রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

স্পিকার পদে নারী : নারীর ক্ষমতায়ন নয়


প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্পিকার হিসেবে শপথ নিয়েছেন গত ৩০ এপ্রিল। নিঃসন্দেহে তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি বড় ধরনের অগ্রগতি। তাঁর এই নিযুক্তির অর্থ কী নারীর ক্ষমতায়ন? বাংলাদেশে নারীর অধিকার যখন আদৌ স্বীকৃত নয় এবং নারীরা যখন পদে পদে লাঞ্ছিত, ঠিক তখনই একজন নারীর জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে নিযুক্তি অনেক অর্থ বহন করে। তবে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর এ নিযুক্তি রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একজন নারী জাতীয় সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় স্পিকার পদে আসীন হয়েছেন, তাঁকে নিয়ে বলার অনেক কিছু আছে। তাঁর প্লাস পয়েন্ট অনেক। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তাঁর বিপক্ষে বলার মাইনাস পয়েন্টও রয়েছে। তুলনামূলক বিচারে তাঁর বয়স কম হলেও তিনি একজন কৃতী ছাত্রী, কমনওয়েলথ স্কলার, পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে। সেই সঙ্গে একজন ভালো আইনজীবীও। চাইলে তিনি এক সময় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী হতে পারতেন। হতে পারতেন উচ্চ আদালতের বিচারপতি। তিনি সনাতন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য যেন অনেকটা বেমানান! পার্লামেন্টে কখনো উচ্চ স্বরে কথা বলেননি, অযথা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েননি কখনো। বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী সম্পর্কে কখনো কোনো অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করেছেন, এ রকম রেকর্ড নেই। অত্যন্ত মার্জিত, ভদ্র, শালীনম- তাঁর পক্ষে বলার জন্য রয়েছে অনেক পয়েন্ট। মাইনাস পয়েন্টও আছে। তিনি অনির্বাচিত এমপি, নিজের কোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসতে পারেননি। প্রথমবারের মতো সংসদে এসেছেন। এসেই প্রতিমন্ত্রী, আর সবশেষে স্পিকার। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি খুব সক্রিয় ছিলেন, তাও বলা যাবে না। অতীতে মিটিং-মিছিলে তাঁকে দেখেছি বলে মনে হয় না। একজন আইনজীবী হিসেবে তিনি তাঁর নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। সংসদে বিরোধী দল অনেক দিনই নেই। তাঁর নিযুক্তির মধ্য দিয়ে বিএনপি সংসদে ফিরে আসবে- এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন বটে; এটা অনেকটা রুটিনওয়ার্ক হয়ে গেছে! অতীতে সাবেক স্পিকার আবদুল হামিদও এ রকম অনেক আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাতে কোনো কাজ হয়নি। সামনের দিনগুলো অনেক কঠিন। একদিকে বিএনপি তথা ১৮ দল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এ রকম একটি ধারণার জন্ম হয়েছে যে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যদি ফিরিয়ে না আনা হয়, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। সে ক্ষেত্রে ওই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের উত্থান, তাদের ১৩ দফা নতুন জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে একজন স্পিকারের ভূমিকা অনেক বড় ও ব্যাপক। তিনি প্রয়োজনে জাতির 'ঐক্যের প্রতীক' হতে পারেন! রাজনীতিতে তাঁর অনভিজ্ঞতা, সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর সীমিত জ্ঞান, বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক না থাকা, রাজনীতিতে 'চানক্য বা মেকিয়াভেলিয়ান ইমেজ' গড়ে তোলার ব্যর্থতা তাঁর আগামী দিনের কর্মকাণ্ডকে সীমিত করে দিতে পারে। তিনি 'শো-পিস' স্পিকার হবেন কি না, তা শুধু আগামী দিনই বলতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে দলীয় প্রধানের আশীর্বাদ ও ভালোবাসা তাঁর জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। একজন শিক্ষিত, মার্জিত ব্যক্তিকে স্পিকার হিসেবে মনোনীত করে নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি 'বড় কাজ' করেছেন। আগামী দিনেও তিনি এ ধারা অব্যাহত রাখবেন, এটাই প্রত্যাশা করি। এ দেশে অনেক যোগ্য লোক রয়েছেন, যাঁরা উচ্চ শিক্ষিত, বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তুলনামূলক বিচারে বয়স কম, এঁদের যদি রাজনীতিতে নিয়ে আসা যায়, তাহলে রাজনীতির চিত্রটাই বদলে যাবে। বর্তমানে যাঁরা সংসদে আছেন, বিশেষ করে সরকারি দলের, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই নানা ধরনের দুর্নীতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এখন যদি আওয়ামী লীগ আগামী দশম সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত তরুণ প্রজন্মকে মনোনয়ন দেয়, তাঁরা রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে।
একজন শিরীন শারমিন চৌধুরীর স্পিকার হিসেবে নিযুক্তিকে নারীর ক্ষমতায়ন হিসেবে গণ্য করা যাবে না। বাংলাদেশের নারীবাদীরা এই নিযুক্তিতে উৎসাহিত হবেন, সন্দেহ নেই। নারীরা বাংলাদেশে এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন। সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের হার মাত্র ১৯.৭ শতাংশ। এ সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। নারীদের সংরক্ষিত আসনে নয়, বরং স্থানীয় পর্যায়ে মনোনয়ন দিয়ে তাঁদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আমরা যদি দক্ষিণ এশিয়ার সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানের তুলনা করি, তাহলে অবশ্যই দেখা যাবে, বাংলাদেশ খুব একটা পিছিয়ে নেই। আফগানিস্তানে যেখানে নারীরা এখন শৃঙ্খলিত ও তালেবান নিয়ন্ত্রিত, সেখানে পার্লামেন্টে নারী প্রতিনিধিত্বের হার ২৭.৭ শতাংশ। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় শ্রীলঙ্কায়, যেখানে শিক্ষিতের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি, সেখানে পার্লামেন্টে নারী প্রতিনিধিত্বের হার মাত্র ৫.৮ শতাংশ। ভারতে ১১ শতাংশ, মালদ্বীপে ৬.৫ শতাংশ, ভুটানে ৮.৫ শতাংশ, পাকিস্তানে একটি কনজারভেটিভ সমাজেও এই হার ২২.৫ শতাংশ। আর নেপালে এই হার সবচেয়ে বেশি ৩৩.২ শতাংশ। পাঠক, আসুন বিশ্বের পার্লামেন্টগুলোতে নারী প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে আমাদের অবস্থানটা আমরা একটু তলিয়ে দেখি। নারী প্রতিনিধিত্বের হার সবচেয়ে বেশি আফ্রিকার একটি দেশ রুয়ান্ডায়, ৫৬.৩ শতাংশ । কিউবা ও সুইডেনে এই হার যথাক্রমে ৪৫.২ শতাংশ ও ৪৪.৭ শতাংশ। মিসরে এই হার মাত্র ২ শতাংশ আর ইয়েমেনে ০.৩ শতাংশ। 'আরব বসন্ত' আন্দোলনে নারীরা একটি বড় ভূমিকা পালন করলেও সংসদে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব খুব বাড়বে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে মজার কথা, দ্বীপরাষ্ট্র ভালুতো, বাউরু, পালাউ কিংবা কাতারের তথাকথিত সংসদে কোনো নারী প্রতনিধিত্ব নেই। অঞ্চল ভিত্তিতে দেখা যায়, প্যাসিফিক অঞ্চলে এই হার সবচেয়ে কম, মাত্র ১২.৭ শতাংশ (এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদে)। সবচেয়ে বেশি নরডিকভুক্ত দেশগুলোতে ৪২ শতাংশ। ইউরোপীয় অঞ্চলে (নরডিক দেশগুলো বাদে) এই হার মাত্র ২১.৯ শতাংশ। সাব-সাহারা অঞ্চলে ২০.৯ শতাংশ, এশিয়ায় ১৮.৪ শতাংশ, আর আরব দেশগুলোতে মাত্র ১৫.৭ শতাংশ। ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সর্বশেষ হিসাব মতে, সারা বিশ্বে সংসদ সদস্য রয়েছেন ৪৬ হাজার ৩০০ জন। এর মধ্যে নারী এমপির সংখ্যা মাত্র ৯ হাজার ৪২৬ জন, অর্থাৎ মাত্র ২০.৪ শতাংশ। একুশ শতকে এসেও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় নারীদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। আর নারী স্পিকার? নারীরা এ থেকেও অনেক পিছিয়ে আছেন। সমসাময়িক সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে দেখা যায়, অস্ট্রিয়ায় ১৯২৭ সালে প্রথমবারের মতো একজন মহিলা পার্লামেন্টের স্পিকার (বুনডেসরাট) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যকার সময়সীমায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৪২ জন নারী কোনো না কোনোভাবে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। ডেনমার্ক ১৯৫০ সালে, সুইডেন ১৯৯১ সালে, যুক্তরাজ্য (হাউস অব লর্ডস) ১৯৯২ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ২০০৭ সালে, ভারত ২০০৯ সালে, সিঙ্গাপুর ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো একজন নারীকে পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবে পেয়েছে। বর্তমানে ১৯০টি পার্লামেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, ৩৯ জন মহিলা পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবে রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর স্পিকার হিসেবে নিযুক্তি নিঃসন্দেহে বড় অগ্রগতি। এটাকে নারীর ক্ষমতায়ন হিসেবে বিবেচনা করা না গেলেও নারীরা এতে উৎসাহ বোধ করবেন। এখন নারীকুলের অগ্রগতির জন্য তিনি কী করবেন, এটা বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হচ্ছে, সংসদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো, সংসদীয় কার্যক্রমে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং দশম সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যাপারে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ কাজ যদি স্পিকার করতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি ইতিহাসে নাম রেখে যেতে পারবেন। আমরা তাঁর নিযুক্তিকে স্বাগত জানাই।Daily KALERKONTHO06.05.13

0 comments:

Post a Comment