তা হচ্ছে মোট ৫৮ হাজার সৈন্যের নাম গ্রানাইট পাথরে খোদাই করা আছে,
যারা ওই যুদ্ধে মৃত অথবা নিখোঁজ। হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। মহিলাদের
স্মরণে পাশে আরেকটি স্টাচুও আছে। বলা ভালো, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মোট ১১,৫০০
মহিলা অংশ নিয়েছিলেন। তাদের প্রতি সম্মান জানাতেই ওই ভ্যাটার্ন মেমোরিয়াল।
আমরা কি পারি না সাধারণ এই পোশাক কর্মীদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে রাখার
জন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে। রানা প্লাজা যেখানে তৈরি করা হয়েছে,
ওই জায়গার মূল মালিক রবীন্দ নাথ সাহা। জোর করে সোহেল রানা রবীন্দ নাথ
সাহার নিজস্ব পুকুরটি দখল করে ও ভরাট করে রানা প্লাজা তৈরি করেছিলেন।
সরকারের পক্ষে তাই অধিগ্রহণ করা সহজ। স্মৃতিস্তম্ভের বিষয়টি জরুরি এ কারণে
যে, জাতি এবং আগামী প্রজন্ম জানবে কিছু সাধারণ মানুষ দেশের জন্য অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাদের সবার নামও
থাকুক।
আমরা সব কিছুতেই ‘রাজনীতি’ খুঁজি। এটা ভালো লক্ষণ যে, প্রধান বিরোধী দল এখন অবধি সাভার ট্র্যাজেডি নিয়ে কঠিন কোনো ‘রাজনীতি’ শুরু করেনি। তবে হরতাল করছে ১৮ দল এবং বামপন্থী কয়েকটি দল। আগামী ২ মে। তবে কেউ কেউ আবার তা স্থগিতও করেছে। অনেকের মতো আমিও মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ‘ঝাঁকুনি তত্ত্ব’-এ হতবাক ও বিস্মিত। কী করে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন, তা আমি ভেবে পাই না। তারপরও আমি তাকে এমপি রনির মতো ‘বুদ্ধি ও প্রতিবন্ধী’ কিংবা বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মযহারের মতো ‘অপ্রকৃতিস্থ’ বলব না। তবে বলব তিনি ক্ষমতায় থাকার, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তিনি স্বউদ্যোগে পদত্যাগ করলে বরং তার দলের লোকেরাই খুশি হবেন। আরো একটা ব্যাপারে আমি বিব্রত। একটি জনপ্রিয় দৈনিক গত ২৬ এপ্রিল ঢাকায় একটি তথাকথিত ‘তারকা-মহাতারকাদের মিলনমেলা’র আয়োজন করেছিল। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে মানুুষ একটু পানির জন্য, অক্সিজেনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছিল, সেখানে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মানসিকতা কীভাবে হয়? এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের একশ্রেণীর মানুষ কতটা বিকৃত মানসিকতার অধিকারী। যারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের প্রতি আমি ঘৃণা প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে সাধুবাদ জানাই শিল্পী হাসান মাসুদকে, তিনি ‘প্রতিবাদ’ করে এই অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তৈরি পোশাক কর্মীদের ঠেলে দেয়ার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে আমরা মেলাতে পারব না। শত শত তৈরি পোশাক কর্মীর জীবনের বিনিময়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা তা আমাদের প্রয়োজন নেই। একটি জীবনের মূল্য কখনো লাখ টাকা হতে পারে না। যে জীবন চলে যায় লাখ টাকা দিয়ে কেন, কোনো কিছু দিয়েই সে জীবনের মূল্য পরিশোধ করা যায় না।
রাশেদ খান মেনন এই হত্যাকাণ্ডকে একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমি মেনন ভাইয়ের আবেগকে সমর্থন করি। তিনি তো আইনপ্রণেতা। কী করেছেন তিনি গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য? কোনো আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ কী তিনি কখনো নিয়েছেন? আমরা কতগুলো দৃশ্য ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। এক একটা তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে (অথবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তৎপর হন। টিভি ক্যামেরার সামনে গর্ব করে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা হবে।’ কিন্তু সেই ‘বিচার’ আর কোনো দিন হয় না। বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখ প্রকাশ করে। মাথাপিছু এক লাখ (কিংবা দু’লাখ) করে ‘মৃত্যু সম্মানী’ দেয়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয় একাধিক। তারপর এক সময় মানুষ ভুলে যায় সব। মনেও রাখে না। হাজারটা ‘সমস্যা’র ভিড়ে আমরা মনেও করতে পারি না তাজরীনে কিংবা স্পেকট্রামে ক’জন ‘সেলাই শিল্পী’ মারা গিয়েছিল। আমাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দেয় সংবাদপত্রগুলো। তবে আমাদের অনেকেরই মনে আছে তাজরীন গার্মেন্টস মালিকের কোনো শাস্তি হয়নি। স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের মালিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালের পর প্রায় অর্ধশত ভবন ধসে পড়েছে, যার মাঝে ৮টি ভয়াবহ। কোনো একটি ক্ষেত্রেও একজন মালিক তথা ভবন নির্মাণের দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হয়নি। তারা দায়মুক্তি পেয়ে গেছেন। আজ রানা প্লাজার মালিকও দায়মুক্তি পাবেন, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। আমরা এখন অপেক্ষা করব একটি অনুষ্ঠানের জন্য, সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। বিজিএমইএ’র নেতারা থাকবেন। উপস্থিত থাকবেন ‘পোশাক কন্যার’ মা অথবা বাবা। এক লাখ টাকার একটি চেক তারা পাবেন। টিভি সে দৃশ্য ধারণ করবে। সন্তুষ্ট চিত্তে প্রয়াত পোশাক কন্যার মা বা বাবা ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। এক একটি মৃত্যুর ‘মূল্য’ এক লাখ টাকা। কী পরিহাস! ‘চিত্রনাট্য’ এভাবেই তৈরি করা আছে। তাজরীনের ঘটনায় এভাবেই ‘চিত্রায়িত’ হয়েছিল দৃশ্য। স্পেকট্রামেও তাই হয়েছিল। এখন শুধু রানা প্লাজার জন্য অপেক্ষা!
