রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এখনও অন্ধকার


জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর বহুল আলোচিত বাংলাদেশ সফরের পরও বরফ গলল না। অনিশ্চয়তা বাড়ল। সেই বহুল আলোচিত ‘চিঠি’ আর আসবে না। তারানকোর ঢাকা সফরের পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নিউইয়র্কে দেখা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে। তার সঙ্গে দীপু মনির হাসি মাখানো একটি ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান না ঘটলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খুব বাজে প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এর আগে তারানকোর বক্তব্যে আমি এমন সব শব্দ ও বাক্য পেয়েছি, যা আমাদের শংকিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। যেমনÑ ‘সংলাপ না হওয়ায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ’, ‘সময় শেষ হয়ে আসছে’, ‘দ্রুত সংলাপ প্রয়োজন’, ‘স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি, উন্নয়নের জন্য নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ’। এ ধরনের শব্দ ও বাক্য নিঃসন্দেহে এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে। কিন্তু যারা সংকট নিরসনে মূল ভূমিকা পালনকারী অর্থাৎ সরকারি দল, তাদের ভূমিকা স্পষ্ট হচ্ছে না। বিএনপি শর্তহীনভাবে সংলাপে রাজি হলেও সরকারের মনোভাবে একধরনের উদাসীনতা লক্ষণীয়।
প্রধানমন্ত্রী কোন চিঠির কথা উল্লেখ না করেও বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তার আহ্বানে এটা স্পষ্ট হয়নি যে, সরকার সংসদেই বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করতে চায়! আলোচনার যে পরিবেশ দরকার, সেই পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে দু’-একজন মন্ত্রীর কারণে। বন ও পরিবেশমন্ত্রী ক’দিন আগে বেগম খালেদা জিয়া ও একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাকে জড়িয়ে একটি মন্তব্য করেছেন, যা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এটি একটি স্পর্শকাতর মন্তব্য। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও যদি শুনতে হয়, আমাদের নেতানেত্রীরা বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার ‘টাকা গ্রহণ করেন’, তা শুধু অনভিপ্রেত বলাই যথেষ্ট নয়, বরং এর সত্যতা যাচাই করা উচিত। এটাকে আমি মেঠো বত্তৃদ্ধতা হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ। আমি মনে করি, বনমন্ত্রী শুধু খালেদা জিয়াকে অপদস্ত করার জন্যই এ ধরনের কথাবার্তা বলেননি। নিশ্চয়ই তার কাছে কোন ‘ডকুমেন্ট’ আছে, যে ‘ডকুমেন্ট’ অনুযায়ী তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের উক্তি করতে পারেন। আমি চাইব, তিনি ব্যাপারটি খোলাসা করবেন। অন্য নেতারাও কম যান না। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে দলের পক্ষে অন্যতম ভূমিকা পালনকারী মোহাম্মদ নাসিমও খালেদা জিয়াকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন (বাংলামেইল ২৪.কম)। আমাদের অত্যন্ত প্রিয় ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বললেন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে! আমি অবাক হই এসব কথা শুনে। নাহিদ সাহেব কি ভুলে গেছেন, অতীতে আওয়ামী লীগ কতদিন হরতাল দিয়েছিল? হরতাল আমরা কেউই চাই না। কিন্তু হরতাল হয় এবং আগামীতেও হবে যদি না কোন সমঝোতা হয়।
বনমন্ত্রী কিংবা নাসিম সাহেব স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে, তবে নির্বাচনকালীন যে সরকার, সেখানে শেখ হাসিনাই থাকবেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী। আর চিঠির বিষয়টি এখন ভুলে যেতে হবে। সৈয়দ আশরাফ এর আগে চিঠির কথা বললেও এখন আর চিঠি যাচ্ছে না বেগম জিয়ার দফতরে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এখনও অন্ধকার। কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। যেখানে বিদেশী দাতাগোষ্ঠী, খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব একটি সংলাপের কথা বললেন, সেখানে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রধানমন্ত্রী তো জানিয়ে দিয়েছেন, জনগণ তাদের পক্ষে আছে। সুতরাং বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে বলে তিনি মনে করেন না। প্রধানমন্ত্রী অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি যা বলেন, তাই করেন। এখন সংলাপ না হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এটা ভাবলে আমি শিহরিত হয়ে উঠছি। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনের উক্তি ছাপা হয়েছে অনলাইন পত্রিকাগুলোতে। লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে একধরনের হতাশা ব্যক্ত করেছেন। স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও ব্রিটেনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাউস অব কমন্সে বাঙালি এমপি রয়েছেন। বাঙালি ব্রিটিশ নাগরিকের সংখ্যা ব্রিটেনে কয়েক লাখ। যুক্তরাজ্য সরকারকে তাই সঙ্গত কারণেই জবাবদিহি করতে হয়। আর বাঙালিরা সেখানে ব্রিটেনের রাজনীতি নিয়ে যত না তৎপর, তার চেয়ে বেশি তৎপর বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। মিটিং-মিছিল সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার। বাঙালিদের মাঝে বিএনপি সমর্থকরা আছেন, আছেন আওয়ামী সমর্থকও। জামায়াতেরও একটা বড় সমর্থন রয়েছে ব্রিটেনে। তাই হাইকমিশনার গিবসন যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হতাশার কথা বলেন, তখন এটাকে হালকাভাবে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। জাতিসংঘেরও যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশগ্রহণ রয়েছে। মালিতে যে নতুন একটি ‘মিশন’ হবে, সেখানে ৬০০ সৈন্য যাওয়ার কথা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন বিভিন্ন দেশে। আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। সুতরাং জাতিসংঘের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য খারাপ।
বিএনপি সংসদে যাবে। এতে করে সংলাপের একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, এটা মনে করার কোন কারণ নেই। বিএনপি যাচ্ছে দুটি কারণে। এক. সংসদে যোগ না দিলে তাদের সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। দুই. এটা বাজেট অধিবেশন। বিএনপি আগামী বাজেটের ব্যাপারে তাদের কিছু ‘অবজারভেশন’ রাখতে চায়। যদিও ইতিহাস বলে, তাদের কোন পরামর্শ সরকার কখনও গ্রহণ করেনি। তবে একটা বিষয়ে আমরা বলতেই পারিÑ আর তা হচ্ছে বিএনপির কিছুটা নমনীয়তা। বারবার হরতাল দিয়ে সরকারের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি দলটি। একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি তথা ১৮ দল যে আন্দোলন তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, এখন তাতে ভাটা এসেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। তারা গ্রেফতার হচ্ছেন। জেলে থাকছেন। জামিন পাচ্ছেন বটে, আবার জেল গেট থেকেও কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন। সরকারের এটা একটা কৌশলÑ বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা, যাতে তারা আন্দোলনে সক্রিয় হতে না পারেন। এই স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা এখন আর সক্রিয় নন। ছাত্রদলকেও মাঠে খুব একটা দেখা যায় না। নতুন কমিটি করা হলেও আন্দোলনে সক্রিয় নয় ছাত্রদল। নেতাদের জেল-জুলুম, মামলা আর অসুস্থতার কারণে ‘মুখপাত্র’ও খুঁজে পাচ্ছে না দলটি। একসময়ের অনেকটা ‘ভুলে যাওয়া নেতা’ দুদু এখন মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু খুব সুবিধা করতে পারছেন না। একসময় তরিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। এখন তার আর ‘খোঁজ’ পাওয়া যাচ্ছে না। বোধকরি তিনি ‘যশোর জীবন’ই বেছে নিয়েছেন। বিএনপি বড় দল। লাখ লাখ সমর্থক রয়েছে দলটির। কিন্তু সময় এসেছে নয়া নেতৃত্ব তৈরি করার। স্থায়ী কমিটিতে যারা আছেন, তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও যা বলা যায় তা হচ্ছে, বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্ব দরকার। একসময় তারেক রহমান তারুণ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বাবার মতোই গ্রামগঞ্জে গিয়ে দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তার ভেতর যে উদ্যম ও উৎসাহ কাজ করেছিল, আজকের ছাত্রদল তথা যুবদলের মাঝে সেই উদ্যম আমি দেখি না। মাঝে মধ্যে বিএনপির তিনজন মহিলা সংসদ সদস্য ঝলসে ওঠেন বটে, কিন্তু তাদের ভূমিকাও সীমিত। বিএনপি নিঃসন্দেহে এক কঠিন সময় পার করছে।
প্রধানমন্ত্রী অতি সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি ৫ মে হেফাজতের সমাবেশের নামে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র যদি সত্যি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে তা নিন্দনীয়। কিন্তু ৫ মে কি সে রকম কোন ঘটনা ঘটেছিল? সরকার কি শাপলা চত্বরে সমাবেশ (সরকার বলছে দোয়া মাহফিল) করার অনুমতি দেয়নি হেফাজতকে? তারা যে অবস্থান ধর্মঘট করতে পারে, তা তো সরকারের না জানার কথা নয়? প্রথম কথা হচ্ছে, মতিঝিলের মতো একটি স্পর্শকাতর জায়গায় কোন ধরনের জমায়েতের অনুমতি দেয়া ঠিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রতিটি ব্যাংকের সদর দফতর এখানে অবস্থিত। এখানে কেন লাখ লাখ লোক সমাবেশ করবে। তবে জনসভার একটা স্থান নির্ধারণ করে দেয়াও প্রয়োজন। সমাবেশ করা একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। এটি সংবিধানসম্মত। আওয়ামী লীগের জন্যও একটি জায়গা খুঁজে বের করা ভালো। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ওই সমাবেশ ও পরে অবস্থানকে ঘিরে যদি কোন ‘সরকার উৎখাতে’র (?)ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, তার বিস্তারিত তথ্য সরকার উপস্থাপন করুক। হেফাজত একটি ধর্মীয় সংগঠন। তারা জামায়াতের বিরোধিতাও করে। তারা এটাকে কোন রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেনি। ১৮ দলে তারা যোগ দেবে এমন কোন ঘোষণাও শুনিনি কখনও। ১৮ দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’-একটি ইসলামিক দল অবশ্যই হেফাজতের সঙ্গে জড়িত। তবে হেফাজত কর্মীদের মতিঝিল থেকে উৎখাতে সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছিল এবং তাতে যে হতাহত হয়েছে, তা বহির্বিশ্বে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
সম্প্রতি সমঝোতার যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল, যে আশার সম্ভাবনা জেগেছিল, তা এখন সুদূরপরাহত। আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই সংলাপের। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা? সরকার যেটা চায়, অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে একটি নির্বাচনকালীন সরকার, তাতে বিএনপির সমর্থন থাকবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী যে নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপি তথা ১৮ দলকে বাদ রেখে সরকারকে নির্বাচনে যেতে হবে। কিন্তু তা কি সরকারের জন্য ভালো হবে? প্রধানমন্ত্রী কি ঝুঁকি নিচ্ছেন না? এমনকি জাতীয় পার্টি এমন এক পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশ নেবে, এটাও মনে হচ্ছে না। অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আমরা বারবার ওয়ান-ইলেভেনের কথা বলি। কিন্তু এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আমাদের রাজনীতিকরাই কি দায়ী নন? কে ওই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে আরও কঠিন সমস্যায় পড়বেন, তা না বলে বরং এ ধরনের পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়াই উচিত। আমরা শুধু এটাই প্রত্যাশা করব, আমাদের রাজনীতিকদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং আমরা একটা বড় ধরনের সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারব।
Daily JUGANTOR
22.05.13

0 comments:

Post a Comment