চার শতাধিক পোশাককর্মীর মৃত্যুর কারণ ওই রানা প্লাজায় নির্মিত হোক একটি
স্মৃতিস্তম্ভ। যে স্মৃতিস্তম্ভ বছরের পর বছর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে এ
দেশের খেটে খাওয়া মানুষরা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে
গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। ইতিহাস অবশ্যই তাদের কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ
করবে। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই মেয়ে। খুব সাধারণ, এক
একটা মেয়ে, শুধু বাবা-মায়ের সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা দেওয়ার জন্য গার্মেন্টে
তাদের কাজ নেওয়া। এরা তো জাতীয় বীর। এদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা দিতে
ক্ষতি কী? সারা পৃথিবীতে প্রায় প্রতিটি দেশে জাতীয় বীরদের এভাবেই সম্মান
করে। যারা ওয়াশিংটনে কখনও গেছেন, তারা নিশ্চয়ই ভিয়েতনাম ভ্যার্টান
মেমোরিয়াল পার্কটি দেখেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেসব আমেরিকান সৈন্য নিহত বা
নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে এই ভিয়েতনাম ভ্যার্টান
মেমোরিয়াল পার্ক। মোট ৫৮ হাজার সৈন্যের নাম গ্রানাইট পাথরে খোদাই করা আছে।
যারা ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত বা নিখোঁজ
হয়েছিলেন। হাত দিয়ে নামগুলো স্পর্শ করা যায়। কাগজে সেই নামও \'ছাপ আকারে\'
নেওয়া যায়। তিনটি স্ট্যাচু আছে সেখানে। একটি আবার মহিলাদের। ভিয়েতনামে
যুদ্ধে নিখোঁজ, অংশগ্রহণে আর আহত মহিলাদের স্মরণে স্ট্যাচুটি নির্মিত
হয়েছে। মোট ১১ হাজার ৫০০ মহিলা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অংশ
নিয়েছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ সঠিক ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষে তারা শহীদ
হয়েছিলেন। আজ যারা রানা প্লাজায় শহীদ হয়েছেন তারাও রাষ্ট্রের পক্ষে অর্থ
উপার্জন করতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে আমরা অবশ্যই
একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে পারি। ওই স্থানটি রানা পরিবারের পৈতৃক
সম্পত্তি নয়। সোহেল রানা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই স্থানটি দখল করে
নিয়েছিলেন। ওই স্থানটির বড় অংশের মালিক রবীন্দ্রনাথ সাহা, যিনি এখনও জীবিত
আছেন। দখল করা জায়গাটি সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে। না হলে আমরা এক সময় দেখব
সোহেল রানা জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন! তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি!
পুলিশ যে \'তদন্ত\' রিপোর্ট দিয়েছে তাতে সোহেল রানাকে দোষী সাব্যস্ত করা
যায়নি! এক সময় জেল থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ওই স্থানে আরেকটি ভবন তৈরি করছেন! এ
ধরনের ঘটনার সঙ্গে আমরা মোটামুটি পরিচিত। এই নষ্ট সমাজে, নষ্ট মানুষরা
এভাবেই বড়লোক হয়। তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি
তাদের হাতে \'বন্দি\'। রানা যখন পরের সম্পত্তি দখল করে অবৈধভাবে ছয়তলার ভবন
নয়তলায় উন্নীত করে ঠিক তখনই বজলুস সামাদ কিংবা আনিসুর রহমানের মতো
গার্মেন্ট মালিকরা ভবনের নিরাপত্তা ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে গার্মেন্টকর্মীদের
কাজ করতে বাধ্য করে। এরা সবাই সমান অপরাধে অপরাধী। এরা শ্রমিক হত্যাকারী।
অতি মুনাফালোভী এসব গার্মেন্ট মালিকের ভবন ধসে মৃত্যু হয় না। মৃত্যু হয়
শাহীনা, লাভলীর মতো গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের। মাত্র কয়েক লাখ টাকার \'মৃত্যু
সম্মানী\' হয়তো তাদের পরিবারে কিছুটা সচ্ছলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসবে, কিন্তু
তাদের ভালোবাসার এই পৃথিবীতে তারা আর আসবেন না কোনো দিন। পায়ে নূপুর পরা
অনামি, অদেখা যে মেয়েটির কংক্রিটে চাপা মৃতদেহ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, সেই
মৃতদেহ যেন একটি প্রতীকী ছবি_ যেন \'পা\' দেখিয়ে অবজ্ঞাভরে সে রাষ্ট্রকে
বলছে, আমরা তোমাদের ঘৃণা করি। যে রাষ্ট্র সামান্য চার হাজার টাকার চাকুরে
এই মেয়েটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, তার তো রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা
প্রকাশ করারই কথা। আসুন তাদের সবার স্মরণে আমরা বিধ্বস্ত রানা প্লাজায় একটি
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করি, যেখানে মারা যাওয়া প্রত্যেকের নাম খোদাই করা
থাকবে। একজন যুবলীগ কর্মীর অবৈধ দখল করা জমি অধিগ্রহণ করতে রাষ্ট্র যদি
ব্যর্থ হয়, তাহলে নূপুর পায়ে অনামি ওই মেয়েটির মতো সেটাও হবে এক
\'তামাশা\'! সরকার পারে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার।
শুধু স্মৃতিস্তম্ভ নয়। সরকারের আরও অনেক কিছু করার আছে। একশ\' কোটি টাকার
একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে পারে সরকার, যেখানে ব্যাংক, বীমা,
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং বিজেএমইএ_ সবাই আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে
দেবে। এ টাকায় যারা মারা গেছে, তাদের পরিবারকে সহযোগিতা, পঙ্গুত্ববরণ করা
কর্মীদের পুনর্বাসন তথা মাসিক সহযোগিতা এবং সেই সঙ্গে শুভ, সাগর আর
সীমান্তদের মতো শিশুদের (সমকাল, ২৯ এপ্রিল) উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করবে। মানুষ
তো মানুষের জন্যই। সাভার ট্র্যাজেডির ঘটনায় যেভাবে সাধারণ মানুষ সহযোগিতার
হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমার বিশ্বাস, সরকার যদি উদ্যোগ নেয় একটা ফান্ড গঠন করা
কঠিন কিছু নয়। আর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই এই ফান্ড পরিচালিত হবে। সাভার
ট্র্যাজেডির ঘটনায় এ দেশে সুশাসনের যে কত বড় অভাব, তা আবারও প্রমাণিত হলো।
রানা প্লাজা ধসেপড়ার পরই আমরা জানলাম সব অনিয়মের খবর। রানা প্লাজায় অবস্থিত
পাঁচটি পোশাক কারখানা যে \'কমপ্লায়েন্স\' নীতিমালা অনুসরণ করেনি (শ্রম
পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানের ছিল না), বিজিএমইএ তা জানত, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা
নেয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর কিংবা কারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের
কোনো কর্মকাণ্ড নেই। বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করে তৈরি ভবন মালিকদের বিচার
হবে_ বলেছেন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী। তাজরীন গার্মেন্ট দুর্ঘটনার পরও আমরা এ
কথা শুনেছিলাম। আজও শুনলাম। র্যাবের মহাপরিচালক দায়ী করলেন রানাকে।
\'সুকৌশলে\' এড়িয়ে গেলেন গার্মেন্ট মালিকদের, যারা বাধ্য করেছিল শ্রমিকদের
কাজে যোগ দিতে। দুদক রানা প্লাজার মালিক ও তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাজরীন গার্মেন্ট কিংবা স্পেকট্রাম
গার্মেন্ট দুর্ঘটনায় কি এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছিল দুদক? বাংলাদেশ ব্যাংক
নির্দেশ দিয়েছে, যেসব ভবনের অনুমতি নেই, সেসব ভবনে অবস্থিত গার্মেন্টকে
কোনো ঋণ দেওয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তটি ভালো। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগে
টনক নড়লে গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা অনুমোদনহীন ভবনে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি
বসাতেন না। পরিবেশ অধিদফতর কিংবা রাজউকের নজরদারির ক্ষমতা থাকলেও তাদের
কাছে \'বিদেশ সফর\' প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। তাজরীন কিংবা রানা প্লাজা
পরিদর্শনের সময় ছিল না তাদের। মিডিয়া যখন রানা প্লাজার দুর্ঘটনাকে
\'হাইলাইট\' করল, তখন একাধিক মন্ত্রী বললেন, এটা একটা হত্যাকাণ্ড। যেখানে
চার শতাধিক মানুষ নিমিষে প্রাণ হারায়, তাকে হত্যাকাণ্ড বলাই শ্রেয়। কিন্তু
যে ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিচার হয়, সে ধারায় মামলা করেনি পুলিশ। এমন ধারায়
মামলা করা হয়েছে, যাতে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শান্তি হয় না। হত্যার
উদ্দেশ্য না থাকলেও যে কাজটির ফলে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা অপরাধজনক নরহত্যা। এই
অপরাধজনক নরহত্যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অথচ পুলিশ যে অভিযোগে মামলা
করেছে, তা প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
অন্যদিকে রাজউকের করা মামলায় সংশ্লিষ্ট অনেককে বাদ দিয়ে শুধু সোহেল রানাকে
আসামি করা হয়েছে। ওপরের প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের দেশে সুশাসনের বড়
অভাব রয়েছে। যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা দায়িত্ব পালন করছেন না।
অনিয়ম, দায়িত্বহীনতা, শৈথিল্য, দুর্নীতি আজ প্রশাসনের রল্প্রেব্দ
রল্প্রেব্দ। আর তাই তাজরীন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তার রেশ ধরেই রানা প্লাজা
ধসে চারশ\' ব্যক্তি প্রাণ হারান। তাই \'প্রতিবাদ\' হিসেবে, অন্যায়ের
প্রতিবাদ হিসেবে, আর যারা মারা গেলেন, তাদের স্মরণে ওই \'অবৈধ জায়গায়\'
তৈরি হোক একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং ২৪ এপ্রিলকে ঘোষণা করা হোক \'শোক দিবস\'।
Daily SAMAKAL
03.05.13
0 comments:
Post a Comment