আমরা কী পারি না একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে? আমরা কী পারি না অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেফতার করে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আইনি পন্থায় নিশ্চিত করতে? অতীতে হয়নি বলে এবারো হবে না, তা তো হতে পারে না। দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি, ‘রানা প্লাজায়’ হত্যাকাণ্ডের যদি বিচার না হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। কতগুলো বিষয়ে সরকারও যদি আরো ‘কঠিন’ না হয়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা আগামীতে কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় রানা প্লাজার মালিক রানাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আইনি সংস্থাগুলো ঘটনার ৪ দিন পর। গার্মেন্টস মালিক ও প্রকৌশলীদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। তাদের বিচার এবং যথাযথ দণ্ড নিশ্চিতকল্পে সব ধরনের উদ্যোগ ও জোরদার ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো ছাড় নয় এ ব্যাপারে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য সাভার উপজেলার নির্বাহী অফিসার (যিনি সার্টিফিকেট দিয়ে ছিলেন ভবন ভেঙে পড়বে না বলে), রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, এমনকি সাভারের ক্ষমতাসীন দলের এমপি, যার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে রানাকে উদ্ধার ও আশ্রয় দেয়ার জন্য। এদের সবাইকে আইনের আওতায় নেয়া হোক। সরকারের কারখানা অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করা হোক। এখানে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কোনো অবস্থাতে বিজিএমইএ’র ‘চাপ’-এর কাছে মাথানত করা যাবে না। তারা বৈদেশিক মুদ্রা ‘আয়’ করেন বলে সবসময় ছাড় পেয়ে যেতে পারেন না। সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের দেখিয়ে দিল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। অসংখ্য মানুষ তাদের স্বজনদের খোঁজে আইডি কার্ড নিয়ে আর্তনাদ করছে, অন্তত লাশটা তারা ফেরত পেতে চায়। এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রোধে যা যা করণীয় তা করতে হবে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে।
Daily MANOBKONTHO
30.04.13
আমরা সব কিছুতেই ‘রাজনীতি’ খুঁজি। এটা ভালো লক্ষণ যে, প্রধান বিরোধী দল এখন অবধি সাভার ট্র্যাজেডি নিয়ে কঠিন কোনো ‘রাজনীতি’ শুরু করেনি। তবে হরতাল করছে ১৮ দল এবং বামপন্থী কয়েকটি দল। আগামী ২ মে। তবে কেউ কেউ আবার তা স্থগিতও করেছে। অনেকের মতো আমিও মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ‘ঝাঁকুনি তত্ত্ব’-এ হতবাক ও বিস্মিত। কী করে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন, তা আমি ভেবে পাই না। তারপরও আমি তাকে এমপি রনির মতো ‘বুদ্ধি ও প্রতিবন্ধী’ কিংবা বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মযহারের মতো ‘অপ্রকৃতিস্থ’ বলব না। তবে বলব তিনি ক্ষমতায় থাকার, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তিনি স্বউদ্যোগে পদত্যাগ করলে বরং তার দলের লোকেরাই খুশি হবেন। আরো একটা ব্যাপারে আমি বিব্রত। একটি জনপ্রিয় দৈনিক গত ২৬ এপ্রিল ঢাকায় একটি তথাকথিত ‘তারকা-মহাতারকাদের মিলনমেলা’র আয়োজন করেছিল। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে মানুুষ একটু পানির জন্য, অক্সিজেনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছিল, সেখানে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মানসিকতা কীভাবে হয়? এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের একশ্রেণীর মানুষ কতটা বিকৃত মানসিকতার অধিকারী। যারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের প্রতি আমি ঘৃণা প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে সাধুবাদ জানাই শিল্পী হাসান মাসুদকে, তিনি ‘প্রতিবাদ’ করে এই অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তৈরি পোশাক কর্মীদের ঠেলে দেয়ার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে আমরা মেলাতে পারব না। শত শত তৈরি পোশাক কর্মীর জীবনের বিনিময়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা তা আমাদের প্রয়োজন নেই। একটি জীবনের মূল্য কখনো লাখ টাকা হতে পারে না। যে জীবন চলে যায় লাখ টাকা দিয়ে কেন, কোনো কিছু দিয়েই সে জীবনের মূল্য পরিশোধ করা যায় না।
