ড. তারেক শামসুর রেহমান
গত ২৯ জুলাইর একটি খবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের পুলিশি নির্যাতনের খবর যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ও তা হাইকোর্টের নজরে আসে, তখন হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে সকালে (২৮ জুলাই) একটি রুল জারি করেছিল। আর বিকালে শুনানি শেষে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। আট সপ্তাহের মধ্যে বিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের একটি আদেশে আমরা আশার আলো দেখতে পাই। আদালত যে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে, এটা একটা বড় প্রমাণ। নিরীহ ছাত্র কাদেরকে পুলিশ ডাকাত বানিয়েছিল। যে ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে পড়ে পাস করে বেরুনোর পরপরই যার ভালো চাকরি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে পুলিশ তাকে ডাকাত বানিয়ে ফেললো। আজ মাননীয় বিচারপতিরা যদি হস্তক্ষেপ না করতেন, তাহলে কাদেরকে হয়তো জেলের ঘানি টানতে হতো। একজন মেধাবী ছাত্র কাদের হয়তো শেষ পর্যন্ত ডাকাত (?) হিসেবেই পরিচিত হতো। এর চেয়ে আর দুঃখজনক তো কিছু হতে পারে না।
সাম্প্রতিককালে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আমিনবাজারে ৬ ছাত্রের হত্যাকা- ও সেখানে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে পুলিশের ব্যর্থতা কিংবা আরো আগে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে নানা কথা। এর একটি ঘটনায়ও পুলিশের ভূমিকাকে সমর্থন করেননি কেউ। আজ যখন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে হাইকোর্ট প্রশ্ন তোলে, তখন একটা আস্থার জায়গা আমরা দেখতে পাই। এর আগে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ ১২ জুলাই সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, 'দয়া করে জাতিকে উদ্ধার করুন। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে জাতি উদ্বিগ্ন। এই সংকটপূর্ণ অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়।' বিচারপতিদের ওই মন্তব্যই বলে দেয় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন। অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ১১৮ দশমিক ৩৬ ভাগ ও ১৪৬ দশমিক ১৫ ভাগ। ২০১০-২০১১ অর্থবছরের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘর অতিক্রম করে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সার ও ডিজেলের দামও বাড়ান হয়েছে। ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ায় এমডিজি'র বাস্তবায়ন (২০১৫ সালের মধ্যে) এখন প্রশ্নের মুখে। রেমিটেন্স আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-২০১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। বিদেশে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার দিনে দিনই সংকুচিত হয়ে আসছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়েও সমস্যা রয়ে গেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী (৫ জুলাই) ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখনো সেই পরিমাণ বিদ্যুৎই উৎপাদন হচ্ছে। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না। এর মাঝে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। পুলিশের পিটুনিতে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য এখন নিউইয়র্কে। জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে পুলিশের কী লাভ হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু এতে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পুলিশি অত্যাচারের ওই ছবি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র বিশ্বে, যা পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশের এই 'অতি বাড়াবাড়ি'র সমালোচনা না করে সমর্থন করেছিলেন। অতীতেও পুলিশ প্রায় একই ধরনের 'কা-' করেছে। পুলিশের জন্য একটি 'কোড অফ কনডাকট' প্রণয়ন করা বোধ হয় জরুরি হয়ে পড়েছে। মিডিয়ায় দুই পুলিশ অফিসার 'অভিযুক্ত' হলেও, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে না কোনো অবস্থাতেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন যে প্রশ্নটি জরুরি তা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশের সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে একটা আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকগুলো ইস্যুতে (রাষ্ট্রধর্ম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, মৌলিক কাঠামো) খোদ মহাজোটের শরিকদের মাঝেও বিভক্তি রয়েছে। মহাজোটের শরিকরা (ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ) পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও, প্রকারন্তরে তারা তাদের দ্বিমতের কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন সেমিনারে। এদিকে ড. কামাল হোসেন বলেছেন সংবিধানে ১৬তম সংশোধনী আনার। সব মিলিয়ে সমঝোতা কীভাবে সম্ভব, তা এক বড় প্রশ্ন এখন। সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হবার পরও সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিরোধী দলের উচিত সরকারের এই বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করা। এতে করে অন্তত সংসদে একটি রেকর্ড থাকলো। সরাকর যদি তাদের প্রস্তাব নাও মানে, বিরোধী দলের প্রস্তাবাবলি বিবেচনায় নিয়ে একটি আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। যেহেতু সংসদ কার্যকর, সেহেতু সংসদে এসে প্রস্তাব দেয়ার মধ্য দিয়ে সংসদীয় রাজনীতির ধারাকে আমরা আরো শক্তিশালী করতে পারি।
যে জনপ্রিয়তা নিয়ে সরাকর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, সেই জনপ্রিয়তা অনেকটাই মস্নান হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর তাৎপর্য যতটা না বেশি, তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা। বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতন তারা বোঝেন না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লো কী কমলো, এতে তাদের কিছু যায় আসে না। টাকার মান কমে গেলে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে, এটাও তারা বোঝেন না। তারা চান জিনিসের দাম কম থাকুক। চালের দাম কমে যাক। কমুক তেলের দাম। সরকার যদি এদিকে দৃষ্টি দিত, বোধকরি এটা সরকারের জন্য ভাল হতো। মানুষের তো সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা এ দিকে দৃষ্টি দেন কি না জানি না। দেশে কত সংখ্যক লোক দরিদ্রতার নিচে বসবাস করে, এর একটা পরিসংখ্যান আছে। এর জন্য কিছু লোকও রয়েছেন, যারা এসব পরিসংখ্যান তৈরি করে দেন। কিন্তু কেউ কী জানেন 'ছদ্মবেশী দরিদ্রের' সংখ্যা বাংলাদেশে কত? মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ দরিদ্রতার নিচে চলে গেছে। সীমিত আয়ে তাদের আর সংসার চলে না, চালানো যায় না। এদের নিয়ে কেউ ভাবে না।
শুধু নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রে শেখায় সহনশীলতা। গণতন্ত্রে শেখায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার কথা। একদলীয় সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের স্পিরিটের পরিপন্থী। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে আমরা গণতন্ত্রের সুফলকে সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে পারিনি। উচ্চ আদালত যে মন্তব্যটি করেছে, তা যদি আমরা বিবেচনায় নেই, তাহলে তা আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল।
উচ্চ আদালতের দুটো সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সিদ্ধান্তে যেমনি সরকার ও বিরোধী পক্ষকে বলা হয়েছে একটি সমঝোতায় যেতে, তেমনি অপর একটি বেঞ্চের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে পুলিশ যাই করুক, তা উচ্চ আদালতের দৃষ্টি এড়ায় না। এতে করে সরকার বা পুলিশের কতটুকু টনক নড়বে বলতে পারবো না, তবে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ একটা আস্থা খুঁজে পেয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। কাদেরের ঘটনায় ইতিমধ্যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। আদালতের রায় অনুযায়ী একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। আমরা দেখতে চাই তদন্ত কমিটি দোষীদের দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি দিক। উচ্চ আদালতের এই রায়টি একটি 'ম্যাসেজ' পেঁৗছে দিল সবার কাছে_ আর তা হচ্ছে যিনি যত শক্তিশালীই হোন না কেন, অন্যায় করলে তার শাস্তি পেতে হয়ই।
দৈনিক ডেসটিনি. বুধবার৩ আগস্ট ২০১১, ১৯ শ্রাবণ ১৪১৮
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গত ২৯ জুলাইর একটি খবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের পুলিশি নির্যাতনের খবর যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ও তা হাইকোর্টের নজরে আসে, তখন হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে সকালে (২৮ জুলাই) একটি রুল জারি করেছিল। আর বিকালে শুনানি শেষে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত। আট সপ্তাহের মধ্যে বিভাগীয় তদন্তেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের একটি আদেশে আমরা আশার আলো দেখতে পাই। আদালত যে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে পারে, এটা একটা বড় প্রমাণ। নিরীহ ছাত্র কাদেরকে পুলিশ ডাকাত বানিয়েছিল। যে ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগে পড়ে পাস করে বেরুনোর পরপরই যার ভালো চাকরি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে পুলিশ তাকে ডাকাত বানিয়ে ফেললো। আজ মাননীয় বিচারপতিরা যদি হস্তক্ষেপ না করতেন, তাহলে কাদেরকে হয়তো জেলের ঘানি টানতে হতো। একজন মেধাবী ছাত্র কাদের হয়তো শেষ পর্যন্ত ডাকাত (?) হিসেবেই পরিচিত হতো। এর চেয়ে আর দুঃখজনক তো কিছু হতে পারে না।
সাম্প্রতিককালে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আমিনবাজারে ৬ ছাত্রের হত্যাকা- ও সেখানে মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে পুলিশের ব্যর্থতা কিংবা আরো আগে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে নানা কথা। এর একটি ঘটনায়ও পুলিশের ভূমিকাকে সমর্থন করেননি কেউ। আজ যখন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে হাইকোর্ট প্রশ্ন তোলে, তখন একটা আস্থার জায়গা আমরা দেখতে পাই। এর আগে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ ১২ জুলাই সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, 'দয়া করে জাতিকে উদ্ধার করুন। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে জাতি উদ্বিগ্ন। এই সংকটপূর্ণ অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়।' বিচারপতিদের ওই মন্তব্যই বলে দেয় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন। অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়। ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ১১৮ দশমিক ৩৬ ভাগ ও ১৪৬ দশমিক ১৫ ভাগ। ২০১০-২০১১ অর্থবছরের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘর অতিক্রম করে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সার ও ডিজেলের দামও বাড়ান হয়েছে। ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ায় এমডিজি'র বাস্তবায়ন (২০১৫ সালের মধ্যে) এখন প্রশ্নের মুখে। রেমিটেন্স আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-২০১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। বিদেশে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার দিনে দিনই সংকুচিত হয়ে আসছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়েও সমস্যা রয়ে গেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী (৫ জুলাই) ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখনো সেই পরিমাণ বিদ্যুৎই উৎপাদন হচ্ছে। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না। এর মাঝে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। পুলিশের পিটুনিতে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য এখন নিউইয়র্কে। জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে পুলিশের কী লাভ হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু এতে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পুলিশি অত্যাচারের ওই ছবি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র বিশ্বে, যা পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশের এই 'অতি বাড়াবাড়ি'র সমালোচনা না করে সমর্থন করেছিলেন। অতীতেও পুলিশ প্রায় একই ধরনের 'কা-' করেছে। পুলিশের জন্য একটি 'কোড অফ কনডাকট' প্রণয়ন করা বোধ হয় জরুরি হয়ে পড়েছে। মিডিয়ায় দুই পুলিশ অফিসার 'অভিযুক্ত' হলেও, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে না কোনো অবস্থাতেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন যে প্রশ্নটি জরুরি তা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশের সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে একটা আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকগুলো ইস্যুতে (রাষ্ট্রধর্ম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, মৌলিক কাঠামো) খোদ মহাজোটের শরিকদের মাঝেও বিভক্তি রয়েছে। মহাজোটের শরিকরা (ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ) পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও, প্রকারন্তরে তারা তাদের দ্বিমতের কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন সেমিনারে। এদিকে ড. কামাল হোসেন বলেছেন সংবিধানে ১৬তম সংশোধনী আনার। সব মিলিয়ে সমঝোতা কীভাবে সম্ভব, তা এক বড় প্রশ্ন এখন। সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হবার পরও সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে_ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিরোধী দলের উচিত সরকারের এই বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করা। এতে করে অন্তত সংসদে একটি রেকর্ড থাকলো। সরাকর যদি তাদের প্রস্তাব নাও মানে, বিরোধী দলের প্রস্তাবাবলি বিবেচনায় নিয়ে একটি আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। যেহেতু সংসদ কার্যকর, সেহেতু সংসদে এসে প্রস্তাব দেয়ার মধ্য দিয়ে সংসদীয় রাজনীতির ধারাকে আমরা আরো শক্তিশালী করতে পারি।
যে জনপ্রিয়তা নিয়ে সরাকর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, সেই জনপ্রিয়তা অনেকটাই মস্নান হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর তাৎপর্য যতটা না বেশি, তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা। বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতন তারা বোঝেন না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লো কী কমলো, এতে তাদের কিছু যায় আসে না। টাকার মান কমে গেলে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে, এটাও তারা বোঝেন না। তারা চান জিনিসের দাম কম থাকুক। চালের দাম কমে যাক। কমুক তেলের দাম। সরকার যদি এদিকে দৃষ্টি দিত, বোধকরি এটা সরকারের জন্য ভাল হতো। মানুষের তো সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সরকারের নীতি নির্ধারকরা এ দিকে দৃষ্টি দেন কি না জানি না। দেশে কত সংখ্যক লোক দরিদ্রতার নিচে বসবাস করে, এর একটা পরিসংখ্যান আছে। এর জন্য কিছু লোকও রয়েছেন, যারা এসব পরিসংখ্যান তৈরি করে দেন। কিন্তু কেউ কী জানেন 'ছদ্মবেশী দরিদ্রের' সংখ্যা বাংলাদেশে কত? মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ দরিদ্রতার নিচে চলে গেছে। সীমিত আয়ে তাদের আর সংসার চলে না, চালানো যায় না। এদের নিয়ে কেউ ভাবে না।
শুধু নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রে শেখায় সহনশীলতা। গণতন্ত্রে শেখায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার কথা। একদলীয় সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের স্পিরিটের পরিপন্থী। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে আমরা গণতন্ত্রের সুফলকে সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে পারিনি। উচ্চ আদালত যে মন্তব্যটি করেছে, তা যদি আমরা বিবেচনায় নেই, তাহলে তা আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল।
উচ্চ আদালতের দুটো সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সিদ্ধান্তে যেমনি সরকার ও বিরোধী পক্ষকে বলা হয়েছে একটি সমঝোতায় যেতে, তেমনি অপর একটি বেঞ্চের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে পুলিশ যাই করুক, তা উচ্চ আদালতের দৃষ্টি এড়ায় না। এতে করে সরকার বা পুলিশের কতটুকু টনক নড়বে বলতে পারবো না, তবে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ একটা আস্থা খুঁজে পেয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। কাদেরের ঘটনায় ইতিমধ্যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। আদালতের রায় অনুযায়ী একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। আমরা দেখতে চাই তদন্ত কমিটি দোষীদের দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি দিক। উচ্চ আদালতের এই রায়টি একটি 'ম্যাসেজ' পেঁৗছে দিল সবার কাছে_ আর তা হচ্ছে যিনি যত শক্তিশালীই হোন না কেন, অন্যায় করলে তার শাস্তি পেতে হয়ই।
দৈনিক ডেসটিনি. বুধবার৩ আগস্ট ২০১১, ১৯ শ্রাবণ ১৪১৮
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment