ঘূর্ণিঝড়
মহাসেন যখন বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেল, তখন
নতুন করে আবারো পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি সামনে চলে এল। বিশ্বে উষ্ণতা
বাড়ছে। ফলে এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির বিষয়টি এখন ঘন ঘন হচ্ছে। গভীর সমুদ্রে
সৃষ্টি হওয়া এসব সামুদ্রিক ঝড় শুধু বাংলাদেশের মতো সমুদ্রঘেঁষা দেশগুলোকেই
যে আঘাত করছে, তা নয়। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরও
আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু তার পরও বিশ্বের উষ্ণতা কমানোর জন্য কোনো কার্যকর
ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত এপ্রিলে জাতিসংঘের ইন্টার গভার্নমেন্টাল
প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে
উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হার (৪০০
পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এর মাত্রা অতিক্রম করেছে। আইপিসিসি আরো
জানিয়েছে, ১৯৫৮ সালে এ নির্গমনের হার ছিল মাত্র ৩১৬ পিপিএম। ফলে তাপমাত্রা
বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ থেকে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রির মাঝে
সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলছেন। আর এটা করতে হলে কার্বন নির্গমনের হার ৪০০
পিপিএমের মধ্যে রাখতে হবে। কিন্তু এটি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অতীতে বিশ্বের
উষ্ণতা রোধকল্পে একাধিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা ‘কপ’ নামে
পরিচিত। সর্বশেষ কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কাতারের
দোহায়। দোহা সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বন সম্মেলনেই বিশ্বের
উষ্ণতা রোধকল্পে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যা কার্যকর হবে ২০২০ সাল
থেকে।
সারা বিশ্ব জানে, বিশ্বের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তাতে
আগামী দিনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ দেশের উপকূলে প্রতি
বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা
বেড়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি সাতজনে
একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে
বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জলবায়ু
উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল
থেকে ৫ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান প্যারেন্টি
তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ Tropic of chaos : Climate change and the new
geography of violence (2011)-এ উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেরেন্টি আরো উল্লেখ
করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে ২২ মিলিয়ন অর্থাত্ ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ
বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির
রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা। অনেকের মনে থাকার কথা,
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর পরিবেশের ব্যাপারে বিশ্ব
জনমতের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গেল জানুয়ারিতে এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন।
আমাদের পরিবেশমন্ত্রীকেও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানে। সেটা ঠিক আছে।
কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে
অন্যতম বাংলাদেশে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে পরপর দুবার বন্যা ও পরবর্তীতে সিডর
আঘাত আনে। এরপর ২০০৯ সালের মে মাসে আঘাত আনে আইলা। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশে
খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যায়।
অর্থনীতিতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিডরের পর বাংলাদেশের পরিবেশ
বিপর্যয়ের বিষয়টি বারবার বিশ্বসভায় আলোচিত হচ্ছে। সিডরের ক্ষতি গোর্কির
চেয়েও বেশি। মানুষ কম মারা গেলেও সিডরের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। এতে
৩০টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ক’টি জেলা। ২০০
উপজেলার ১ হাজার ৮১৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ২৬৫
পরিবারের ৮৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৬ জন মানুষ সিডরে আঘাতপ্রাপ্ত ছিল। মারা
গিয়েছিল ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি। তবে অর্থনেতিক ক্ষতি ছিল ব্যাপক। সব মিলিয়ে
ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। সিডর ও আইলার পর এখন মহাসেন
বাংলাদেশে আঘাত করল। এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব আমরা পাব আরো
কিছুদিন পর। সিডর ও আইলার আঘাত আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
আইলার আঘাতের পর খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি
হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়নি। জলাবদ্ধতা কোথাও কোথাও ১ থেকে ৩ মিটার
পর্যন্ত। আইলায় ৮০ শতাংশ ফলদ ও বনজ গাছ মরে গিয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আজ
নোনা পানির আগ্রাসন। সুপেয় পানির বড় অভাব; এখন মহাসেন আমাদের আবারো