রাশেদ খান মেনন এই হত্যাকাণ্ডকে একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমি মেনন ভাইয়ের আবেগকে সমর্থন করি। তিনি তো আইনপ্রণেতা। কী করেছেন তিনি গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য? কোনো আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ কী তিনি কখনো নিয়েছেন? আমরা কতগুলো দৃশ্য ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। এক একটা তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে (অথবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তৎপর হন। টিভি ক্যামেরার সামনে গর্ব করে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা হবে।’ কিন্তু সেই ‘বিচার’ আর কোনো দিন হয় না। বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখ প্রকাশ করে। মাথাপিছু এক লাখ (কিংবা দু’লাখ) করে ‘মৃত্যু সম্মানী’ দেয়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয় একাধিক। তারপর এক সময় মানুষ ভুলে যায় সব। মনেও রাখে না। হাজারটা ‘সমস্যা’র ভিড়ে আমরা মনেও করতে পারি না তাজরীনে কিংবা স্পেকট্রামে ক’জন ‘সেলাই শিল্পী’ মারা গিয়েছিল। আমাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দেয় সংবাদপত্রগুলো। তবে আমাদের অনেকেরই মনে আছে তাজরীন গার্মেন্টস মালিকের কোনো শাস্তি হয়নি। স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের মালিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালের পর প্রায় অর্ধশত ভবন ধসে পড়েছে, যার মাঝে ৮টি ভয়াবহ। কোনো একটি ক্ষেত্রেও একজন মালিক তথা ভবন নির্মাণের দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হয়নি। তারা দায়মুক্তি পেয়ে গেছেন। আজ রানা প্লাজার মালিকও দায়মুক্তি পাবেন, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। আমরা এখন অপেক্ষা করব একটি অনুষ্ঠানের জন্য, সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। বিজিএমইএ’র নেতারা থাকবেন। উপস্থিত থাকবেন ‘পোশাক কন্যার’ মা অথবা বাবা। এক লাখ টাকার একটি চেক তারা পাবেন। টিভি সে দৃশ্য ধারণ করবে। সন্তুষ্ট চিত্তে প্রয়াত পোশাক কন্যার মা বা বাবা ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। এক একটি মৃত্যুর ‘মূল্য’ এক লাখ টাকা। কী পরিহাস! ‘চিত্রনাট্য’ এভাবেই তৈরি করা আছে। তাজরীনের ঘটনায় এভাবেই ‘চিত্রায়িত’ হয়েছিল দৃশ্য। স্পেকট্রামেও তাই হয়েছিল। এখন শুধু রানা প্লাজার জন্য অপেক্ষা!
আমরা কী পারি না একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে? আমরা কী পারি না অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেফতার করে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আইনি পন্থায় নিশ্চিত করতে? অতীতে হয়নি বলে এবারো হবে না, তা তো হতে পারে না। দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি, ‘রানা প্লাজায়’ হত্যাকাণ্ডের যদি বিচার না হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। কতগুলো বিষয়ে সরকারও যদি আরো ‘কঠিন’ না হয়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা আগামীতে কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় রানা প্লাজার মালিক রানাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আইনি সংস্থাগুলো ঘটনার ৪ দিন পর। গার্মেন্টস মালিক ও প্রকৌশলীদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। তাদের বিচার এবং যথাযথ দণ্ড নিশ্চিতকল্পে সব ধরনের উদ্যোগ ও জোরদার ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো ছাড় নয় এ ব্যাপারে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য সাভার উপজেলার নির্বাহী অফিসার (যিনি সার্টিফিকেট দিয়ে ছিলেন ভবন ভেঙে পড়বে না বলে), রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, এমনকি সাভারের ক্ষমতাসীন দলের এমপি, যার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে রানাকে উদ্ধার ও আশ্রয় দেয়ার জন্য। এদের সবাইকে আইনের আওতায় নেয়া হোক। সরকারের কারখানা অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করা হোক। এখানে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কোনো অবস্থাতে বিজিএমইএ’র ‘চাপ’-এর কাছে মাথানত করা যাবে না। তারা বৈদেশিক মুদ্রা ‘আয়’ করেন বলে সবসময় ছাড় পেয়ে যেতে পারেন না। সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের দেখিয়ে দিল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। অসংখ্য মানুষ তাদের স্বজনদের খোঁজে আইডি কার্ড নিয়ে আর্তনাদ করছে, অন্তত লাশটা তারা ফেরত পেতে চায়। এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রোধে যা যা করণীয় তা করতে হবে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে।
Daily MANOBKONTHO
30.04.13
0 comments:
Post a Comment