দেশের চলমান রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলামের উত্থান, শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের জেলে প্রেরণের ঘটনায় রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, ঠিক তখনই টিআইবি নির্বাচনকালীন সরকারের একটি ‘রূপরেখা’ উপস্থাপন করেছে। একসময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করলেও এখন তাদের আন্দোলন এক দফায় কেন্দ্রীভূত। তাদের দফা এখন একটিইÑ সরকারের পদত্যাগ। এর আগে প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সে ব্যাপারটি বেশিদূর এগোয়নি। কেননা প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রস্তাবে বিএনপি ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ফলে এ নিয়ে জনমনে কোন সাড়াও পড়েনি। রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির নেতা এইচএম এরশাদ বরাবরই সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। যদিও তিনি সেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোন সুনির্দিষ্ট রূপরেখা উপস্থাপন করেননি। তিনি এখনও মহাজোট সরকারে আছেন এবং বারবার বলে আসছেন ‘ঠিক সময়ই জাতীয় পার্টি মহাজোট ত্যাগ করবে।’ জাতীয় পার্টি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো গ্রহণ করেছে, এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান ছিল, তা পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হলে আবার সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমান সরকারই দশম সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী থেকে যাচ্ছেন ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। আর আপত্তিটা উঠেছে এ কারণেই।
দুই
বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। নেপালের মতো পাকিস্তানেও গঠিত হয়েছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যারা দু’দেশেই পরবর্তী নির্বাচন আয়োজন ও পরিচালনা করবেন। পাকিস্তানে গত ১৭ মার্চ প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচিত সরকার তার টার্ম শেষ করল। এরপর বিচারপতি মির হাজার খান খোসো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তারপরও কথা থেকে যায়। সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানিকে ঘিরে বারবার সংবাদ হয়েছে। তার চাকরির মেয়াদ বেড়েছে। ক্ষমতা নেয়ার ব্যাপারে তার অনাগ্রহের কথা তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। এখন দেখার বিষয় পাকিস্তানের রাজনীতিকরা কতটুকু দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ১১ মে সেখানে সাধারণ নির্বাচন।
নেপালে গঠিত হয়েছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২১ জুন সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে ১৪ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন নেপাল সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি খিল রাজ রেগমি। গত প্রায় ১০ মাস ধরে সেখানে রাজনীতিতে অচলাবস্থা চলে আসছিল। নেপালে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছিল। মূলত চারটি প্রধান দলের পক্ষ থেকেই গত ১০ মাসে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু পার্লামেন্টের সমর্থন না পাওয়ায় কেউই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি। গত মে মাসে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু ওই সময়ে নেপালের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধান চারটি দল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে নীতিগতভাবে একমত হয় এবং বিচারপতি রেগমিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করেন। রেগমি এরই মধ্যে শপথও নিয়েছেন। তার প্রধান ও একমাত্র কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা। সেখানে মূল সমস্যা ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিল না। এমনকি মাওবাদীদের মাঝেও দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছিল। যারা বিশ্ব রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন সম্প্রতি ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ায় সরকার ভেঙে দেয়া হয়েছে। বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোজেন প্লেভনেলিয়েভ সাবেক কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। রায়কভ মে মাস পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন এবং মে মাসে তিনি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবেন। অনেকের মনে থাকার কথা, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রিসে পাপেন্দ্র“ সরকারের পতন ঘটেছিল। পরে সেখানে একজন বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং তিনি এরই মধ্যে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেমানান। কিন্তু কখনও সখনও রাষ্ট্রকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। গ্রিস, যেখানে একসময় গণতন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেখানেও পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা গ্রহণ করতে। ২০০৭ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছিল, অথচ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোন পদ ছিল না। বৃহত্তর ঐক্য ও সংকট এড়াতে সরকারকে সংবিধানবহির্ভূত অনেক সিদ্ধান্তই নিতে হয়। এসব ঘটনা থেকে আমরা কী শিখছি? বাংলাদেশে আন্দোলনের ফল ছিল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেটা ১৯৯৩-এর পরবর্তী সময়ের কথা। জামায়াতও সেদিন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ কর্তৃক বয়কটের পর ১৩ দিনের ওই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। পরে ৭ম (১৯৯৬), ৮ম (২০০১) ও ৯ম (২০০৮) সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়। এরপর সংবিধানে সংশোধনী এনে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের রায় একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দশম সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে? সরকার সংবিধান অনুসরণ করবেÑ এটাই স্বাভাবিক। আর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কোন সুযোগ নেই। তবে এটাও সত্য, সব দলের বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা না হোক, একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
তিন
এখন টিআইবি একটি ‘ফর্মুলা’ নিয়ে এলো। টিআইবি বলছে, এটা নির্বাচনের সময়ের জন্য একটি ‘রূপরেখা’। তাদের ‘রূপরেখা’র মোদ্দা কথা অনেকটা এরকম : ১. নির্বাচিত দুই দলের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি গঠিত হবে (পাকিস্তানে এরকমটি ছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছিল)। সরকারপ্রধানসহ সরকারে সদস্য হবেন মোট ১১ জন; ২. এই ১১ জন সদস্য দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না এবং পরবর্তীকালে সরকারের কোন লাভজনক পদে যোগ দিতে পারবেন না; ৩. নিজেরা আলোচনা করে সরকারপ্রধান ঠিক করবেন। তবে ঐকমত্য না হলে অনধিক তিন ব্যক্তির নাম স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে একজনকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করবেন; ৪. ৯০ দিনের মধ্যে তারা নির্বাচন সম্পন্ন করবেন।
টিআইবি যে কথাগুলো বলেছে, তাতে নতুনত্ব কিছু নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে এর আগেও বিভিন্ন লেখায় এ ধরনের একাধিক প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তবে টিআইবি ‘নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা’ নিয়ে সিরিয়াসলি গবেষণা করেছে কি-না, আমার সন্দেহ রয়েছে। কোন কোন দেশে (গ্রিস, বুলগেরিয়া, নেপাল) যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তা তারা কতটুকু বিবেচনায় নিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। নির্বাচনকালীন সেনা মোতায়েন, বিশেষ করে নির্বাচনের দিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান আরপিওতে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি নেই। উপরন্তু জাতীয় পার্টি একটি বড় শক্তি। ২৬টি আসনসহ তাদের প্রাপ্ত ভোট ৭ দশমিক ০৫ ভাগ। জামায়াতের আসন কম (২), প্রাপ্ত ভোট ৪ দশমিক ৬০। জাসদ (৩), ওয়ার্কার্স পার্টি (২), বিজেপি (১) ও এলডিপির (১) আসনও সংসদে রয়েছে। সুতরাং প্রশ্ন উঠতেই পারে, শুধু নির্বাচিত দুটি বড় দলের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ‘সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি’ কেন? বাকি দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নয় কেন? যে ১০ জন মন্ত্রী নিয়োগ করা হবে, তারা কি নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত? যদি নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তারা কি নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন? সবচেয়ে বড় কথা, ‘তিনজন ব্যক্তির একটি তালিকা’ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি কিন্তু দলীয়ভাবেই নির্বাচিত হবেন আগামী ২৯ এপ্রিল। যদিও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তার দলীয় আনুগত্য ত্যাগ করবেন, কিন্তু তারপরও আপত্তির একটা সুযোগ তৈরি হল (পাকিস্তানে কিন্তু এ তালিকা দলীয়ভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়নি। পাঠানো হয়েছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে)। টিআইবির রূপরেখায় সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও এ প্রস্তাব আলোচনার একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
চার
আসল কথা হচ্ছে, এমন একটি নিরপেক্ষ সরকার আমরা চাই, যে সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে। বিদেশী দাতা এবং জনগণের বড় অংশ একটি নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। প্রথম সারির তিনটি জাতীয় দৈনিকে কিছুদিন আগে প্রকাশিত জনমত জরিপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে রায় পড়েছিল বেশি। কিন্তু সরকার এদিকে দৃষ্টি দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাদের কোন আগ্রহও নেই। সরকার এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ও দেশকে এক কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণের পথ একটাই আর তা হচ্ছে, একটি তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকার গঠনের লক্ষ্যে ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। সরকার যত দেরি করবে, ততই দেশ ও জাতির জন্য তা অমঙ্গল বয়ে আনবে। এত সংকট, বিভেদ আর বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান আর নেপাল যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে আমরা তা পারব না কেন? আসলে যা দরকার, তা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের শুভবুদ্ধির উদয়। শুভবুদ্ধির উদয় না হলে সংকট আরও বাড়বে। জোর করে ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যে কোন কৃতিত্ব থাকতে পারে না। জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। আজ একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে যদি নির্বাচন হয় আর সেই নির্বাচন যদি মহাজোট সরকারকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসে(?) তাহলে কারও কিছু বলার নেই। দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সে কথাই বলছেন। মহাজোট সরকারের গত পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ড বিচার-বিশ্লেষণ করার অধিকার দেয়া হোক জনগণকে। তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু তা না করে এককভাবে একটি নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা কারও কাছেই থাকবে না। ১৮ দলীয় জোটকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর দায়িত্বটি সরকারের। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোন বিকল্প নেই। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারই পারে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে।
Daily JUGANTOR
18.04.13
0 comments:
Post a Comment