ক্ষতিগ্রস্ত করে গেল।
আমাদের মন্ত্রী, সচিব কিংবা পরিবেশ
মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশ সফর ও সম্মেলনে অংশ নিতে ভালোবাসেন।
কানকুন, ডারবান, কাতার কিংবা তারও আগে কোপেনহেগেনে (কপ সম্মেলন) আমাদের
পরিবেশমন্ত্রীরা গেছেন। আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য কোপেনহেগেনে প্ল্যাকার্ড ও
ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিশ্ব জনমত আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। আমরা পরিবেশ রক্ষায়
ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডে পাওয়া অর্থের (বাংলাদেশের জন্য ১৩০ মিলিয়ন ডলার)
ব্যাপারে উত্সাহী। আরো অর্থ চাই। সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু ‘তিতাসকে
হত্যা’ করে আমরা নিজেরাই যে (এর জন্য বিদেশীরা দায়ী নয়) বাজে দৃষ্টান্ত
স্থাপন করলাম, তার কী হবে? বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট
বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি।
বিদ্যুত্ উত্পাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এজন্য বছরে চার মিলিয়ন টন কয়লা
আমদানি করতে হবে। বিদ্যুত্ আমাদের দরকার, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কয়লা
পুড়িয়ে যে বিদ্যুত্ উত্পাদন হবে এবং তাতে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা কি
আমরা বিবেচনায় নিয়েছি? না নিইনি। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে
একটি চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবেশে এর প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ
সমীক্ষা— তা করা হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারী মৌজায় ১
হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এ বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করা হবে, যা সুন্দরবন থেকে
মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার,
নাইট্রিক এসিড বায়ুমণ্ডলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে এসিড বৃষ্টি হতে
পারে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। সুন্দরবনের গাছ, উদ্ভিদ মরে যাবে। পশুপাখির
প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
বিদ্যুেকন্দ্রটি কি স্থানান্তর করা যেত না? আমাদের গর্ব এই সুন্দরবন। এরই
মধ্যে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা এমন কিছু
করতে পারি না, যাতে বিশ্বের বৃহত্তম এ প্যারাবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে না
পড়ে। রামপালে বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে
ঠেলে দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
সংরক্ষণ-সংক্রান্ত ইউনেস্কো কনভেনশন লঙ্ঘন করেছি। পরিবেশমন্ত্রী এ ব্যাপারে
আপনি কী বলবেন? সরকারের সিদ্ধান্ত আপনি চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না, জানি।
কিন্তু একজন বিবেকবান মন্ত্রী হিসেবে আপনি যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলার জন্য
আন্তর্জাতিক আসরে যান, যখন সুদূর এন্টার্কটিকায় জনমত সৃষ্টির জন্য যান, তখন
আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা বেশি। কেননা বাংলাদেশের
পরিবেশ
রক্ষায় আপনি নেবেন অগ্রণী ভূমিকা। তিতাস নদীকে আমরা হত্যা করতে চলেছি।
সুন্দরবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিলাম। খুলনার দাকোপ, কয়রা আর পাইকগাছায়
আইলার কারণে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমরা তিন বছরেও সমাধান করতে
পারিনি। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি যখন দক্ষিণ মেরুতে পা রাখছেন, আপনার গর্ব
অনুভব করারই কথা। কিন্তু ২০১২ সালের এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স সূচকে
(ইপিআই) বাংলাদেশকে যখন ১৩২টি দেশের মাঝে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণকারী
দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (এখন ভারত), তখন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা
নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আদৌ কি এর কোনো ভূমিকা আছে? বলা ভালো, ইপিআই
পরিচালিত হয় দ্য ইয়েল সেন্টার ফর এনভারমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি এবং
কলম্বিয়ার সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক
কর্তৃক।
বাংলাদেশ এককভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কোনো
কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না। বাংলাদেশ এককভাবে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ও,
তা সামগ্রিকভাবে বিশ্বের উষ্ণতা রোধ করতে খুব একটা প্রভাব রাখবে না। এজন্য
বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে
আন্তর্জাতিক আসরে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। জলবায়ু
পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিদেশী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
কিন্তু এ সাহায্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ে পরিবেশ
মন্ত্রণালয়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন আবার আমাদের সে কথাটাই
স্মরণ করিয়ে দিল।
Daily Bonik Barta
28.05.13
0 comments:
Post a Comment