রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সুড়ঙ্গের মাথায় আলো দেখতে চাই

এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সরকার আর বিরোধী দলকে সংলাপের ব্যাপারে কোনো চিঠি দিচ্ছে না। বহুল আলোচিত তারানকোর ঢাকা সফর একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও সেই সম্ভাবনা এখন রহিত হয়ে গেল। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সরকার বিরোধী দলকে কোনো চিঠি দেবে না। তাদের অভিমত বিএনপি সংসদে এসে যদি কোনো ‘প্রস্তাব’ দেয়, তাহলে সংসদেই আলোচনা হতে পারে। বিএনপি সংসদে যাবে, কিন্তু কোনো ‘প্রস্তাব’ দেবে, এটা আমার কাছে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা সংলাপ বা আলোচনার বিষয়বস্তু তো একটাই নির্বাচনকালীন সরকার। আর এ প্রশ্নে সরকারের বক্তব্য একেবারে স্পষ্ট নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে, সেই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। আর সেই নির্বাচন সরকারের ৫ বছরের টার্ম (জানুয়ারি ২০১৪) শেষ হওয়ার তিন মাসে আগেই সম্পন্ন হবে। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ওই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ থাকতে পারে এই হচ্ছে সরকারের অবস্থান। অর্থাৎ শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যাবেন নতুন সরকার গঠন করার আগ পর্যন্ত। ওই সরকারে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের (বোধকরি সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী) ‘মন্ত্রীরা’ থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে জামায়াত থাকবে কি থাকবে না, এটা প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেননি। জামায়াতের থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা জামায়াত থাকলে ১৪ দলের পক্ষ থেকে কোনো দলই থাকবে না। সুতরাং শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিএনপির যোগদানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আরো মজার কাহিনী হচ্ছে তথাকথিত চিঠি লেখার বিষয়টি সৈয়দ আশরাফকে ‘কোট’ করে পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসভাজন বনমন্ত্রী ড. মাহমুদ হাসান গত ১৮ মে বিবিসির সংলাপে জানিয়ে দিয়েছেন চিঠি লেখার বিষয়টি কখনো পার্টির কোনো ফোরামে আলোচিত হয়নি। এখন স্পষ্টতই সরকার বড় ধরনের একটি ঝুঁকি নিয়েছে। একের পর এক মামলা দিয়ে, জেলগেটে জামিন পাওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের পুনরায় গ্রেফতার করে, ঢাকা জনসভা, মানববন্ধনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার যদি বিএনপির ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগের স্ট্রাটেজি গ্রহণ করে থাকে, তাতে কোনো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না; বরং সংঘাতের পরিধি আরো বাড়বে। বিএনপি তথা ১৮ দল কঠোর অবস্থানে যেতে পারে। আবারো আমরা লাগাতার হরতাল আর অবরোধের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি। তবে আশার কথা হলো, আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে বিএনপি সংলাপের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলেন, প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। তিনি মিথ্যা বলেননি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হয়। জার্মানি বা ব্রিটেন কিংবা ভারতের দৃষ্টান্ত আমাদের এ কথাই বলে। কিন্তু ওইসব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে কী আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি মেলানো যাবে? আমাদের দেশে যেভাবে ভোট কারচুপি হয়, ব্রিটেন বা জার্মানিতে কী এটা সম্ভব? এই দক্ষিণ এশিয়াতেই পাকিস্তান একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচন সম্পন্ন করল। নেপালে জুন মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বুলগেরিয়াতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হতে যাচ্ছে জুনে। সুতরাং ব্যতিক্রম আছে, আমাদের এ অঞ্চলেই আছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে থেকে যান, তাতে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হয়ে যেতে পারে। গেল চার বছরে প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে ‘দলীয় আনুগত্য’ প্রদর্শন করেছেন, তাতে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্র্যাডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরো একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই (৩ মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ কী নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের রেখেই নির্বাচন হবে? এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ এর ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। রাজনীতির ব্যাপারে আবারো বলতে হচ্ছে, বর্তমান যে বাস্তবতা তাতে সব সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল। জাতিসংঘের মহাসচিব একটি চিঠি দিয়ে দু’দলকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার চিঠির সূত্রে ধরেই তারানকো বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে।
এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলে শুধু বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে সেই সংসদ ৫ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেয়ায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশ পুনরায় একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে কি-না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে সরকারের দায়-দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি ‘গো’ ধরে থাকে, তাতে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তোফায়েল আহমদের মতো সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও মনে করছেন আদৌ সংলাপ হবে না। কেননা কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। সরকারের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে না তারা সংলাপের ব্যাপারে সত্যি সত্যিই আন্তরিক। একদিকে সংলাপের কথা বলে জনগণ তথা বিদেশি দাতাদের দেখাবে যে, তারা সংলাপ করতে চান। অন্যদিকে বিরোধী মিডিয়া বন্ধ করে দিয়ে সরকার ধীরে ধীরে দেশটিকে একদলীয় রাজনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বারবার বলে আসছি গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। যাকে আমরা রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষায় বলি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ (সিবিএম)। এই সিবিএমের বড় অভাব দেশটিতে। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দু’দলের মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্কের কথা বললেও বিষয়টি সরকারি দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে আদৌ কখনো বড় হয়ে দেখা দেয়নি। যে ভাষায় নেতা-নেত্রীরা বিরোধী দলের নেতাদের আক্রমণ করেন তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। সম্প্রতি পাকিস্তানে একটা সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানেও দুটি বড় দল, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ও পিপলস পার্টির (বিলওয়াল ভুট্টো) মধ্যে দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি। কিন্তু খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি তারা কখনো নগ্ন ও অশ্লীল ভাষায় অপর পক্ষকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখেননি। পাকিস্তানের অনেক বিষয় আমাদের অপছন্দের। তালেবানের হুমকির মুখে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ আজ হুমকির মুখে। তারপরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান প্রমাণ করেছে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আস্থাশীল, যারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে তাতে আমাদের মধ্যে নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। শাপলা চত্বরে হতাহতের ঘটনা নিয়েও বিদেশে যেসব প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তাতে সুসংবাদ কিছু ছিল না। এখন এমন একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি ‘গৃহযুদ্ধের’ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ৫ মে মার্কিন কংগ্রেসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির অন্যতম সদস্য এবং কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের সদস্য কংগ্রেস উইম্যান ইভেট ডি ক্লার্ক বাংলাদেশি মার্কিনি বার্তা সংস্থা এনাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি যাতে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত না হয়, সে জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও কংগ্রেস একসঙ্গে কাজ করছে’ (মানবজমিন ৭ মে)। এ ধরনের বক্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। রানা প্লাজায় এগারোশ’ মানুষের মৃত্যুর পর আমাদের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত সবাই। বিদেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। স্বস্তায় পাওয়া তৈরি পোশাক যে মৃত্যুর কারণ এই মনোভাব এখন বিদেশে সাধারণ মানুষের মাঝে জন্ম হয়েছে। তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের ছবি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যে বিধি-নিষেধের আওতায় আসছে, তার পরিণতি হিসেবে পোশাক রফতানিতে মন্দাভাব আসতে পারে। এমনই এক পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতা যেখানে অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু সেই সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগামী দিনের বাংলাদেশকে নিয়ে তাই শঙ্কিত আমরা সবাই। জাতিসংঘের এক ধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ কিংবা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ কোনো কোনো মহল থেকে প্রশংসিত হলেও এটা একটা বাজে ‘সিগন্যাল’ পৌঁছে দিল। বিদেশিরা কেন আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে? এর মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা বিদেশিদের কাছে অত্যন্ত ‘ছোট’ হয়ে গেলেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে যে সম্মান অর্জন করেছিল, আজ খোদ নিজ দেশেই এই শান্তি হুমকির মুখে! সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হবে কি-না বলতে পারছি না। কিন্তু আলোর একটি ক্ষুদ্র রেখাও আমাদের নজরে আসছে না। আমাদের হতাশার জায়গাটাও বাড়ছে। তারপরও প্রত্যাশা করব, বিএনপির সংসদে ফেরা যেন ফলপ্রসূ হয়। বিএনপি সংসদে তাদের প্রস্তাব রাখুক। সংবিধানের আওতায় একটি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা বিএনপি উপস্থাপন করুক। রাজনীতিতে সুস্থধারা ফিরুক। আমরা আলো দেখতে চাই।
Daily MANOBKONTHO
26.05.13

0 comments:

Post a Comment