রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তারানকোর ঢাকা সফর প্রসঙ্গে


জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তাঁর এই সফরের সময় তিনি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। দু-দুবার তিনি বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকারসহ আরো অনেকের সঙ্গে। সেই তালিকায় আছেন দুজন বিশেষ সম্পাদকও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ দুজন সম্পাদক বরাবরই নানা কারণে আলোচিত। ফলে আলোচিত 'এক-এগারো'র ঘটনাবলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছে তাঁদের নাম। তাঁদের একজন তো নীতিনির্ধারকদের কাছে ইতিমধ্যে 'তওবা সম্পাদক' হিসেবে একটি উপাধিও পেয়ে গেছেন। তারানকোর ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, তিনি সমস্যা সমাধানে সিদ্ধহস্ত। তাঁর এই অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁকে যে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট করেই বলা যায়। আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে তারানকোর এই সফর কতটুকু সফলতা বয়ে আনতে পেরেছে।
তারানকোর আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না; কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিকদের 'মাইন্ড সেটআপ'। তাঁরা কি সমস্যা সমাধানে আদৌ আন্তরিক? মূল সমস্যা এক জায়গায় আবদ্ধ- আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই বিষয়টিকে সামনে রেখেই রাজনীতি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। জট খুলছে না। জট খুলছে না বিধায় আমরা বারবার হরতালের সম্মুখীন হচ্ছি। বাড়ছে সহিংসতা। এখন 'নির্বাচনকালীন সরকারে'র ব্যাপারে সমাধানটা হবে কোন পথে? সরকারের অবস্থান পরিষ্কার। সংবিধান তাদের পক্ষে। সরকার বলছে, একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র কথা, যাঁরা দশম সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই এই 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র নেতৃত্ব দেবেন। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এটা স্পষ্ট করেছেন, শুধু নির্বাচিতদের নিয়েই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সব দলের অংশগ্রহণে এই সরকার গঠন করার কথাও বলেছেন। অন্যদিকে বিরোধী দলের অবস্থান হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তবে একটি নির্বাচনকালীন সরকারেও রাজি বিএনপি।
প্রধানমন্ত্রী আবারও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ব্যাপারে বিরোধী দলকে একটি চিঠি দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। এখন সেই চিঠিটি দেওয়া হবে। যদিও চিঠির বিষয়বস্তু স্পষ্ট নয়। তাই সংলাপ নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই! বিরোধী দল সংলাপেও যেতে চায়। কিন্তু তারা চায় সংলাপের আলোচ্যসূচি নির্ধারিত হোক। এটা তো ঠিক, প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়ই একটি আলোচ্যসূচি থাকে। এখানে আলোচ্যসূচি কী? শুধু মিডিয়ার জন্য যদি 'সংলাপ' হয়, তাহলে তা তো কোনো রেজাল্ট বয়ে আনবে না। এ ক্ষেত্রে সমাধান কোন পথে? তারানকো কি সরকারপ্রধানকে কোনো 'উপদেশ' দিয়ে গেছেন! জাতিসংঘ যে বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন, সে কথাটাই বলে গেছেন তিনি। আমাদের রাজনীতিবিদদের যে 'মাইন্ড সেটআপ', অর্থাৎ মানসিকতা, তাতে করে কেউ 'এতটুকু' ছাড় দিতে নারাজ। সরকার যদি সংলাপের ব্যাপারে সিরিয়াস হয়, তাহলে আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে একটি চিঠি দেওয়া উচিত। মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনা হতে পারে। সরকারের যে প্রস্তাব, অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই প্রস্তাবকে ভিত্তি করেও আলোচনা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির নিশ্চয়ই কোনো মূল্যায়ন থাকবে। ওই মূল্যায়নকে ধরেও আলোচনা এগোতে পারে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হোক কিংবা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক, অথবা একটি নির্বাচনকালীন সরকার হোক, একটা সমাধান খুবই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে যদি একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছতে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের জন্য আরো নানা সমস্যা অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানে হাজারটা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা সে দেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে সংবিধানে পরিবর্তন এনে। বিচারপতি খোসোর নেতৃত্বে সেই সরকার গত ১১ মে পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। একটি নতুন সরকার সেখানে গঠিত হতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য এটা একটা বড় সাফল্য। পাকিস্তানে রাজনীতিবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা বাংলাদেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তার পরও তারা পেরেছে। আমরা নেপালের দৃষ্টান্তও দিতে পারি। সেখানে রাজনীতিবিদদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব গত প্রায় এক বছর বারবার আলোচিত হচ্ছে। সেখানে সরকার গঠন করা যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে রাজনীতিবিদরা বাধ্য হন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে। আগামী ২১ জুন সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এ লক্ষ্যে গত ১৪ মার্চ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিলরাজ রেগমি। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, অতি সম্প্রতি ইউরোপের একটি দেশ বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোজেন প্রোভনেলিয়েভ সাবেক কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। এ মাসেই সেখানে সাধারণ নির্বাচন। গ্রিসে পাপেন্দ্রু সরকারের পতন ঘটেছিল অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। পরে একজন বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে সেখানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যাঁরা নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি অনির্বাচিত সরকার বেমানান, এ ব্যাপারে দ্বিতম নেই। কিন্তু কখনো কখনো রাষ্ট্রকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। আমি এ রকম বেশ কিছু সিদ্ধান্ত দিতে পারব। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের আন্তরিকতা। এখানে 'অন্তর্বর্তীকালীন' কিংবা 'তত্ত্বাবধায়ক' সরকার নিয়ে বিতর্ক, সে বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন। আমরা 'নির্বাচনকালীন সরকারে'র কর্মপদ্ধতি নিয়ে এগোতো পারি। 'নির্বাচিত সরকারই এই সরকারের নেতৃত্ব দেবে'- সরকারের এই দাবিরও সমাধান বের করা যায়। এখানে সরকার ও বিরোধী দলের পাঁচজন করে ১০ জন সদস্য পদত্যাগ করবেন। সেই জায়গায় ১০ জন বেসামরিক ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি 'নির্বাচিত' হয়ে আসবেন। তাঁরা নিজেরা একত্র হয়ে একজনকে 'নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান' হিসেবে নির্বাচিত করবেন। তিন মাসের মধ্যে তাঁরা নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। এই 'ফর্মুলাকে' সামনে রেখে আলোচনা শুরু হতে পারে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। চিঠি দিয়ে আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে আলোচনার সূত্রপাত করতে হবে।
ইতিমধ্যে বহির্বিশ্বে আমাদের 'ইমেজ' যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে জাতিসংঘের মহাসচিবকে আজ 'হস্তপেক্ষ' করতে হয় এবং একজন সহকারী মহাসচিবকে ঢাকায় পাঠাতে হয়। পরিস্থিতির 'গুরুত্ব' আমরা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারছি জানি না, কিন্তু বহির্বিশ্বে আমাদের সম্মান অনেক নষ্ট করেছে।
আসল কথা হচ্ছে, একটি নিরপেক্ষ সরকার আমরা চাই, যে সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমাদের উপহার দেবে। বিদেশি দাতা এবং জনমতের একটি বড় অংশ একটি নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। প্রথম সারির তিনটি জাতীয় দৈনিকে কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক জনমত জরিপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় পড়েছিল বেশি। কিন্তু সরকার এ দিকে দৃষ্টি দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাদের কোনো আগ্রহও নেই। সরকার এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ও দেশকে এক কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণের পথ একটাই- আর তা হচ্ছে একটি নির্দলীয় তথা নিরপেক্ষ সরকার নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য গঠনের লক্ষ্যে ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। সরকার যত দেরি করবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য তা অমঙ্গল। এত সংকট, বিভেদ আর বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান আর নেপাল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে আমরা তা পারব না কেন? আসলে যা দরকার, তা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের শুভবুদ্ধির উদয়। শুভবুদ্ধির উদয় না হলে সংকট আরো বাড়বে। জোর করে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যে কোনো কর্তৃত্ব থাকতে পারে না। জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণই হচ্ছে সব ক্ষমতার উৎস। আজ একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয়, আর সেই নির্বাচনে যদি মহাজোট সরকারকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসে(?) তাহলে কারো কিছু বলার নেই। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সে কথাই বলছেন। মহাজোট সরকারের গত পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ড বিচার-বিশ্লেষণ করার অধিকার দেওয়া হোক জনগণকে। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু তা না করে এককভাবে একটি নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কারো কাছেই থাকবে না। ১৮ দলীয় জোটকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর সে দায়িত্বটি সরকারের। তাই নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারই পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে। তারানকো তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, সময় শেষ হয়ে আসছে। দ্রুত সংলাপ করা দরকার। কোনো শর্ত ছাড়াই বেগম জিয়া সংলাপে রাজি হয়েছেন। এটা একটা পজিটিভ দিক। এখন উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই।Daily KALERKONTHO15.05.13

0 comments:

Post a Comment