হেফাজতে ইসলামের গত ৫ মের সমাবেশ ও অবস্থান ধর্মঘটের ওপর পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ হামলা ও ওই হামলায় নিহত কর্মীদের ব্যাপারে সরকার একটি প্রেসনোট দিয়েছে, যা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ১১ মে। এমনকি সরকারি টিভিতে গত কয়েকদিন ধরেই ডিএমপি কমিশনার ও বিজিবি প্রধানের বক্তব্য বারবার প্রচার করা হচ্ছে। সরকারি প্রেসনোটের ঠিক একদিন পর একটি জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ফাঁস করে দিয়েছে ‘অপারেশন সিকিউরড শাপলা’র মূল কাহিনী। শুধু তাই নয় যারা নিয়মিত ইন্টারনেটে বিদেশী পত্র-পত্রিকা পড়েন তারা লক্ষ্য করেছেন ওইসব পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সাথে সরকারি প্রেসনোটের কোনো মিল নেই। সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছে : ১. ‘নৈরাজ্য প্রতিরোধ ও গণনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই অভিযান অপরিহার্য ছিল, ২. অনেক মানুষ মৃত্যুর খবর অসত্য ও উদ্দশ্যমূলক, ৩. এ অভিযানে পরিচালনা করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না, ৪. সমাবেশের কোনো অনুমতি ছিল না, ৫. হেফাজত কর্মীরা ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছিল, ৬. অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি, জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে, ৭. হেফাজত কর্মীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, ৮. মঞ্চের পাশে ৪টি কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ৪টি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, ৯. মোট ১১ জন নিহত হয়েছে, ১০. অভিযান পরিচালনার সময় টিভি ও ক্যামেরাসহ বিপুল সংবাদকর্মী উপস্থিত ছিলেন, ১১. পূর্ব নির্দেশ মতো বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা ধ্বংসযজ্ঞে যোগ দেয়। সংবাদপত্রের সিরিয়াস পাঠক আর সাধারণ মানুষ ভালো করেই জানেন, এই প্রেসনোটের সাথে প্রকৃত ঘটনার কতটুকু মিল আছে। এমনকি গত ১২ মে যুগান্তর ‘লিড নিউজ’ হিসেবে আমি যখন ঐ ঘটনার ফলোআপ স্টোরি পাঠ করছি, তখন দেখতে পেয়েছি প্রকাশিত রিপোর্টের সাথে প্রেসনোটের আকাশ পাতাল পার্থক্য। দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদন থেকে যা পাওয়া যায় : ১. দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে, ২. হেফাজত দমনে ৭৫৮৮ সদস্য অংশ নিয়েছেন, ৩. ৮০ হাজার টিয়ারশেল, ৫০ হাজার রাবার বুলেট, ১৫ হাজার শটগানের গুলি এবং ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। পিস্তল, রিভলভারের গুলি করা হয়েছে সাড়ে ৩০০ রাউন্ড। ৪. গুলি ছোঁড়া হয়েছে ‘হিউম্যান হাইটে’র ওপরে, ৫. ভয় দেখাতে হ্যান্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে, ৬. অপারেশনে অংশ নেয়া সবার হাতে ছিল এসএমজি একে ৪৭ রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, ৭. দিনে অভিযান চালানো হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হতো, ৮. অবৈধ জমায়েতে গুলি চালাতে মেট্রোপলিটান এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা অন্য কারোর অনুমতির প্রয়োজন হয় না, ৯. গুলি চালানোর ঘটনা তদন্ত করেছে পুলিশ।
খুব সাধারণভাবে দেখলে দেখা যাবে প্রেসনোটের বক্তব্যের সাথে যুগান্তরের প্রতিবেদনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। যে প্রশ্নের জবাব জানা খুবই প্রয়োজন তা হচ্ছেÑ ১. প্রেসনোটের বক্তব্য অনুযায়ী এই অভিযান আদৌ অপরিহার্য ছিল কী না? ২. মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। হেফাজত নেতারা দাবি করেছেন মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। লন্ডনের ইকোনমিস্ট বলেছে ৫০ জন। দেশী সংবাদপত্রগুলো এক এক সংখ্যা উল্লেখ করেছে। আবার বিদেশের মিডিয়ায় বিশেষ করে আল জাজিরা এই সংখ্যা একশ’ উল্লেখ করেছে। এখন এটা জানা আমাদের প্রয়োজন কত লোক সেদিন মারা গিয়েছিল। ৩. যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেই হেফাজতের কর্মীদের উৎখাত করার জন্যই এই অভিযান। তাহলে ১ লাখ ৫৫ হাজার গোলাবারুদ এবং এত বিপুল সংখ্যক গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে কী জন্য? ৪. আধুনিক যুগে অবস্থানকারীদের উৎখাত (পাঠক, নিউইয়র্ক এর ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ এর কথা স্মরণ করুন) করার জন্য পুলিশ নানা কৌশল ব্যবহার করে (জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, পিপার ¯েপ্র ইত্যাদি)। যৌথবাহিনী তা ব্যবহার করলো না কেন? ৫. সমাবেশের অনুমতি না থাকলে হাজার হাজার হেফাজত কর্মী শাপলা চত্বর জমায়েত হলো কিভাবে? সেখানে তো আগেই ১৪৪ ধারা জারি করা যেতো। ৬. শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত কর্মীদের উৎখাতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ যখন দিনের পর দিন ওই এলাকা ‘দখল’ করে রাখলো, তখন তাদের উৎখাত করা হলো না কেন? এটা কী বৈশাদৃশ্য নয়? ৭. হেফাজত কর্মীদের যদি ‘পালানো’র সুযোগ করে দেয়া হতো, তাহলে এত লোক মারা গেল কিভাবে? ৮. অভিযানের সময় নাকি মিডিয়া কর্মীরা ছিলেন! যদি তাই হয়,তাহলে দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দেয়া হলো কেন? তারা তো লাইভ সম্প্রচার করছিল। আমরা শাহবাগীদের অনুষ্ঠান বিটিভি কর্তৃক লাইভ সম্প্রচার হতে দেখেছি। বিটিভি তাহলে কেন শাপলা চত্বরের অনুষ্ঠান লাইভ কভার করলো না ৯. কুরআন শরিফে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। কটা কুরআন শরিফ পোড়ানো হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। একটি কুরআন শরিফও যদি পোড়ানো হয়, সেটা একটা মহাঅপরাধ। মাদরাসার শত শত কোমলমতি ছাত্ররা, যারা ধর্ম শিক্ষার জন্য মাদরাসাগুলোতে ভর্তি হয়, যারা পবিত্র কুরআন শরিফকে জীবনের চাইতেও বেশি মূল্য দেয়, তারা কুরআন পোড়াবে। এটা কী বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? যারা গাছ কেটেছে তাদের ছবি ফেসবুকে দেখলাম। পুলিশ তো চেহারা দেখে এদের শনাক্ত করতে পারে। তাহলে করছে না কেন? এসব ক্ষেত্রে পুলিশ গোপন ক্যামেরায় ছবি ধারণ করে রাখে। আমরা আগেও দেখেছি গোপনে ধারণকৃত ভিডিও পুলিশ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। তাহলে ওই ছবি দেখে পুলিশ চিহ্নিত করুক কারা কারা ওই সময় পল্টনে নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিল। মাথায় টুপি দিলেই কী জামায়াত কিংবা হেফাজত কর্মী? পুলিশ ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করুক। সংবাদপত্রে ওই ছবি প্রকাশ করুক। আজ যে ব্যক্তিই কুরআন পুড়িয়ে থাকুক সে যদি জামায়াত কর্মী হয়, যদি হেফাজত কর্মী হয়, আমরা অবশ্যই তার বিচার দাবি করবো। আমরা চাই সত্য বেড়িরয়ে আসুক।
শাপলা চত্বরের ঘটনায় বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘পলিটিকাল ভায়োলেন্স ইন বাংলাদেশ, ইন হট ব্লাড। দ্য কিলিং অব ইসলামিস্ট হার্ডলাইনার প্রমিজ ফারদার ইন্সটেকিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মতিঝিলের ঘটনায় মিডিয়াকে নীরব রাখা হয়েছে। ইকোনমিস্ট আরো যা বলেছে, তা হচ্ছে ৬ মে ভোরের কয়েক ঘণ্টায় ঢাকায় যা ঘটেছে তা গণহত্যার মতোই মনে হচ্ছে’। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ওই সাপ্তাহিকীটি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারকে উদ্ধৃতি করে তারা অধিকারের মতে শত শত লোকের মৃত্যুর কথাও বলেছে। ইকোনমিস্ট অভিযান চলাকালীন সময়ে মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধের কথাও উল্লেখ করেছে। সাপ্তাহিকীটির সমাপনী মন্তব্য আরো গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকাটি বলছে ‘সামনের মাসগুলো মনে হচ্ছে পরিস্থিতি আরো সংঘাতময় হয়ে উঠবে। .... বাংলাদেশের জন্য আরো রক্তপাত অপেক্ষা করছে (যুগান্তর ১১ মে) ইকোনমিস্ট রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়ার যে অভিযোগ করেছে, তা তো ফেলে দেয়ার মতো নয়। এমনকি পুলিশ নিজে ‘লোক দেখানো’ যে তদন্ত করছে, তাও সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধান অনুযায়ী অভিযোগকারী, তদন্তকারী এবং বিচারক একই ব্যক্তি হতে পারবে না। একই ব্যক্তি হলে ন্যায় বিচার হবে না। শাপলা চত্বরের ঘটনায় গুলিবর্ষণকারী, তদন্তকারী এবং রিপোর্ট দাখিলকারী সবাই পুলিশ। এর ফলে কি পরিস্থিতিতে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কখনই পাওয়া যাবে না। সুতরাং একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা খুবই জরুরি। ইতোমধ্যে হাইকোর্টে একজন আইনজীবী একটি রিট করেছেন। এই রিটের ভবিষ্যৎ কী আমি বলতে পারবো না। কিন্তু যা বলতে পারবো, তা হচ্ছে জনমত এটার পক্ষে। মানুষ জানতে চাচ্ছে কেন হেফাজতে ইসলামকে ঢাকায় জমায়েত করার সুযোগ দিয়ে তাদের ওপর রাতের আঁধারে গুলিবর্ষণ করা হলো? কারা পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ালো? একমাত্র উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি ছাড়া প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বলেছেন, সরকারি দলের কর্মীরা কুরআন শরিফ পুড়িয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের অংশীদার। মহাজোটের শরিক। সুতরাং একজন শরিক যখন বলেন, সরকারি দলের কর্মীরা কুরআন পুড়িয়েছে, আমি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাই। শুধু এরশাদ কেন। আমি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্যও উল্লেখ করতে পারি। তিনি বলেছেন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের শত শত কর্মীকে রাতের পর রাত ওই এলাকায় থাকতে দিয়ে দু’টি বড় হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। অথচ গ্রামগঞ্জের হতদরিদ্র আলেম সমাজ উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাজধানীতে নিরাপদে এক রাত কাটাতে পারলেন না। কাদের সিদ্দিকী মিথ্যা বলেননি। এটা তো এখন স্পষ্ট যে শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। দেশের মানুষ যখন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে বিরোধী দলের আন্দোলনের পেছনে তাদের সমর্থন ছুঁড়ে দিয়েছিল, তখন জনমতের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য হঠাৎ করেই সৃষ্টি করা হলো গণজাগরণ মঞ্চ। তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চে ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতি, মঞ্চ নিয়ন্ত্রণে নেয়া, শরিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের দিয়ে শাহবাগ দখল করে রাখার ‘কাহিনী’ এক সময় পরিষ্কার হয়ে যায়। ৫ মের রাতে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য পুলিশ গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙ্গে দিলেও ঠিক তার পরদিনই শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ আবার সক্রিয় হয়েছিল। এ থেকেই সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে যায়।
একটি তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি আজ দেশের ভেতর থেকেই যে উচ্চারিত হয়েছে, তা নয়। বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সক্রিয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হেফাজতে ইসলামের অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৫ ও ৬ মে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় হতাহতের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, হতাহতের ঘটনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এখনও পরিষ্কার নয়। বিবৃতিতে সাউথ এশিয়া ওয়াচের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার নিজেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উদার ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করলেও সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য অত্যন্ত খারাপ দিন আগামীতে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে তাই যে মন্তব্যটি করা যায়, তা হচ্ছে এই মুহূর্তে সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে। রাজনীতির স্বার্থে উন্নয়নের স্বার্থে, বিদেশে ভাবমূর্তি উদ্ধারের স্বার্থে এ ধরনের একটি কমিটি গঠন জরুরি।
17.05.13
খুব সাধারণভাবে দেখলে দেখা যাবে প্রেসনোটের বক্তব্যের সাথে যুগান্তরের প্রতিবেদনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। যে প্রশ্নের জবাব জানা খুবই প্রয়োজন তা হচ্ছেÑ ১. প্রেসনোটের বক্তব্য অনুযায়ী এই অভিযান আদৌ অপরিহার্য ছিল কী না? ২. মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। হেফাজত নেতারা দাবি করেছেন মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। লন্ডনের ইকোনমিস্ট বলেছে ৫০ জন। দেশী সংবাদপত্রগুলো এক এক সংখ্যা উল্লেখ করেছে। আবার বিদেশের মিডিয়ায় বিশেষ করে আল জাজিরা এই সংখ্যা একশ’ উল্লেখ করেছে। এখন এটা জানা আমাদের প্রয়োজন কত লোক সেদিন মারা গিয়েছিল। ৩. যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেই হেফাজতের কর্মীদের উৎখাত করার জন্যই এই অভিযান। তাহলে ১ লাখ ৫৫ হাজার গোলাবারুদ এবং এত বিপুল সংখ্যক গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে কী জন্য? ৪. আধুনিক যুগে অবস্থানকারীদের উৎখাত (পাঠক, নিউইয়র্ক এর ‘অক্যুপাই ম্যুভমেন্ট’ এর কথা স্মরণ করুন) করার জন্য পুলিশ নানা কৌশল ব্যবহার করে (জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, পিপার ¯েপ্র ইত্যাদি)। যৌথবাহিনী তা ব্যবহার করলো না কেন? ৫. সমাবেশের অনুমতি না থাকলে হাজার হাজার হেফাজত কর্মী শাপলা চত্বর জমায়েত হলো কিভাবে? সেখানে তো আগেই ১৪৪ ধারা জারি করা যেতো। ৬. শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত কর্মীদের উৎখাতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ যখন দিনের পর দিন ওই এলাকা ‘দখল’ করে রাখলো, তখন তাদের উৎখাত করা হলো না কেন? এটা কী বৈশাদৃশ্য নয়? ৭. হেফাজত কর্মীদের যদি ‘পালানো’র সুযোগ করে দেয়া হতো, তাহলে এত লোক মারা গেল কিভাবে? ৮. অভিযানের সময় নাকি মিডিয়া কর্মীরা ছিলেন! যদি তাই হয়,তাহলে দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দেয়া হলো কেন? তারা তো লাইভ সম্প্রচার করছিল। আমরা শাহবাগীদের অনুষ্ঠান বিটিভি কর্তৃক লাইভ সম্প্রচার হতে দেখেছি। বিটিভি তাহলে কেন শাপলা চত্বরের অনুষ্ঠান লাইভ কভার করলো না ৯. কুরআন শরিফে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। কটা কুরআন শরিফ পোড়ানো হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। একটি কুরআন শরিফও যদি পোড়ানো হয়, সেটা একটা মহাঅপরাধ। মাদরাসার শত শত কোমলমতি ছাত্ররা, যারা ধর্ম শিক্ষার জন্য মাদরাসাগুলোতে ভর্তি হয়, যারা পবিত্র কুরআন শরিফকে জীবনের চাইতেও বেশি মূল্য দেয়, তারা কুরআন পোড়াবে। এটা কী বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? যারা গাছ কেটেছে তাদের ছবি ফেসবুকে দেখলাম। পুলিশ তো চেহারা দেখে এদের শনাক্ত করতে পারে। তাহলে করছে না কেন? এসব ক্ষেত্রে পুলিশ গোপন ক্যামেরায় ছবি ধারণ করে রাখে। আমরা আগেও দেখেছি গোপনে ধারণকৃত ভিডিও পুলিশ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। তাহলে ওই ছবি দেখে পুলিশ চিহ্নিত করুক কারা কারা ওই সময় পল্টনে নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছিল। মাথায় টুপি দিলেই কী জামায়াত কিংবা হেফাজত কর্মী? পুলিশ ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করুক। সংবাদপত্রে ওই ছবি প্রকাশ করুক। আজ যে ব্যক্তিই কুরআন পুড়িয়ে থাকুক সে যদি জামায়াত কর্মী হয়, যদি হেফাজত কর্মী হয়, আমরা অবশ্যই তার বিচার দাবি করবো। আমরা চাই সত্য বেড়িরয়ে আসুক।
শাপলা চত্বরের ঘটনায় বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। লন্ডনের দি ইকোনমিস্ট একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘পলিটিকাল ভায়োলেন্স ইন বাংলাদেশ, ইন হট ব্লাড। দ্য কিলিং অব ইসলামিস্ট হার্ডলাইনার প্রমিজ ফারদার ইন্সটেকিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মতিঝিলের ঘটনায় মিডিয়াকে নীরব রাখা হয়েছে। ইকোনমিস্ট আরো যা বলেছে, তা হচ্ছে ৬ মে ভোরের কয়েক ঘণ্টায় ঢাকায় যা ঘটেছে তা গণহত্যার মতোই মনে হচ্ছে’। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ওই সাপ্তাহিকীটি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারকে উদ্ধৃতি করে তারা অধিকারের মতে শত শত লোকের মৃত্যুর কথাও বলেছে। ইকোনমিস্ট অভিযান চলাকালীন সময়ে মতিঝিল এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধের কথাও উল্লেখ করেছে। সাপ্তাহিকীটির সমাপনী মন্তব্য আরো গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকাটি বলছে ‘সামনের মাসগুলো মনে হচ্ছে পরিস্থিতি আরো সংঘাতময় হয়ে উঠবে। .... বাংলাদেশের জন্য আরো রক্তপাত অপেক্ষা করছে (যুগান্তর ১১ মে) ইকোনমিস্ট রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়ার যে অভিযোগ করেছে, তা তো ফেলে দেয়ার মতো নয়। এমনকি পুলিশ নিজে ‘লোক দেখানো’ যে তদন্ত করছে, তাও সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধান অনুযায়ী অভিযোগকারী, তদন্তকারী এবং বিচারক একই ব্যক্তি হতে পারবে না। একই ব্যক্তি হলে ন্যায় বিচার হবে না। শাপলা চত্বরের ঘটনায় গুলিবর্ষণকারী, তদন্তকারী এবং রিপোর্ট দাখিলকারী সবাই পুলিশ। এর ফলে কি পরিস্থিতিতে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কখনই পাওয়া যাবে না। সুতরাং একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা খুবই জরুরি। ইতোমধ্যে হাইকোর্টে একজন আইনজীবী একটি রিট করেছেন। এই রিটের ভবিষ্যৎ কী আমি বলতে পারবো না। কিন্তু যা বলতে পারবো, তা হচ্ছে জনমত এটার পক্ষে। মানুষ জানতে চাচ্ছে কেন হেফাজতে ইসলামকে ঢাকায় জমায়েত করার সুযোগ দিয়ে তাদের ওপর রাতের আঁধারে গুলিবর্ষণ করা হলো? কারা পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ালো? একমাত্র উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি ছাড়া প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে না। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বলেছেন, সরকারি দলের কর্মীরা কুরআন শরিফ পুড়িয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের অংশীদার। মহাজোটের শরিক। সুতরাং একজন শরিক যখন বলেন, সরকারি দলের কর্মীরা কুরআন পুড়িয়েছে, আমি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাই। শুধু এরশাদ কেন। আমি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্যও উল্লেখ করতে পারি। তিনি বলেছেন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের শত শত কর্মীকে রাতের পর রাত ওই এলাকায় থাকতে দিয়ে দু’টি বড় হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। অথচ গ্রামগঞ্জের হতদরিদ্র আলেম সমাজ উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাজধানীতে নিরাপদে এক রাত কাটাতে পারলেন না। কাদের সিদ্দিকী মিথ্যা বলেননি। এটা তো এখন স্পষ্ট যে শাহবাগের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। দেশের মানুষ যখন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে বিরোধী দলের আন্দোলনের পেছনে তাদের সমর্থন ছুঁড়ে দিয়েছিল, তখন জনমতের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য হঠাৎ করেই সৃষ্টি করা হলো গণজাগরণ মঞ্চ। তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চে ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতি, মঞ্চ নিয়ন্ত্রণে নেয়া, শরিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের দিয়ে শাহবাগ দখল করে রাখার ‘কাহিনী’ এক সময় পরিষ্কার হয়ে যায়। ৫ মের রাতে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য পুলিশ গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙ্গে দিলেও ঠিক তার পরদিনই শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ আবার সক্রিয় হয়েছিল। এ থেকেই সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে যায়।
একটি তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি আজ দেশের ভেতর থেকেই যে উচ্চারিত হয়েছে, তা নয়। বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সক্রিয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হেফাজতে ইসলামের অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৫ ও ৬ মে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় হতাহতের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, হতাহতের ঘটনায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এখনও পরিষ্কার নয়। বিবৃতিতে সাউথ এশিয়া ওয়াচের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার নিজেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উদার ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করলেও সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য অত্যন্ত খারাপ দিন আগামীতে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে তাই যে মন্তব্যটি করা যায়, তা হচ্ছে এই মুহূর্তে সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে। রাজনীতির স্বার্থে উন্নয়নের স্বার্থে, বিদেশে ভাবমূর্তি উদ্ধারের স্বার্থে এ ধরনের একটি কমিটি গঠন জরুরি।
17.05.13
0 comments:
Post a Comment