রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কে হবেন নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান


নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য সরকারপ্রধান কে হবেন, এ নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যে কথাটা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, তা হচ্ছে শেখ হাসিনাই হবেন নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান। সংবিধান পরিবর্তনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে এবং সরকারের শেষ তিন মাসকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের শেষ তিন মাস, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি (২০১৪) পর্যন্ত যে সময়সীমা, ওই সময় সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনাই ক্ষমতায় থাকবেন এবং ওই সরকারই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করবে! সংবিধানের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত না করলেও যা বলা যায় তা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাত্রা একটু ভিন্ন ধরনের। এখানে ক্ষমতাসীন সরকার কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ জন্যই বিভিন্ন মহল থেকে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কে হবেন এই নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান? সরকারের পক্ষ থেকে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করা যাবে না। এটাকে যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তাহলে নবম সংসদে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের মধ্য থেকেই একজনকে বেছে নিতে হবে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে। এখন বাস্তবতা কী বলে? সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো দু'ভাবে বিভক্ত। মহাজোট সরকারে আছে চার দল_ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ। আর বিরোধী জোটেও আছে চার দল_ বিএনপি, জামায়াত, বিজেপি ও এলডিপি। যেহেতু রাজনীতি এখন জোটকেন্দ্রিক, সেহেতু যাকেই নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত সংসদ থেকে নির্বাচিত করা হয়, তিনি কোনো না কোনো জোটে আছেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা নিরপেক্ষতা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? শেখ হাসিনার কথা উঠেছে তার দল থেকেই। তিনি প্রধানমন্ত্রী, একটি দলের প্রধান। তিনি দায়িত্ব নিলে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করবেন কীভাবে? আমার বিবেচনায় এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতত্বের মানসিকতা। আমরা বারবার গুরুত্ব দেই কীভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় কিংবা কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায় তার ওপর। আর এটা করতে গিয়ে আমাদের যা যা করা দরকার, আমরা তা করতে প্রস্তুত। জনগণের প্রতি আস্থা রাখার যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দেই কম। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কী হয়? তারা কিছু কর্মসূচি ভোটারদের কাছে উপস্থাপন করেন। আমাদের দেশেও এই সংস্কৃতি চালু হয়েছে। জনসাধারণ ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখন সুষ্ঠু নির্বাচনে সেই জনসাধারণকেই সুযোগ দেওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার যদি আমজনতার মঙ্গলে কাজ করে থাকে বিগত বছরগুলোতে, তাহলে আমজনতা তাকেই আবার নির্বাচিত করবে। এখানে ভয়টা কোথায়? আমরা কেন আমজনতার ওপর আস্থা রাখতে পারছি না? শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন যে সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে, সে সরকার কি নিরপেক্ষ থাকতে পারবে! সেখানে প্রশাসনের কারচুপি কি সে সরকার বন্ধ করতে পারবে?
প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলেন। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। তিনি মিথ্যা বলেননি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হয়। জার্মানি বা ব্রিটেন কিংবা ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের এ কথাই বলে। কিন্তু ওইসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে কি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মেলানো যাবে? আমাদের দেশে যেভাবে ভোট কারচুপি হয়, ব্রিটেন বা জার্মানিতে কি এটা সম্ভব? এই দক্ষিণ এশিয়াতেই পাকিস্তান একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচন সম্পন্ন করল। নেপালে জুন মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে এই জুনে। সুতরাং ব্যতিক্রম আছে, আমাদের এ অঞ্চলেই আছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে থেকে যান, তাতে করে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হয়ে যেতে পারে। গত চার বছরে প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে 'দলীয় আনুগত্য' প্রদর্শন করেছেন, তাতে করে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী'-নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্র্যাডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরও একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই (৩ মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ কি নির্বাচিত এমপিদের রেখেই নির্বাচন হবে? এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পেঁৗছা দরকার। টিআইবি একটি ফর্মুলা দিয়েছে। যদিও টিআইবির ফর্মুলায় বেশ ত্রুটি রয়েছে। টিআইবি অনেকটা দায়সারা গোছের রিপোর্ট দিয়েছে। এখন সরকার যে পথে এগোচ্ছে অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। সৈয়দ আশরাফ একটি সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের বিষয়টি আলোচিত হতে পারে বলে অভিমত দিলেও তিনি কিন্তু বলেননি শেখ হাসিনা থাকবেন না। এই বিষয়টি নিশ্চিত না হলে বিএনপি শুধু মিডিয়ার জন্য কোনো সংলাপে যাবে না। এই বাস্তবতা মেনেই সরকার একা পথে হাঁটছে। তিনি ১৪ দলের সমর্থন পাবেন। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, সরকার যদি তার একক সিদ্ধান্তে এককভাবে নির্বাচন করে সেটাও তার জন্য সুখের হবে না। আমাদের দেশে এককভাবে নির্বাচন করার কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও শুধু বিএনপির অংশ না নেওয়ার কারণে সেই সংসদ পাঁচ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেওয়ায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশে পুনরায় একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি কি-না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে, সরকারের দায়দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি 'গোঁ' ধরে থাকে, তাতে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। এখন রাজনীতির স্বার্থেই বিরোধী দলের সঙ্গে একটা সমঝোতায় যেতে হবে।
সংলাপকে গ্রহণযোগ্য করতে সরকার নিজেও একটা প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে। বর্তমান সংসদের সবাই দলীয়ভাবে নির্বাচিত। তাদের কাউকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করলে তিনি দলীয় রাজনীতি ও মানসিকতার ঊধর্ে্ব যেতে পারবেন না। এতে নিরপেক্ষতা বিঘি্নত হবে। বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে। তারা নিজেরাও একটি প্রস্তাব সংসদে দিতে পারে। এতে করে সংসদের ভেতরেই আলোচনা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল কতগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতে পারে : ১. সংসদের বাইরে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা, যিনি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদের নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন; ২. দশজন উপদেষ্টা থাকবেন, যারা উভয় জোট থেকে নির্বাচিত। তবে তারা নিরপেক্ষতার স্বার্থে দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না; ৩. বিকল্প হিসেবে সংবিধানের আওতায় শপথগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ, যারা নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারপ্রধানকে সহযোগিতা করবেন; ৪. সাবেক ৩ জন অথবা ৪ জন প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল,' যারা সমন্বিতভাবে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনা করবেন; ৫. নবম জাতীয় সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্যকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্বটি দেওয়া যায়। তিনি ১০ জন সদস্যকে নিয়ে ৩ মাসের জন্য একটি কমিটি গঠন করবেন, যারা কেউই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। আসলে জটটি খোলা দরকার আমাদের সবার স্বার্থে। এ ক্ষেত্রে যদি একাধিক ফর্মুলা থাকে, তাহলে মূল স্টেকহোল্ডাররা আলোচনায় উৎসাহী হবেন।
Daily Samakal
28.05.13

0 comments:

Post a Comment