রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অবনতিশীল শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক

লেখাটা শুরু করি আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক রওনাক জাহানকে নিয়ে। স্বাধীনতার পর আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়তে এলাম, তখন রওনাক জাহান ছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান। ভীষণ গুরুগম্ভির, তার রুমে যেতে ভয় করত। ছাত্রজীবনে তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তাও নয়। তাও অনেক ছাত্র, সবাইকে মনে রাখাও কঠিন। তবে আমার কথাটা তাও মনে ছিল, কারণ আমি জার্মানি থেকে পিএইচডি করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগ দিয়েছিলাম। সম্ভবত সে কারণেই মনে রাখা। কিন্তু দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না, এমনকি এখনও নেই। আশির দশকের মাঝামাঝি আমার পিএইচডি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আমি যখন জেনেভায় গিয়েছিলাম, অধ্যাপক রওনাক জাহান তখন আইএলওতে। আমি যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আইএলও’র ক্যান্টিনে নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য খাবার কিনলেন। আমরা খেলাম।
দ্বিতীয় ঘটনার কথা বলি। রওনাক ম্যাডাম তখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি তখন নিউইয়র্কে। ফোন করলাম। সেই একই কণ্ঠ, আসতে বললেন। কলাম্বিয়ার স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিল্ডিংয়ের খুব সম্ভবত এগার তলায় তার সঙ্গে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন নিজ হাতে কফি বানিয়ে তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষকের তার একজন ছাত্রের প্রতি কতটুকু ভালোবাসা থাকে, কতটুকু আন্তরিক তিনি, অধ্যাপক রওনাক জাহান তার বড় উদাহরণ।
আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই। তিনি আমার শিক্ষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, এখন ইসলামাবাদ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন। আমি ইসলামাবাদ গেছি। স্যারের ফোন জোগাড় করে একটি ক্যাব নিয়ে রাতে তার বাসায় গেলাম। মনে আছে রাত প্রায় এগারটার দিকে তিনি অনেক দূর হেঁটে এসে মেইন রাস্তায় আমাকে একটা ট্যাক্সি ক্যাবে তুলে দিয়েছিলেন। একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে কতটুকু ভালোবাসতে পারেন, নজরুল ইসলাম স্যার ছিলেন তার একটি প্রমাণ।
অন্য আরেকটি দৃষ্টান্ত দিই। অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে প্রয়াত। ২০০৬ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্যপদে নিয়োগ পেলাম, যেদিন আগারওগাঁও অফিসে যোগ দিতে গেলাম, সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তার চোখে সেদিন আমি অশ্র“ দেখেছিলাম। ধানমণ্ডির ৩ নম্বর রোডে তার সরকারি কোয়ার্টারের পাশেই ছিল আমার সরকারি এপার্টমেন্ট। কতদিন যে ফোন করে তার বাসায় ডেকে নরসিংদীর মিষ্টি খাইয়েছেন, আমি বলতে পারব না। আমাকে অনেক øেহ করতেন। আমার অবর্তমানে অন্যদের কাছে প্রশংসাও করতেন। একজন শিক্ষক কত আন্তরিক হলে ছাত্রের প্রশংসা করেন, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান এর বড় প্রমাণ।
বাংলাদেশ বলি কেন? জার্মানিতে আমার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ডিটমার রথারমুন্ড। বিখ্যাত হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশে আমরা অনেকে অধ্যাপক রথারমুন্ডের ছাত্র ছিলাম। আমাদের এক সহকর্মী যখন তার ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন পিতার মতো তার ছাত্রের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার গবেষণার কাজটি দ্রুত দেখে দিয়েছিলেন। আমি নিজে কীভাবে তার কাছে উপকৃত হয়েছি, তা আজ নাইবা বললাম। আমার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এগবার্ট ইয়ান (জার্মানিতে দু’জন তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন হয়)। আমরা প্রায় প্রতি রোববার তার বাসায় ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হতাম। তার উদ্যোগেই তিনি আমাকে রাশিয়ার মস্কো ও পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে পাঠিয়েছিলেন। সেটা প্রয়োজন ছিল আমার গবেষণার জন্যই। মিসেস ইয়ান, যিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা, আমাদের জন্য রান্না করতেন। প্রতি রোববার। দৃষ্টান্তগুলো দিলাম এটা বোঝানোর জন্য যে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হয়, কেমন হওয়া উচিত। কিন্তু আজ যারা শিক্ষকতায় আসছেন, তাদের মধ্যে এ উপলব্ধিটুকু কি আছে? আজ আমার ছাত্র, যারা শিক্ষক হয়েছেন, তাদের মধ্যে সেই সৌজন্যবোধটুকু নেই। এতটা বছর শিক্ষকতা করলাম, দুই যুগেরও বেশি, আমার প্রাপ্য হচ্ছে আমার ছাত্রদের কাছ থেকে অসম্মান পাওয়া? আমার একাডেমিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া? এটা আমার বড় ব্যর্থতা। একজন ব্যর্থ শিক্ষক আমি। আমি একজন রওনাক জাহান হতে পারলাম না! একজন আসাদুজ্জামান আমি হতে চাইনি। অনেক বড় মাপের মানুষ তিনি। আমি তার ছাত্র। আমার সৌভাগ্য আমার শিক্ষকের সঙ্গেই আমি মঞ্জুরি কমিশনে কাজ করেছি। তার মতো শিক্ষক আমি নই। কিন্তু আমি আমার ছাত্রদের নিয়েও এরকমটি আশা করেছিলাম। কী জানি, হয়তো ওদের সৌজন্যবোধটুকু যে কী, তা বোঝাতে পারিনি। শেখাতে পারিনি। আমি ক্লাসে বলি, আমার ছাত্ররাই আমার সন্তান, আমার প্রাণ। ওরা আমার চেয়েও আরও বড় পণ্ডিত হোক। কিন্তু এ কোন জগতে বাস করছি? যেখানে পিতৃতুল্য শিক্ষককে নিয়ে কটাক্ষ করা, অসম্মান করা তাদের রুচিতে বাধে না! কারা আগামী দিনের শিক্ষাঙ্গন নিয়ন্ত্রণ করবে? শিক্ষাঙ্গনে যিনি বা যারা ক্যাডার হিসেবে পরিচিত, কিংবা যারা রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, আমরা তাদের কাছ থেকে কীইবা আশা করতে পারি!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫-এ নির্ধারণ করেছেন। এই ৬৫ হতে আমার এখনও অনেক সময় বাকি। কিন্তু তার আগেই আমি অবসরে যাব। শিক্ষকতার প্রতি আমার আর মোহ নেই। ভালোবাসাও নেই। যে ২৬টি বই লিখেছি, আমার মনে হয় ওখানে আমার ভুল হয়েছে। আমার এই লেখার কোন প্রয়োজন ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্যাবাটিকাল ছুটি নিয়ে যে গবেষণা করেছি, তা বই আকারে প্রকাশও করেছি (অন্যরা করেছে কিনা তা আমার জানা নেই)। আমার অনেক সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছিÑ তাদের সবার মাঝেই দেখেছি এক ধরনের হতাশা। কেন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে? কেন? এই ‘কেন’র জবাব কে দেবে? শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আহমদ আমাদের ভিসি ছিলেন খুব সীমিত সময়ের জন্য। তার কাছেই আমি প্রশ্নটি রাখলাম। জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি, যিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তি, তার কাছেও প্রশ্নটা থাকল। এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক জড়িত। নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে একজন সিনিয়র শিক্ষক কর্তৃক একজন জুনিয়র শিক্ষক (যে তার ছাত্র) প্রহƒত হয়েছিলেন। একজন সিনিয়র শিক্ষক কোন পর্যায়ে গেলে তার অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়, তা ভেবে দেখা দরকার। তবুও তিনি যে ‘কাণ্ডটি’ ঘটিয়েছেন তা সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও বলি, নতুন প্রজšে§র অনেক কিছু শেখার আছে সিনিয়রদের কাছ থেকে। তারা পিতৃতুল্য। পিতাকে অসম্মান করলে নিজেও অসম্মানিত হতে হয়। দ্বিতীয় ঘটনায় একজন তরুণ শিক্ষক অভিযুক্ত হয়েছেন একজন ছাত্রীর আÍহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে। অত্যন্ত মেধাবীসম্পন্ন ওই ছাত্রীর সঙ্গে সেই তরুণ শিক্ষকের ‘সম্পর্ক’ ছিল। ‘সম্পর্ক’ ভেঙে গেলেই ছাত্রীটি আÍহত্যা করে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ‘দোষী’ করা যাবে না, কিন্তু ওই ঘটনায় শিক্ষক-ছাত্রী সম্পর্ক কী হওয়া উচিত, সেই বিষয়টি সামনে চলে এলো। এটি খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ছাত্রী সুমির বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের দাবি করেছে। এটা যুক্তিযুক্ত। সুমির মৃত্যু আমাকে কষ্ট দিয়েছে। যে কিনা আমার মতো একজন শিক্ষক হতে পারত, কেন আÍহননে গেল? একজন মেধাবী এভাবে চলে যাবে, এটা তো কষ্টেরই। একজনের ‘অতীত’ থাকতেই পারে। সেই ‘অতীত’ দিয়ে কারও ‘বর্তমানকে’ বিচার করা ঠিক নয়। এরকম ‘ঘটনা’ কর্তৃপক্ষের জন্যও একটি সতর্কবাণী। বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা ঠিক হবে না।
ক’দিন আগে ৮ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মৌন মিছিলকে উদ্দেশ্য করে কটূক্তি করে ছাত্রলীগের চার কর্মী। তাদের পুলিশে দেয়া হলে ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষক সমিতির ডাকে শিক্ষকরা ক্লাস বর্জন করেন। এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তদন্ত কমিটি কোন রিপোর্ট দেয়নি। ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালাবে, এটা চিন্তাও করা যায় না। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাহলে কাদের পড়াচ্ছেন? ছাত্র মানেই তো সন্তান। এই ‘সন্তান’ এখন ‘পিতার’ গায়ে হাত তুলল?
সবকিছু মিলিয়েই শিক্ষাঙ্গনে এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। জুনিয়র শিক্ষকরা সম্মান করছে না সিনিয়রদের। সিনিয়ররা এক ধরনের হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এর কারণ একটাই রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, যাদের কাছে ‘রাজনৈতিক আনুগত্যটাই’ বেশি, শিক্ষকসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। যে কারণে সিনিয়রদের ‘সম্মান’ করার যে সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতি তারা ধারণ করছেন না। একজন জুনিয়র শিক্ষক সরাসরি ভিসির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ভিসি তাদের ‘নানা কাজে’ ব্যবহার করেন। তাদের কাছে একাডেমির বিষয়গুলো মুখ্য নয়। মুখ্য ‘রাজনৈতিক আনুগত্য’। আমি জানি না একুশ শতকে কোন ধরনের শিক্ষাঙ্গন আমরা পাব। তবে উচ্চশিক্ষা এক ধরনের ঝুঁকির মাঝেই আছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যতদিন শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হবে না, ততদিন জুনিয়র শিক্ষকরা ‘রাজনৈতিক কর্মীর’ মতোই আচরণ করবেন, তারা অসম্মানিত করবেন সিনিয়র শিক্ষকদের। আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয় চালান, তারা যদি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেন, তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
দৈনিক যুগান্তর, ২৩ শে আগস্ট ২০১১ ইং
ড. তারেক শামসুর রেহমান
 অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment