রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিদ্যুৎ সংকট ও সরকারের দায়দায়িত্ব

বিদ্যুৎ বিভাগ বেশ কিছুদিন ধরে ‘বিদ্যুৎবার্তা’ প্রচার করে আসছে। এই ‘বিদ্যুৎবার্তা’য় আমজনতাকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে সর্বশেষ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কথা। মোটামুটি সব পত্রিকায়ই এই বিজ্ঞাপনটি (?) প্রচার হচ্ছে। যেমন ৩১ জুলাইয়ের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ছিল : উৎপাদন ৪৫০৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট (এর আগের দিন ছিল ৪৬৩২ মেগাওয়াট)। লোডশেডিং ৯৮৫ মেগাওয়াট (গত বছর ছিল ৮৯০ মেগাওয়াট)। গত বছর অর্থাৎ ২০১০ সালের এই দিনে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৯০১ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। এটা সরকারি ভাষ্য, সরকারি প্রপাগান্ডা। ওই ‘বিদ্যুৎবার্তা’য় আমাদের জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, ৬ জানুয়ারি, ২০০৯ যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৩২৬৭ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, সেখানে ৩১ জুলাই, ২০১১ এ উৎপাদন হয়েছে ৪৫০৫ দশমিক ৫ মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়েছে। সরকারি তথ্যে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জুলাইয়ে উৎপাদন যোগ হয়েছে ২০৫ মেগাওয়াট। আর চলতি আগস্টে নতুন উৎপাদন যোগ হবে ৭৯৮ মেগাওয়াট।
সংবাদটি পড়ে যে-কেউ পুলকিত হতে পারেন। হাতে তালিও দিতে পারেন। কিন্তু কোথায় যেন একটা ‘কিন্তু’ আছে। উৎপাদন যদি বাড়েই, তাহলে বিদ্যুতের এই পরিস্থিতি কেন? ১ আগস্টের রাতের কথাই বলিÑ আমি যে এলাকায় থাকি (আদাবর) সেখানে রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত কোন বিদ্যুৎ ছিল না। আর দিনের বেলার কথা নাইবা বললাম। দিনের মধ্যে কতবার যে বিদ্যুৎ যায়, তার হিসাব করিনি। ক্লাস নিতে গিয়ে পারিনি বিদ্যুতের অভাবে। এখন শুধু রাতেই যদি কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে (অথচ রাতে বিদ্যুতের চাহিদা কম। অফিস, কল-কারখানা বন্ধ), তাহলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি যে কোথায়, তা সহজেই আঁচ করা যায়। বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সরকারি বক্তব্যকে সমর্থন করছে না। সরকার যে তথ্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল নেই।
বিদ্যুৎ নিয়ে সংকট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উৎপাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্ল্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাটে কি আদৌ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তাহলে যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফ্ল্যাটগুলো কিনছেন, তারা কী করবেন? আবাসনশিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোন মঙ্গল বয়ে আনবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবেলায় সরকার ২০০৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতিদ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট তিন হাজার ১০০ কিলোমিটার লাইন দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের আটটি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কনোকো-ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাসপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, স্থলভাগে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। কনোকো-ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে দেশব্যাপী এখন গণসংযোগ করছেন। তাদের যুক্তি একটাই, কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। মিয়ানমার ও ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়াও যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে দিতে ন্যূনতম আরও পাঁচ-ছয় বছর প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এই মজুদও বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সংকট আছে, তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করব? গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লাসম্পদ ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উš§ুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবেÑ এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উš§ুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে এবং অনেককে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উš§ুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উš§ুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে, শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোন কোন বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে বড়পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উš§ুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ছয়জন। এরা উš§ুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি শুনে আসছি। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোন কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে উš§ুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি-নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোন কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোন কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছেÑ অস্ট্রেলিয়া ৭৯, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ। এখানে আরও একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও আমরা খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছি আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে।
বিদ্যুৎ ঘাটতিতে সরকারি দলের সংসদ সদস্যরাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ৩ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। কমিটির সভায় সরকারের দেয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যানও প্রত্যাখ্যান করা হয়। সরকারি দলের এমপিরা যখন খোদ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি সমস্যার কোন সমাধান নয়। বিদ্যুৎ সংকট আগামীতে আরও ঘনীভূত হবে। এটা অন্যতম একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে যেতে পারে এখন। সরকার এখন বিভিন্ন ‘চাপ’-এর মুখে আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। এখন এর সঙ্গে যোগ হল বিদ্যুৎ ঘাটতির বিষয়টি। বিদ্যুৎ ঘাটতি রোধে সরকারের কাছে এ মুহূর্তে কোন ‘ফর্মুলা’ আছে বলেও মনে হয় না। একমাত্র কয়লা উত্তোলনকে অগ্রাধিকার দিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের একটা পথ হতে পারে। এ জন্য দ্রুত কয়লানীতি মন্ত্রিসভায় পাস করা জরুরি।
দৈনিক যুগান্তর, ১০ ই আগস্ট, বুধবার,
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment