রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নারীর ক্ষমতায়ন ও হেফাজতের তের দফা



বাংলাদেশে একজন নারী যখন জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব নিয়েছেন, ঠিক তখনই হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায় নারীদের অধিকার খর্ব হতে পারে_ এমন দাবিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ৪নং ও ৫নং দাবি সরাসরিভাবে নারী অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ দুটি ধারায় \'নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ\' ও \'ইসলামবিরোধী নারীনীতি\'র যে কথা বলা হয়েছে; একুশে শতকে এসে এ দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ১৩ দফায় আরও যেসব দাবি হেফাজত উত্থাপন করেছে, তাতে নারী অধিকার বা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা না থাকলেও এমন সব দাবি রয়েছে, যা বাংলাদেশে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সরকার এসব দাবি-দাওয়ার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে এবং এসব দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যেমন ১নং দাবিতে বলা হয়েছে, সংবিধানে \'আল্লাহর\' ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে। আগে এটি ছিল। সংবিধান সংশোধনে এটি বাতিল করা হয়েছে। আমি মনে করি, এই অংশটুকু সংবিধানে পুনঃস্থাপন না করেও ইসলাম ধর্মের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান নিশ্চিত করা যায়। সরকার প্রয়োজনে নতুন একটি কমিটি গঠন করতে পারে, যেখানে হেফাজতের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এই কমিটি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে। বলা ভালো, পরিবর্তিত সংবিধানের প্রস্তাবনায় \'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম\' রেখে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে অষ্টম অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখা ও সেইসঙ্গে প্রস্তাবনায় \'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম\' থাকার কারণে সরকার চাইলে খুব সঙ্গত কারণেই সংবিধানে \'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস\' শব্দটি পুনঃস্থাপন করতে পারে। ২নং দফায় বলা হয়েছে, \'আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসারোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।\' সম্ভবত এটাকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, হেফাজত \'ব্লাসফেমি\' আইন চায়। এখানে ব্লাসফেমি আইন নিয়ে কিছু বলা দরকার। ব্লাসফেমি শব্দের অর্থ হচ্ছে \'অশালীন ভাষায় ঈশ্বর বা ধর্মকে আক্রমণ করা।\' এক সময় ইউরোপে ক্ষমতাসীনরা তাদের স্বার্থে এই \'ব্লাসফেমি আইন\' প্রণয়ন করেছিল । এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সব দেশে কি এই ব্লাসফেমি আইন আছে? সৌদি আরব, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিসরের মতো দেশে ব্লাসফেমি আইন আছে, যে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আবার আলজেরিয়ার মতো দেশে ব্লাসফেমি আইন নেই, যদিও আলজেরিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও দেশটি একটি ইসলামিক দেশ। এভাবে অনেক মুসলিম দেশে কোনো ব্লাসফেমি আইন নেই। আমি একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, ইউরোপের প্রায় সব দেশে, বিশেষ করে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডে কোনো ব্লাসফেমি আইন নেই। এমনকি ব্রাজিলের মতো দেশেও নেই। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশেও ব্লাসফেমি আইন নেই। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলেও ধর্ম অবমাননাকারী ব্লাসফেমি আইন নেই। যুক্তরাষ্ট্রেও নেই। যুক্তরাজ্যে ২০০৮ সালে এ-সংক্রান্ত একটি আইন বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫২ সালে সুপ্রিম কোর্ট joseph burstyn Inc বনাম Wilson মামলায় যে ঐতিহাসিক রায়টি দিয়েছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল, কেউ যদি ধর্ম সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করে তা কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। ওই সময় The Miracle নামে একটি ছবিতে ধর্মকে অপমান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। তবে প্রতিটি দেশেই ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। যেমন ভারতের পেনাল কোডের ধারা ২৯৫-এ, ইন্দোনেশিয়ায় পেনাল কোডের ৫৬ ধারা, ইসরায়েলের পেনাল কোডের ১৭০ ও ১৭৩ ধারা, ডেনমার্কের পেনাল কোডের ১৪০ ধারায় ধর্ম অবমাননাকারীদের শাস্তির বিধান রয়েছে। হেফাজতের ৩নং ধারায় কুৎসা রটনাকারী ব্লগারদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। সরকার তো ইতিমধ্যে কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতারও করেছে। ৯নং দফায় টিভিতে ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে নেতিবাচক প্রচার বন্ধের দাবি করা হয়েছে। এটা মনিটর করা কঠিন কিছু নয়। ১৩নং দফায় গ্রেফতারকৃত মাদ্রাসা ছাত্রদের মুক্তি দাবি করা হয়েছে। এটাও সরকার করতে পারে। ১১নং দফায় আলেম-ওলামাদের ওপর হামলা বন্ধের দাবি রয়েছে। ৮নং দফায় বায়তুল মোকাররমে মুসলি্লদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করার দাবি রয়েছে। এগুলো মানা সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। তবে ৪নং দফায় \'নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ\' বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক আরব দেশে (মিসর ও তিউনিসিয়া) মহিলারা পুরুষদের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা ব্যাপক। হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই এ বিষয়টি উপলব্ধি করবেন। ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে (৭নং), তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, অনেক ইসলামিক রাষ্ট্রেও ভাস্কর্য রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড বন্ধের যে দাবি (১০নং দাবি) করা হয়েছে, এক্ষেত্রেও সরকার উদ্যোগী হয়ে বিষয়টি মনিটর করে দেখতে পারে। মোট কথা, ১৩ দফায় যেসব দাবি-দাওয়া রয়েছে তা বাংলাদেশকে একটি কট্টরপন্থি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে_ এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
তবে যেটা উৎকণ্ঠার তা হচ্ছে, হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসার ছাত্র তথা শিক্ষকদের সংগঠিত করে ঢাকায় যে বিশাল \'শো-ডাউন; আন্তর্জাতিক আসরে তার প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বসবাস করেন। ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ হচ্ছে চতুর্থ রাষ্ট্র, যেখানে মুসলমানদের বসবাস বেশি। যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে এক ধরনের কট্টরপন্থি রাজনীতি সাম্প্রতিক সময়ে শক্তিশালী হয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আল কায়দা কিংবা আল কায়দা-সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। আফগানিস্তানের তালেবানের পাকিস্তানি সংস্করণ \'তেহরিক-ই-তালেবান\' আজ পাকিস্তানের অস্তিত্বকে রীতিমতো হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানের কোনো রাজনীতিবিদই আজ আর নিরাপদ নন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জামাইয়া ইসলামিয়ার ভূমিকা আজ আন্তর্জাতিক আসরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। পাকিস্তানে লস্কর-ই-তৈয়্যবা ও জইশ-ই-মোহাম্মদের মতো সংগঠন পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। এই দুটো সংগঠনের তৎপরতা আজ ভারতের মাটিতে সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের উত্থানে সর্বশেষ ঢাকা অবরোধ তথা শাপলা চত্বরের জমায়েত নিয়ে যা ঘটল, তাতে বিশ্বের মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের নাম। হেফাজতের উত্থানকে বিশ্বমিডিয়া ভালো চোখে নেয়নি। এখানে এক ধরনের \'র‌্যাডিক্যালিজম\' বা জঙ্গিবাদের জন্ম হচ্ছে কি-না, সেটাই তাদের জিজ্ঞাসা। এদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু তারা কোনো দিন উগ্রবাদকে পছন্দ করেনি এবং আগামীতেও করবে না। তবে নিঃসন্দেহে কওমি মাদ্রাসা নিয়ে কথা থেকে যায়। মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণ যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকদের সরকারি অনুদানের আওতায় নিয়ে আসা। আল্লামা শফীকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি সরকার করেছিল। প্রয়োজনে কমিটির কর্মপরিধি বাড়াতে পারে। একটা আশার কথা, ১২ মের হরতাল কর্মসূচি হেফাজত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটা আলাপ-আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি হলো। সরকার হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে যদি আলোচনা করে, তাতে ক্ষতি কী?
Daily SAMAKAL
12.5.13

0 comments:

Post a Comment