রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয়া কেন জরুরি

বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বিপদেই আছেন মনে হচ্ছে। গত ৪ আগস্ট ঢাকায় এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেছিলেন, 'আপনারা কম খান, কম খেলে সমস্যা কমবে। ব্যবসায়ীরা ভেজাল মেশাতে নিরুৎসাহিত হবে। খাদ্যের মাধ্যমে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে সহজে প্রবেশ করে। আগেকার মানুষ কম খেত বলে বেশি দিন বাঁচত।' ফারুক খানের এই বক্তব্য প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় এভাবেই ছাপা হয়েছে। তিনি এর প্রতিবাদও করেননি। ফলে ধরে নিতে হবে তিনি যা বলেছেন, সংবাদপত্রে তার বক্তব্য সেভাবেই ছাপা হয়েছে। ফারুক খানের এই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন সরকারি দায়িত্বশীল পদে বসে কারো দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দেয়া উচিত নয়। কারো নাম উল্লেখ না করেই তিনি বলেছেন 'দায়িত্ব পালন করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান'। অত্যন্ত স্পষ্টভাষী ওবায়দুল কাদেরকে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে মনে করেন আওয়ামী লীগের 'বিবেক'। তিনি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও, মাঝে মধ্যে স্পষ্ট কথা বলেন। অতীতেও তিনি মন্ত্রীদের সমালোচনা করেছেন। ছাত্রলীগের এই সাবেক নেতা বর্তমানে ছাত্রলীগের কর্মকা-েও অসন্তুষ্ট। তাই স্পষ্টভাষী এই নেতা যখন ফারুক খানের ওই বক্তব্যের একদিন পর এ ধরনের কথা বলেন, তখন বুঝতে কারো বাকি থাকে না ফারুক খানের ওই বক্তব্যে খোদ দলের মধ্যেই একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যে ক'জন ব্যক্তি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না, তার মাঝে বাণিজ্যমন্ত্রী অন্যতম। অতীতেও তিনি একাধিকবার বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধামকি দিয়েও বাগে আনতে পারেননি। ব্যবসায়ীরা তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অতি উচ্চমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করলেও, বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তার ব্যর্থতা এখানেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ আজ হতাশাগ্রস্ত। ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজির বাস্তবায়ন এখন প্রশ্নের মুখে। যে রেমিটেন্স নিয়ে আমাদের এত গর্ব, সেখানে আশার কোনো খবর নেই। রেমিটেন্স আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরের অর্থ এসেছে (১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার), তার প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। এর অর্থ পরিষ্কার শ্রমবাজার খোঁজার ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মূল জনবল রফতানির বাজার মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে (কিন্তু নেপালের মতো দেশের সম্ভাবনা সেখানে বাড়ছে কোনো কোনো দেশে)। দেশে বেকার সমস্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। কিন্তু সরকারের কোনো বড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনিতেই জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ছয় বছর আগে ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখনো সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে (কালের কণ্ঠ ৫ জুলাই)। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভালো তা বলা যাবে না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন পুলিশের জন্য আরো ১০টি আইজি পদ চাচ্ছেন, তখন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। শুধু এক মাসে ২৬ শিশু ও ১২ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সকালের খবর গত ৭ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে। আর জুন মাসে ঢাকা শহরের একাধিক সোনার দোকানে ও বাসায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ভূমিকা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হলো যখন বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়েছিলেন। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন পুলিশের পিটুনির শিকার হন, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। পুলিশের পিটুনির পরও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য তিনি এখন বিদেশে। মামলা হয়েছে আরেকজন এমপির বিরুদ্ধেও।
সরকারের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ একাধিক। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আসছেন সেপ্টেম্বরে। এসে গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সোনিয়া গান্ধী স্বয়ং। স্পষ্টতই বোঝা যায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি নতুন দিকে টার্ন নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমস্যা রয়েছে একাধিক। গত ৪০ বছরেও সেসব সমস্যার সমাধান হয়নি। আমরা ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু বিদ্যুৎ কবে আসবে, আমরা জানি না। 'হাই প্রোফাইল' ভিজিট ভালো। কিন্তু আমরা পদ্মায় পানি চাই। চাই তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার। চাই বিএসএফের হত্যা বন্ধ। চাই ছিটমহলগুলো ফেরত। ভারতকে 'বন্ধু' ভাবতে চাই। কিন্তু এই বন্ধুত্ব হতে হবে একপক্ষীয় নয়, দ্বিপাক্ষিক, প্রয়োজনে বহুপাক্ষিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য এটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ_ অতি মাত্রায় ভারত নির্ভরতা বাংলাদেশের জন্য 'ইমেজ সংকট' সৃষ্টি করতে পারে।
রাজনীতি এক অনিশ্চয়তার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। সরকারের কঠোর মনোভাব সংকটকে আরো জটিল করেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বিরোধী দলের উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিশেষ করে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে পরিবর্তন আনাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কীভবে পরিবর্তন আনা যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা যায়, এ বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে 'সংলাপ' ওপেন করা জরুরি। বেগম জিয়া ইতিমধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন কোন কোন জায়গায় পরিবর্তনটা প্রয়োজন। তার ওই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিলে একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু তা না করে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, মামলা দিয়ে যদি বিরোধী দলকে দমিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়, তা সরকারের জন্য খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না। কেননা সংবিধান একটি দেশের, কোনো দলের নয়। দলীয় বিবেচনায় সংবিধান সংশোধন করা ঠিক নয়। সরকার ও বিরোধী দল নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়। বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে যে 'গণতন্ত্র', তাকে কোনোমতেই 'গণতন্ত্র' বলা যাবে না।
বেগম জিয়া ঈদের পর বড় ধরনের গণআন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটাকে বিবেচনায় নিতে হবে। হরতাল, লাগাতার হরতাল, লংমার্চ ইত্যাদি কর্মসূচি আসছে। এসব কর্মসূচি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় পেঁৗছে দেবে না। সরকারের কঠোর মনোভাব দেশকে চরম অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। আর এর দায়ভার নিতে হবে সরকারকেই। লাগাতার হরতাল ও গণঅনশনের পর বিএনপি একটা ম্যাসেজ পেঁৗছে দিয়েছে আর তা হচ্ছে, অতি দ্রুত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের উদ্যোগ নেয়া। যে দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে পঞ্চশ সংশোধনী আনা হয়েছিল, একই ধরনের দ্রুততার সঙ্গে সংবিধানে ১৬তম সংশোধনী আনা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা ও 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' সংবিধানে ফিরিয়ে আনা। একটি আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা জরুরি। সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে যদি আস্থার পরিবেশ না থাকে, তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেবেই। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে ব্যবসায়ী। তার পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আজ সংসদ যদি ঠিক মতো চলতো, তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। বাজার মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে_ এটা সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। দুঃখ লাগে একজন মাননীয় সংসদ সদস্যও সংসদে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্নটা করলেন না। অথচ সাধারণ মানুষের ভোটেই এরা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং আগামীতে নির্বাচিত হবারও স্বপ্ন দেখছেন।
সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আস্থার পরিবেশ নেই বলেই আদালতপাড়ায় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো। আদালতে আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতির খবর কোনো ভালো খবর নয়। কোনো বিচারপতিকে নিয়ে কটূক্তি করাও শোভন নয়, কাম্য নয়। একজন বিচারপতিকে সম্মান করেই সম্বোধন করতে হয়। আদালতপাড়ায় রাজনীতি টেনে আনাও কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বেশ কয়েকজন আইনজীবীর সনদ বাতিল করে রুল ইস্যু করা হয়েছে। এর একটা সমাধান প্রয়োজন। ধারণা করছি সিনিয়র আইনজীবীদের মধ্যস্থতায় একটা সমাধান পাওয়া যাবে। আদালতপাড়ায় এসব ঘটনা আমাদের আহত করে। আমাদের আস্থার জায়গাটা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়।
বর্তমান সরকার আরো দু'বছরের উপরে ক্ষমতায় থাকবে। সরকার সাধারণ মানুষের যে সমস্যা, সেসব সমস্যার দিকে নজর দেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সেই সঙ্গে সরকার যদি পুনরায় সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়, আমার বিশ্বাস এতে করে সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে। 
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment