ঈদের পর পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এটা আরেকটা ‘যুদ্ধ’। এ ‘যুদ্ধে’ কেউ জেতে, কেউবা আবার হেরে যায়। দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। কিন্তু একটা নীতিমালা থাকা দরকার, আমাদের দেশে কত এবং কোন কোন শাখায় গ্রাজুয়েট দরকার। সেই নীতিমালাটি নেই। যারা উচ্চশিক্ষার সাথে জড়িত, তারা এটা বোঝেন বলেও মনে হয় না। ইউজিসির নাম পরিবর্তন করে উচ্চতর শিক্ষা কমিশন হচ্ছে। কিন্তু তাদেরও কোন ‘ভিশন’ নেই। লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পাস করছে। তাদের অনেকেরই লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, তা যদি উর্দু ভাষাতে হয়, তাহলে তাও। উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। তারপর এক সময় ‘একখানা সার্টিফিকেট’ নিয়ে চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ান। এবং প্রায় ক্ষেত্রেই চাকরি না পেয়ে বেকার থাকা! এই সমাজ উর্দু বা সংস্কৃতি পাস ক’জন ছাত্রকে চাকরি দেবে? যারা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন, তারাও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন বলে মনে হয় না।
এবার দশটি বোর্ডের মোট পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। পাসের হার এবার ৭৫ দশমিক শূন্য আট। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৯ হাজার ৭৬৯ জন ছাত্র-ছাত্রী, যা গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার ৭৬৫ জন বেশি। আর সব মিলিয়ে বিভিন্ন গ্রেডে পাস করেছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৬১ জন। এরা কোথায় যাবে? কোথায় পড়বে? এদের একটা বড় অংশের ঠাঁই হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা আস্থার জায়গা এখনও আমাদের জন্য তৈরী করতে পারেনি। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধুমাত্র সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে। মাননীয় রাষ্ট্রপতি, এমনকি শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে কথা বলছেন। মাননীয় রাষ্ট্রপতি শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে যখন বলেন, তখন আমরা আমজনতা তার বক্তব্য শুনে উত্ফুল্লিত হচ্ছি। কিন্তু তিনি কী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাণিজ্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন? কেন এখনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠন করা হল না, যারা শিক্ষার মান নির্ধারণ করবে? নামসর্বস্ব একটি সার্টিফিকেট, শিক্ষার মানোন্নয়নের কোন পরিচয় হতে পারে না। আমরা আশংকা করছি এইচএসসি পাস করা অনেক তরুণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আদৌ কোন সুযোগ না পেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। এবং একসময় নামসর্বস্ব একখানা সার্টিফিকেটের অধিকারী সে হবে! ওই সার্টিফিকেট দেখিয়ে সে চাকরি পাবে, এই নিশ্চয়তা সমাজ তাকে দেবে না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও ভালো ভালো শিক্ষক রয়েছেন। অনেকেই শুধুমাত্র ‘টাকার জন্য’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করেন। তরুণ শিক্ষার্থীরা যাতে করে নামসর্বস্ব সার্টিফিকেটের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে ঝুঁকে না পড়ে, সে জন্য নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নেয়া যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘দ্বিতীয় শিফট’ চালু করা যায়। এ ক্ষেত্রে ‘দ্বিতীয় শিফট’-এ যারা পড়বে, তারা অতিরিক্ত ভর্তি ফি দিয়ে পড়বে। বিভাগের শিক্ষকদের এ জন্য অতিরিক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে একদিকে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে নিরুত্সাহিত হবেন, অন্যদিকে ব্যাপক সংখক ছাত্র-ছাত্রীকে আমরা ‘দ্বিতীয় শিফট’-এর ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পারবো। ‘দ্বিতীয় শিফট’-এর জন্য ইউজিসি একটি নীতিমালা তৈরী করবে এবং প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তা অনুসরণ করবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ চালু করা সম্ভব। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাস’ বিভাগের অন্যত্র চালু করা সম্ভব। একজন প্রো-ভিসির পরিচালনায় তা চালু হতে পারে। মূল ক্যাম্পাসের শিক্ষকরাই সেখানে নিয়মিতভাবে ক্লাস নিতে পারেন। প্রয়োজনে কিছু তরুণ শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভেঙ্গে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭টি পুরনো কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চালু করা যেতে পারে। কোন কোন কলেজে ভালো শিক্ষক আছেন। এদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো সম্ভব। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে রয়েছে, তা শুধু সার্টিফিকেট সর্বস্ব একটি তরুণ প্রজন্মের জন্ম দিচ্ছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপে নতুন ক্যাম্পাস, ‘দ্বিতীয় শিফট’ চালুর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের মেধা আছে। এরা প্রতিভাবান। উচ্চশিক্ষা এদের অধিকার। এদের মেধাকে ব্যবহার করার স্বার্থেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা চাই না যে জিপিএ-৫ পেয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছিল, তার ওই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাক। উচ্চশিক্ষা তাদের অধিকার। আমাদের সংবিধান এই অধিকার তাদেরকে দিয়েছে। এই অধিকার থেকে আমরা তাদেরকে বঞ্চিত করতে পারি না। তাদের সবার আগ্রহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা মেডিকেল কলেজগুলোর দিকে। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে এর সংখ্যা প্রায় ৩৫টি। মেডিকেল কলেজের সংখ্যাও বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে সরকার আরো ৩টি মেডিকেল কলেজ চালু করবে। এখন যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এতে করে শিক্ষার মানোন্নয়ন হয়েছে কতটুকু? নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। কিন্তু পড়াচ্ছেন কারা? আমি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি, যেখানে কোন ‘অধ্যাপক’ নেই। এমনকি সহযোগী অধ্যাপকও ছিল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন কোন বিভাগে যদি আদৌ অধ্যাপক না থাকেন, যদি সহযোগী অধ্যাপকও না থাকেন, তাহলে ওই বিভাগের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই। অভিযোগ আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক-এর পদ বিজ্ঞাপিত হলেও, যোগ্য আবেদনকারী খুঁজে পাওয়া যায় না। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি হয়েছে। সেখানকার রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে কোন অধ্যাপক নেই। দু’দিন আগে পর্যন্ত সেখানে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত ছিল না (এখন অবিশ্যি পদোন্নতির মাধ্যমে দু’জন সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন)। নতুন লোক প্রশাসন বিভাগ চালু করা হয়েছে। সেখানে অতিসম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে একজন সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। অধ্যাপক নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আমার বিভাগের কথা বলতে পারি। আমার বিভাগে ৯ জন প্রভাষক কর্মরত। ৯ জন প্রভাষককে দিয়ে বিভাগের শিক্ষার মান কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব, আমি জানি না। উপাচার্য মহোদয় কী বিষয়টি বোঝেন? আমার দুঃখবোধটা এখানেই। এ জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে মঞ্জুরী কমিশনকে তখন নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে-যেখানে সিনিয়র শিক্ষকরা কোন এক্সচেঞ্জ প্রোগ ামের আওতায় নির্দিষ্ট কিছু সময় নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠদান করবেন। এতে করে তাদের সিনিয়রিটি ক্ষুণ্ন হবে না, বরং তারা বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবেন। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর) কোন কোন বিভাগে প্রচুর ‘অধ্যাপক’ রয়েছেন। তাদের কাউকে কাউকে ‘ট্রান্সফার’ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে সাধারণত কোন শিক্ষককে ‘ট্রান্সফার’ করা যায় না। কিন্তু আইন যদি করা যায় এবং যদি কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা যায়, আমার বিশ্বাস অনেকে উত্সাহিত হবেন (আমি নিজে রাজী আছি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করাতে)। এই আইনটি করা জরুরি। নচেত্ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হবে। ইতোমধ্যে বৈষম্য যে তৈরি হয়নি, তা বলা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট আর পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট-বৈষম্য তো রয়েছেই। এই বৈষম্য রোধ করার উদ্যোগ নিতে হবে মঞ্জুরী কমিশনকেই। একই সাথে শিক্ষক প্রশিক্ষণটাও জরুরি। তরুণ শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণটা খুবই জরুরি। একটি কাঠামোর আওতায় এই কাজটি করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। সেই সাথে তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠানোটাও দরকার। বিশ্ব ব্যাংকের সাথে বিষয়টি নিয়ে মঞ্জুরী কমিশন কথাবার্তা বলতে পারে। মেডিকেল শিক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাটাও জরুরি। শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজ চালু করলেই শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাবে না। মেডিকেল শিক্ষায় অধ্যাপকরা ঢাকার বাইরে যেতে চান না। রাজনৈতিক বিবেচনায় আবার কারো কারো মেধা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এখানেও আইনের প্রয়োগটা শক্তিশালী হওয়া উচিত।
দিনে দিনে এইচএসসি পাস করা মেধাবি ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। ওদের অনেক স্বপ্ন। অনেক আকাঙ্ক্ষা। এই স্বপ্নগুলোর যেন মৃত্যু না হয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক সদস্য।
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment