আগামী ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ফিরতি সফর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। তখন বেশ কয়েকটি চুক্তি তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন ফিরতি সফরে আসছেন মনমোহন সিং। এর আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন বেশ কয়েকজন ভারতীয় মন্ত্রী। বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এমনকি কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাংলাদেশ সফরও দুদেশের সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় পেঁৗছে দিয়েছিল। যদিও সোনিয়া গান্ধীর সফর কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। কেননা তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত নেই। তারপরও তিনিই পর্দার অন্তরালে ভারত সরকারের মূল ব্যক্তি। মনমোহন সিং সরকার পরিচালনা করলেও, সোনিয়া গান্ধীর পরামর্শ তিনি নেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনমোহন সিংয়ের এই সফর বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা রয়েছে, যার সমাধান বাঞ্ছনীয়। শোনা যাচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিস্তার পানি বণ্টন যেমনি গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা। যদিও ভারতীয় পক্ষ বারবার বলে আসছে ভারত টিপাইমুখে এমনকিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের আশ্বাসের বাণী সত্ত্বেও পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত এই প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। গত ১২ জুলাই বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় ভারতে নর্থ ইস্টার্ন ইলকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান প্রেমচান্দ পংকজের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে, সেখানে তিনি বলেছেন টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই (আমার দেশ)। বলা ভালো, ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরা চাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ নামক স্থানে বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এমনকি আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও বলেছেন এই বাঁধটি নির্মিত হবেই। এ কারণেই মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হোক।
বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ যে বড় ধরনের একটি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে বলা হচ্ছে ৯৩০ মিটার দীর্ঘ ও ৯৬৯ মিটার উঁচু এই বাঁধটি চালু হলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কি. মি. এলাকা মারুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে এবং বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে। প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রভাবিত হবে এর কারণে। ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়বে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং বেশকিছু শাখা নদী মরে যাবে। বলাবাহুল্য, এই বাঁধটিতে প্রায় ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি আটকে রাখা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। পানি সম্পদমন্ত্রী এই বাঁধটির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত না হলেও গেল বছর টিপাইমুখ সফররত সংসদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন এই ক্ষয়ক্ষতির কথা।
২০১০ সালের ২৮ জুলাই বিবিসির বাংলা বিভাগ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন পরিবেশন করে। বাংলাবিভাগের প্রতিনিধি নিজে টিপাইমুখ এলাকায় গিয়েছিলেন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সাধারণ মানুষ, যারা বংশপরম্পরায় ওই এলাকায় বসবাস করে আসছে, তারা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের জমি হারানোর কথা। বাঁধটি নির্মাণ করা হলে যে এলাকাগুলো সম্পূর্ণ পানির নিচে ডুবে যাবে, তার ৯৪ শতাংশ মনিপুরে আর বাকি ৬ শতাংশ মিজোরামে পড়েছে। মনিপুর হারাবে ৪৭৬০ হেক্টর বাগান, ২০৫৩ হেক্টর ধানি জমি, ১৭৮.২১ বর্গ কিমি বনভূমি। আর আসাম, মনিপুর ও মিজোরাম একত্রে হারাবে মোট ৩১১ হাজার হেক্টর ভূমি। উভয় রাজ্যের ৬৭টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মনিপুরের ১৬ গ্রাম সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে পানির নিচে। এই পরিসংখ্যান মনিপুরের পরিবেশবাদীদের। আমরা বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা না হয় নাইবা বললাম। মনিপুরের পরিবেশবাদীরা গত বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা বাংলাদেশে এসে তাদের সমস্যার কথা বলে গেছেন। বলে গেছেন বাংলাদেশকে টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাতে। এরপর সংসদের সরকারি প্রতিনিধি দল ভারত গেলেন। তারা কিন্তু সেখানে গিয়ে মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলেননি। তাদের কি কথা বলা উচিত ছিল না? আমি নিশ্চিত যে, খোদ মনিপুরই যখন বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি, তখন বাংলাদেশ যে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, এ কথাটা রাজ্জাক সাহেব সাহস করে ভারতীয় পক্ষকে বলেননি। বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী যখন নিজে ভারতীয় হাই কমিশনারের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন, তখন আমি সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রীর ওপরও আস্থা রাখতে পারি না। প্রতিনিধি দলে সংসদ সদস্য ছিলেন ৬ জন। এরা জনপ্রতিনিধি। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। কিন্তু তাদের তো সেই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নেই। তারা কি বুঝবেন বাঁধ নির্মাণের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? বাঁধের এরিয়াল সার্ভে ম্যাপ, হাইড্রোলজিক্যাল ম্যাপ, জিয়োটেকটোনিক ডাটা বিশ্লেষণ করার ও বোঝার জ্ঞান দরকার, তাদের তা নেই। এজন্য একাধিক কারিগরি বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন ছিল। পানি সম্পদ সচিব প্রায় একবছর হলো এ মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। তারও এ ব্যাপারে জ্ঞান সীমিত। সেই অর্থে বিশেষজ্ঞ ছিলেন দুজন_ যৌথ নদী কমিশনের একজন সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ বিভাগের একজন অধ্যাপক। যেখানে যৌথ নদী কমিশনে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা হয়নি, সেখানে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য প্রতিনিধি দলটিকে সহযোগিতা করতে পারেননি। বুয়েটের যিনি অধ্যাপক তার কাছেও প্রচুর তথ্য ও উপাত্ত নেই।
বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী স্বয়ং নিজে স্বীকার করেছেন ভারত বাঁধটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্তের হিসাব ছাড়া আর কোনো তথ্য দেয়নি। তাহলে এই তথ্য নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক সাহেব প্রতিনিধিদলকে আদৌ সহযোগিতা করতে পারেননি। এ বিষয়ে তিনি কোনো গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রে যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন, তাদের কয়েকজন ভারতে গেলে ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। টিপাইমুখ বিতর্ক এড়ানোর জন্য সরকার এটি করলে ভালো করত। আরো একটি কথা। টিপাইমুখ ব্যর্থ সফর শেষে প্রতিনিধি দল ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। গত এক বছরে আমরা আর টিপাইমুখ নিয়ে কিছু শুনিনি। ভারত আমাদের তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেও, সংসদীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করাও সম্ভব ছিল না। তবে আমার বিশ্বাস ভারত ওই প্রতিনিধি দলকে আদৌ কারিগরি তথ্য ও উপাত্ত দেয়নি। এদিকে গত ৩০ জুলাই (২০১০) সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ ভারত নেবে না। টিপাইমুখে কোনো সেচ প্রকল্প হবে না, এমন কথাও আমাদের জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আমরা কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারি? গঙ্গার পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে অতীতে ভারত আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা।
গত ৫ জুলাই (২০১১), ছাপা হওয়া একটি সংবাদই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া গঙ্গা পানি চুক্তির পর এ বছর পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ সবচেয়ে কম। ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে আগেভাগেই পানি প্রত্যাহার ও ১ জানুয়ারি থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন ভারতীয় মন্ত্রীর কথায় আমরা আস্থা রাখি কিভাবে? আমরা কখনো বলিনি টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে তা সেচকাজে ব্যবহার করবে। ভারতের কাছারে বরাকের উজানে ফুলেরতাল এলাকায় ভারত নির্মাণ করছে একটি ব্যারাজ, যার মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে অথবা সংরক্ষণ করে এ অঞ্চলের সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করবে। ভারতীয় মন্ত্রী কিন্তু ফুলেরতাল প্রকল্পের ব্যাপারে কিছু বলেনি। আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই বাংলাদেশ সরকার ফুলেরতাল ব্যারাজ নির্মাণের ব্যাপারটি নিয়ে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা কখনো? না হলে, আলোচনাটা এখন জরুরি।
সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের টিপাইমুখ পরিদর্শনের পর এক বছর পার হয়েছে। এরই মধ্যে এলো প্রেমচান্দের বক্তব্যটি। এখন রাজ্জাক সাহেব বিষয়টি কিভাবে নেবেন, আমি জানি না। তবে তিনি বাংলাদেশি হাইকমিশনের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। তিনি সংসদে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন বটে। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা জানতে চাই স্থায়ী কমিটির মূল্যায়ন কি? আমরা দেখতে চাই টিপাইমুখ তথা ফুলেরতাল ব্যারেজ 'ডিটেইলড প্ল্যান'_ যা ভারতীয় পক্ষ আমাদের সরবরাহ করবে এবং আমাদের বিশেষজ্ঞরা এই 'ডিটেইলড প্ল্যান' নিয়ে পর্যালোচনা করবেন। ফারাক্কা চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে দিলি্ল আমাদের নদীগুলোর উজানে কোনোরকম স্থাপনা তৈরি করবে না। তখন আমাদের প্রশ্ন ভারত এই চুক্তির লঙ্ঘন করছে কি না? টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের শঙ্কা আমরা ভারতীয় পক্ষকে অবহিত করেছি কি না, তাও আমরা জনাব রাজ্জাকের মুখ থেকে জানতে চাই। আসলে ভারত 'কূট' কৌশলের কাছে আমরা শক্ত হাতে দাঁড়াতে পারি না। ভারত মুখে বলে এক কথা। কাজ করে উল্টোটি।
সারা বিশ্বেই বড় বড় বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাংক এ ধরনের প্রকল্পে সাধারণত অর্থায়ন করে না। বিশ্বজনমতকে আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। ভারতে অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গেও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করা যায়। মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গেও আমরা সম্পর্ক বাড়াতে পারি। এ কাজগুলো সরকার যদি না করে, তাহলে তা করতে হবে বিরোধী দলকে। সেই সঙ্গে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের।দৈনিক যায় যায় দিন, মঙ্গলবার ১৬ আগস্ট ২০১১ ১ ভাদ্র ১৪১৮ ১৫ রমজান ১৪৩২
ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মনমোহন সিংয়ের এই সফর বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। কেননা বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা রয়েছে, যার সমাধান বাঞ্ছনীয়। শোনা যাচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিস্তার পানি বণ্টন যেমনি গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা। যদিও ভারতীয় পক্ষ বারবার বলে আসছে ভারত টিপাইমুখে এমনকিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ লঙ্ঘিত হয়। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের আশ্বাসের বাণী সত্ত্বেও পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত এই প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। গত ১২ জুলাই বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় ভারতে নর্থ ইস্টার্ন ইলকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনের চেয়ারম্যান প্রেমচান্দ পংকজের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে, সেখানে তিনি বলেছেন টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই (আমার দেশ)। বলা ভালো, ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরা চাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ নামক স্থানে বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এমনকি আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও বলেছেন এই বাঁধটি নির্মিত হবেই। এ কারণেই মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হোক।
বাঁধটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ যে বড় ধরনের একটি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে বলা হচ্ছে ৯৩০ মিটার দীর্ঘ ও ৯৬৯ মিটার উঁচু এই বাঁধটি চালু হলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রীষ্মকালে ৯৪৬ কি. মি. এলাকা মারুভূমির ন্যায় শুকনো থাকবে এবং বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছাড়লে ব্যাপক বন্যা হবে। প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রভাবিত হবে এর কারণে। ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়বে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং বেশকিছু শাখা নদী মরে যাবে। বলাবাহুল্য, এই বাঁধটিতে প্রায় ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি আটকে রাখা হবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। পানি সম্পদমন্ত্রী এই বাঁধটির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত না হলেও গেল বছর টিপাইমুখ সফররত সংসদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন এই ক্ষয়ক্ষতির কথা।
২০১০ সালের ২৮ জুলাই বিবিসির বাংলা বিভাগ টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন পরিবেশন করে। বাংলাবিভাগের প্রতিনিধি নিজে টিপাইমুখ এলাকায় গিয়েছিলেন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সাধারণ মানুষ, যারা বংশপরম্পরায় ওই এলাকায় বসবাস করে আসছে, তারা অকপটে স্বীকার করেছেন তাদের জমি হারানোর কথা। বাঁধটি নির্মাণ করা হলে যে এলাকাগুলো সম্পূর্ণ পানির নিচে ডুবে যাবে, তার ৯৪ শতাংশ মনিপুরে আর বাকি ৬ শতাংশ মিজোরামে পড়েছে। মনিপুর হারাবে ৪৭৬০ হেক্টর বাগান, ২০৫৩ হেক্টর ধানি জমি, ১৭৮.২১ বর্গ কিমি বনভূমি। আর আসাম, মনিপুর ও মিজোরাম একত্রে হারাবে মোট ৩১১ হাজার হেক্টর ভূমি। উভয় রাজ্যের ৬৭টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মনিপুরের ১৬ গ্রাম সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে পানির নিচে। এই পরিসংখ্যান মনিপুরের পরিবেশবাদীদের। আমরা বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা না হয় নাইবা বললাম। মনিপুরের পরিবেশবাদীরা গত বছর বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা বাংলাদেশে এসে তাদের সমস্যার কথা বলে গেছেন। বলে গেছেন বাংলাদেশকে টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাতে। এরপর সংসদের সরকারি প্রতিনিধি দল ভারত গেলেন। তারা কিন্তু সেখানে গিয়ে মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলেননি। তাদের কি কথা বলা উচিত ছিল না? আমি নিশ্চিত যে, খোদ মনিপুরই যখন বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি, তখন বাংলাদেশ যে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, এ কথাটা রাজ্জাক সাহেব সাহস করে ভারতীয় পক্ষকে বলেননি। বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী যখন নিজে ভারতীয় হাই কমিশনারের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন, তখন আমি সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রীর ওপরও আস্থা রাখতে পারি না। প্রতিনিধি দলে সংসদ সদস্য ছিলেন ৬ জন। এরা জনপ্রতিনিধি। জনগণ তাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। কিন্তু তাদের তো সেই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নেই। তারা কি বুঝবেন বাঁধ নির্মাণের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? বাঁধের এরিয়াল সার্ভে ম্যাপ, হাইড্রোলজিক্যাল ম্যাপ, জিয়োটেকটোনিক ডাটা বিশ্লেষণ করার ও বোঝার জ্ঞান দরকার, তাদের তা নেই। এজন্য একাধিক কারিগরি বিশেষজ্ঞ থাকা প্রয়োজন ছিল। পানি সম্পদ সচিব প্রায় একবছর হলো এ মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। তারও এ ব্যাপারে জ্ঞান সীমিত। সেই অর্থে বিশেষজ্ঞ ছিলেন দুজন_ যৌথ নদী কমিশনের একজন সদস্য ও বুয়েটের পানিসম্পদ বিভাগের একজন অধ্যাপক। যেখানে যৌথ নদী কমিশনে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা হয়নি, সেখানে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য প্রতিনিধি দলটিকে সহযোগিতা করতে পারেননি। বুয়েটের যিনি অধ্যাপক তার কাছেও প্রচুর তথ্য ও উপাত্ত নেই।
বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী স্বয়ং নিজে স্বীকার করেছেন ভারত বাঁধটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্তের হিসাব ছাড়া আর কোনো তথ্য দেয়নি। তাহলে এই তথ্য নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক সাহেব প্রতিনিধিদলকে আদৌ সহযোগিতা করতে পারেননি। এ বিষয়ে তিনি কোনো গবেষণা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রে যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন, তাদের কয়েকজন ভারতে গেলে ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। টিপাইমুখ বিতর্ক এড়ানোর জন্য সরকার এটি করলে ভালো করত। আরো একটি কথা। টিপাইমুখ ব্যর্থ সফর শেষে প্রতিনিধি দল ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। গত এক বছরে আমরা আর টিপাইমুখ নিয়ে কিছু শুনিনি। ভারত আমাদের তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করলেও, সংসদীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করাও সম্ভব ছিল না। তবে আমার বিশ্বাস ভারত ওই প্রতিনিধি দলকে আদৌ কারিগরি তথ্য ও উপাত্ত দেয়নি। এদিকে গত ৩০ জুলাই (২০১০) সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছিলেন যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ ভারত নেবে না। টিপাইমুখে কোনো সেচ প্রকল্প হবে না, এমন কথাও আমাদের জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আমরা কতটুকু আশ্বস্ত হতে পারি? গঙ্গার পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে অতীতে ভারত আমাদের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলে ভিন্ন কথা।
গত ৫ জুলাই (২০১১), ছাপা হওয়া একটি সংবাদই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া গঙ্গা পানি চুক্তির পর এ বছর পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ সবচেয়ে কম। ভারত ফারাক্কা পয়েন্টে আগেভাগেই পানি প্রত্যাহার ও ১ জানুয়ারি থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয়ার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন ভারতীয় মন্ত্রীর কথায় আমরা আস্থা রাখি কিভাবে? আমরা কখনো বলিনি টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে তা সেচকাজে ব্যবহার করবে। ভারতের কাছারে বরাকের উজানে ফুলেরতাল এলাকায় ভারত নির্মাণ করছে একটি ব্যারাজ, যার মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে অথবা সংরক্ষণ করে এ অঞ্চলের সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করবে। ভারতীয় মন্ত্রী কিন্তু ফুলেরতাল প্রকল্পের ব্যাপারে কিছু বলেনি। আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই বাংলাদেশ সরকার ফুলেরতাল ব্যারাজ নির্মাণের ব্যাপারটি নিয়ে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা কখনো? না হলে, আলোচনাটা এখন জরুরি।
সংসদের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের টিপাইমুখ পরিদর্শনের পর এক বছর পার হয়েছে। এরই মধ্যে এলো প্রেমচান্দের বক্তব্যটি। এখন রাজ্জাক সাহেব বিষয়টি কিভাবে নেবেন, আমি জানি না। তবে তিনি বাংলাদেশি হাইকমিশনের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। তিনি সংসদে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন বটে। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা জানতে চাই স্থায়ী কমিটির মূল্যায়ন কি? আমরা দেখতে চাই টিপাইমুখ তথা ফুলেরতাল ব্যারেজ 'ডিটেইলড প্ল্যান'_ যা ভারতীয় পক্ষ আমাদের সরবরাহ করবে এবং আমাদের বিশেষজ্ঞরা এই 'ডিটেইলড প্ল্যান' নিয়ে পর্যালোচনা করবেন। ফারাক্কা চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে দিলি্ল আমাদের নদীগুলোর উজানে কোনোরকম স্থাপনা তৈরি করবে না। তখন আমাদের প্রশ্ন ভারত এই চুক্তির লঙ্ঘন করছে কি না? টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমাদের শঙ্কা আমরা ভারতীয় পক্ষকে অবহিত করেছি কি না, তাও আমরা জনাব রাজ্জাকের মুখ থেকে জানতে চাই। আসলে ভারত 'কূট' কৌশলের কাছে আমরা শক্ত হাতে দাঁড়াতে পারি না। ভারত মুখে বলে এক কথা। কাজ করে উল্টোটি।
সারা বিশ্বেই বড় বড় বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাংক এ ধরনের প্রকল্পে সাধারণত অর্থায়ন করে না। বিশ্বজনমতকে আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। ভারতে অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গেও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করা যায়। মনিপুরের পরিবেশবাদীদের সঙ্গেও আমরা সম্পর্ক বাড়াতে পারি। এ কাজগুলো সরকার যদি না করে, তাহলে তা করতে হবে বিরোধী দলকে। সেই সঙ্গে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের।দৈনিক যায় যায় দিন, মঙ্গলবার ১৬ আগস্ট ২০১১ ১ ভাদ্র ১৪১৮ ১৫ রমজান ১৪৩২
ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিস্ঠ অত্যান্ত যুক্তিপূর্ণ কথা বলায় স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অসাধারন এক লেখা!
ReplyDelete