রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সংলাপের মধ্য দিয়েই সমাধান খুঁজতে হবে

এ কোন বাংলাদেশকে আমরা দেখলাম গত ৫ মে! হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠনের হাজার হাজার কর্মী সারাদেশ থেকে ঢাকায় এসে জমায়েত হয়েছিলেন। সরকার তাদের অনুমতিও দিয়েছিল মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জনসভা করার। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, সংঘর্ষ, মুহুর্মুহু গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি ভাঙচুর, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়ার যে ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তার শেষ কোথায়? হেফাজতের নেতাকর্মীরা যখন শাপলা চত্বরে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান নেয়ার কথা ঘোষণা করেন, তখন রাতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির যৌথবাহিনী হেফাজত কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে উৎখাত করে। আরো একটি ঘটনা ঘটেছে, যাকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। প্রশাসন শাহবাগ চত্বর থেকে গণজাগরণ মঞ্চকেও অপসারণ করেছে। গত ৫ ফেব্র“য়ারি থেকে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা শাহবাগে একটি স্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল। একদিকে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত কর্মীদের উচ্ছেদ, অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেয়া এর মধ্য দিয়ে সরকার এক ধরনের ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান গ্রহণ করতে চাইলেও হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হেফাজতে ইসলামই এখন প্রধানবিরোধী দলের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। আর বিএনপি তথা ১৮ দল এখন আর দৃশ্যমান নয়। ৪ মে বেগম জিয়া ঢাকায় বিশাল সমাবেশে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিলেও, দেখা গেছে বিএনপি কোনো কঠিন কর্মসূচি দেয়নি। হেফাজতে ইসলামকে সামনে পাঠিয়ে পর্দার অন্তরালে বিএনপি কোনো ‘অংক কষছে’ কি-না, সে প্রশ্ন এখন অনেকের। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অনেকেই এখন যে প্রশ্নটি করতে  চাইবেন, তা হচ্ছে অতঃপর কী? প্রধানমন্ত্রী যে সংলাপের আহ্বান করেছিলেন, সেই সংলাপ কি আদৌ অনুষ্ঠিত হবে? কিন্তু বিএনপির আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান ও হেফাজতের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের পর এই ‘সংলাপ’ অনুষ্ঠিত হবে, এই আস্থাটা রাখতে পারছি না। শেষপর্যন্ত বরফ গলল না। এদিকে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব বান কি মুনের (জাতিসংঘের মহাসচিব) বার্তা নিয়ে ঢাকা এসেছেন। তিনি দু’নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং স্পষ্টতই আভাস পাওয়া গেল, সংলাপ ও অর্থবহ নির্বাচন চায় জাতিসংঘ। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ‘যে কোনো জায়গায়’ বিএনপির সঙ্গে কথা বলার যে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তাতে জট খুলল না। বিএনপির দাবি আগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার (যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে) এর ঘোষণা দিতে হবে, তারপর সংলাপ। গত ৪ মে ঢাকায় ১৮ দল আয়োজিত এক গণজামায়েতে বেগম জিয়া সুস্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত না নিলে ১৮ দল চূড়ান্ত কর্মসূচি গ্রহণ করবে। সেই ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম পার হয়ে গেছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ৩ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে ‘সমঝোতা’ হতে পারে। তার বক্তব্য স্পষ্ট ‘নির্বাচন হতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে।’ অর্থাৎ নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা ও বেগম জিয়ার দৃঢ় অবস্থান সংলাপের যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল তার ‘মৃত্যু’ ঘটাল! একটি সংলাপের জন্য যে পরিবেশ দরকার, সে ধরনের একটি পরিবেশ বর্তমানে বিরাজ করছে না। সাভারের রানা প্লাজা ধসে প্রায় এখন পর্যন্ত ১১২৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এত মানুষের মৃত্যুতে যে ‘জাতীয় দুর্যোগ’-এর সৃষ্টি হয়েছে, তাতে একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছিল যাতে সরকার ও বিরোধী দল একসঙ্গে কাজ করতে পারে। বিএনপি গত ২ মে হরতাল প্রত্যাহার করে একটি সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের বলে দিচ্ছে সংলাপের সম্ভাবনা আদৌ নেই। তারপরও কথা থেকে যায়। রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সংলাপ ছাড়া বিকল্প নেই।
অতীত অভিজ্ঞতাও আমাদের আশাবাদী করে না। কেননা অতীতে কোনো একটি ক্ষেত্রে, কোনো একটি জাতীয় ইস্যুতে সরকার বিরোধী দলের সহযোগিতা নিয়েছে, এ রকমটি আমাদের জানা নেই। এখন সংলাপের যে আহ্বান প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তা কাগজে-কলমে অর্থাৎ সংবাদপত্রের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে সংলাপ বা আলোচনা যে হবে, তার কোনো এজেন্ডা নেই। কোন বিষয়গুলো নিয়ে দু’দল আলোচনা করবে? সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো (জাতীয় পার্টি, জাসদ, জামায়াত ইত্যাদি) সরকার ও বিরোধীদলীয় জোটে আবদ্ধ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে তৃতীয় শক্তি হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টি রয়ে গেছে। অন্যদিকে বিরোধী বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী রয়ে গেছে। সুতরাং সরকার ও বিরোধী দল যদি আলোচনায় বসত, আমার ধারণা তাতে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হতো। এ ক্ষেত্রে আলোচনায় যেসব বিষয় নির্ধারিত থাকবে, সে ব্যাপারে পূর্ব ধারণা থাকা ভালো। কেননা আলোচনার এজেন্ডা যদি নির্ধারিত না থাকে, তাহলে আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে যে, আলোচনায় যেখানে এজেন্ডা নেই, সেখানে ‘মিডিয়ার’ জন্য আলোচনা কোনো ফল বয়ে আনবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে বিষয় নির্ধারণ করে দিলে তাহলে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে। আলোচনার সাফল্যের স্বার্থে এ ক্ষেত্রে ‘এজেন্ডা’ নির্ধারণ করা ভালো। যেমন নিšে§াক্ত বিষয়গুলো এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এক. নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ; দুই. নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা কীভাবে নির্ধারণ করা যায়; তিন. আরপিওতে পরিবর্তন এনে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া; চার. নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ‘কোড অব কনডাকট’ তৈরি করা। বিএনপির নেতারা প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে প্রথমে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এখন দৃশ্যপট কিছুটা বদলে গেছে সত্য, কিন্তু তারপরও সংলাপ হতে পারে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আবারো সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের প্রায় সবাই এখন মুক্ত। এ ক্ষেত্রে মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনাটা শুরু করা যায়। যদি এজেন্ডায় ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ’ সরকারের প্রশ্নটি থাকে, তাতে ক্ষতির কিছু নেই। সরকার উদারতার পরিচয় দিতে পারে আলোচনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দিয়ে।
সরকার হেফাজতকে ঢাকায় জমায়েত করতে দিয়ে উদার হয়েছিল। পরে কঠোর হয়ে হেফাজতের কাছে তারা একটি মেসেজ পৌঁছে দিল। হেফাজতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করাও ক্ষতির কিছু নেই। সরকার তো গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সংলাপ করার একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে! হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। মনে রাখতে হবে অতি সম্প্রতি হেফাজত একটি ‘শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এখন সরকার কি তাদের সঙ্গেও সংলাপ করবে? রাজনীতিতে মূল ‘স্টেক হোল্ডার’ মূলত সরকার ও বিরোধী দল। আর এজেন্ডা একটিই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এমন একটি পদ্ধতি বের করা, যাতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। সরকার সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখে আগামী নির্বাচনের কথা বলছে। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা সংবিধান এভাবেই সংশোধিত হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে থেকে যান, তাতে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হয়ে যেতে পারে। গেল চার বছরে প্রশাসন যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে ‘দলীয় আনুগত্য’ প্রর্দশন করেছেন, তাতে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্র্যাডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরো একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই (৩ মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ কি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের রেখেই নির্বাচন হবে? এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। টিআইবি একটি ফর্মুলা দিয়েছে, যদিও টিআইবির ফর্মুলাতে বেশ ত্র“টি রয়েছে। টিআইবি অনেকটা দায়সারা গোচেরভাবে একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে তাদের আরো ‘কাজ’ করার সুযোগ ছিল। বিএনপি এখনো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে, যা এখন আর সংবিধান অনুমোদন করে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হতে পারে। তারা তাদের ‘থিংক ট্যাঙ্কে’র মাধ্যমেও একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করতে পারে, যাতে সংলাপটা শুরু করা যায়। সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে ‘গো’ ধরে রেখেছে। তা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এমনকি সরকারের কোনো কোনো নীতি-নির্ধারক যেভাবে আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শন করেছেন, তাতে সংলাপের জট খোলার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। সরকার যদি তার একক সিদ্ধান্তে এককভাবে নির্বাচন করে, সেটাও তার জন্য সুখের হবে না। আমাদের দেশে এককভাবে নির্বাচন করার কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও শুধু বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে সেই সংসদ পাঁচ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেয়ায় চতুর্থ, ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশ আবার একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে কি-না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে সরকারের দায়-দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি ‘গো’ ধরে থাকে, তাতে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তোফায়েল আহমেদের মতো সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও মনে করেছেন আদৌ সংলাপ হবে না। কেননা কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ‘কিছু না হলেও’ সংলাপ করতে হবে এবং সংলাপের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সবাই জামিন পেয়েছেন। তাহলে সংলাপ হতে বাধা কোথায়? সংলাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকেও কিছু ছাড় দিতে হবে। ‘সব কিছু ভুলে’ জাতির বৃহত্তম স্বার্থের কথা চিন্তা করে মুক্তমন নিয়ে বিএনপিকেও এগিয়ে আসতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সিপিডি, টিআইবি এবং সর্বশেষ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ প্রমাণ করে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান চান সবাই। একটি বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। অতীত ভুলে সামনে তাকানো খুবই জরুরি। রাজনীতিতে ইতোমধ্যে আবির্ভূত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। অনেকে বলার চেষ্টা করেন হেফাজত মূলত জামায়াতে ইসলামীরই সৃষ্টি। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমি বলতে পারব না। কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হেফাজতের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফী যখন বলেন, তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই, তখন এই আন্দোলনকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। ঢাকায় যে বিশাল সমাবেশ তারা করেছে তা নিঃসন্দেহে ১৮ দলীয় জোট ও সরকারের মধ্যে চিন্তার কারণ। জামায়াত বা ১৮ দলীয় জোট এই আন্দোলন থেকে ফায়দা ওঠাতে পারে। সরকারের দায়িত্বটি এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি। হেফাজতে ইসলাম মূলত একটি ধর্মীয় সংগঠন। ইসলাম ও আকিদা নিয়েই ওদের কর্মকাণ্ড। এরা ১৩ দফা দিয়েছে। এই ১৩ দফার মধ্যে কোথাও ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, এই ১৩ দফাটিই হচ্ছে ‘ব্লাসফেমি।’ একুশ শতকে এসে ‘ব্লাসফেমি’ আইন যে করা যায় না, কিংবা পাকিস্তানের মতো দেশে যেখানে ‘ব্লাসফেমি’ আইনের অপব্যবহার হয়েছে, সেখানে এই মেসেজটি হেফাজত নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। তবে ১নং ধারা (‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন), কিংবা ১২ ও ১৩নং ধারা (কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের মুক্তি) নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে আলোচনা করা যায়। সরকারের উচিত হবে না আরেকটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করার।
রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বাড়ছে সংঘাত। স্থায়ী কমিটির (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়) কর্তৃক সংলাপের সুপারিশের পর প্রধানমন্ত্রী বললেন, একটি সংলাপের কথা। তিনি সংসদে বিরোধী দলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চান। প্রয়োজনে সংসদের বাইরেও আলোচনা করতে প্রস্তুত। আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষের পালস বুঝতে পেরেছেন। এটা একটা ভালো লক্ষণ। একটি চিঠি পাঠানোর সম্ভাবনার কথাও বলেছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এটা ভালো হয় যদি তিনি সুস্পষ্টভাবে ওই চিঠিতে সংলাপের স্থান ও বিষয় উল্লেখ করেন। বিষয় তো মূলত একটি দশম সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। এটা সংলাপের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে। দু’দল মিলে একটি কমিটি গঠন করতে পারে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদেরও কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তারা সবাই মিলে একটি ফর্মুলা বের করবেন, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুমোদন দেবেন শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়া। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসতে পারে। এটা মনে রাখতে হবে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী এনে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করা হয়েছিল, সে ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের আলোকেই একটা সমাধান বের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বর্তমান সংসদের একজন নির্বাচিত সদস্যকে নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হতে পারে। যেখানে দু’দলের প্রতিনিধি থাকবে অথবা একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে, যিনি শূন্য আসনে নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসতে পারেন। এতে ‘নির্বাচিত প্রতিনিধি’র যে দাবি তা দূর হতে পারে। মোট কথা একটা সংলাপ হোক। প্রাথমিক পর্যায়ে মহাসচিব পর্যায়ে এই সংলাপ হোক। এই সংলাপে এজেন্ডা নির্ধারিত হোক, তারপর আলোচনা চলতে থাকুক। আমার বিশ্বাস, সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা সমাধানের পথ আমরা খুঁজে পাব। তবে মনে রাখতে হবে ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’ এই মানসিকতা থেকে উভয় দলকে বেরিয়ে আসতে হবে।
Daily MANOBKONTHO
13.5.13

0 comments:

Post a Comment