রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে

ভারতের প্রধানমর বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের প্রাপ্তি যেখানে প্রায় ‘শূন্যের’ কোঠায়, সেখানে ভারত পরোক্ষভাবে ট্রানজিটের বিষয়টি আদায় করে নিয়েছে। যদিও যৌথ ইশতেহারে তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনের দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। যারা ভারতের দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন, তারা জানেন ইশতেহারে যে ‘আশাবাদ’ ব্যক্ত করা হয়েছে, তা মূলত একটি ‘কূটনৈতিক ভাষা’। অতীতেও ভারত এ ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে একটা সমস্যা থেকেই গেল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে সমঝোতাটি এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। আগামীতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর মমতা বাংলাদেশকে যদি কিছুটা ‘ছাড়’ দেন, তা বাংলাদেশের জন্য হবে বড় পাওয়া। তবে মমতা পশ্চিমবঙ্গের জন্য আরও পানি চান। তাই তিনি ‘ছাড়’ দেবেন, এতে বিশ্বাস রাখতে পারছি না। কেননা পানিবণ্টনের প্রশ্নটির সঙ্গে তাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত। তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা খোদ ভারতেই বিরোধিতার মুখে পড়েছে। এখন দেখতে হবে এ সিদ্ধান্ত কীভাবে এবং কতটুকু কার্যকরী হয়। ছিটমহল বিনিময়ের যে কথা বলা হয়েছে, তা খোদ বাংলাদেশ ও ভারতেও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। আসামের অসম গণপরিষদ ও বিজেপি ছিটমহল বিনিময়ের বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। চুক্তিস্বাক্ষরের পরদিন আসাম ও মেঘালয়ে বড় ধরনের প্রতিবাদ হয়েছেÑ এ খবরটুকু আমাদের দিয়েছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা।
আমার বিবেচনায় উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। পরোক্ষভাবে এতে ট্রানজিটের কথা বলা হয়েছে। এ চুক্তিতে উপআঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বন্দর (চট্টগ্রাম ও মংলা) ব্যবহার করার কথা। এমনকি নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে অংশটুকু রয়েছে, তা বড় ধরনের আশংকার সৃষ্টি করেছে। এ অংশটুকুতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ দূর করার ব্যাপারে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। প্রয়োজনে ভূখণ্ড ব্যবহার করার সম্ভাবনাও এতে তৈরি হল। এ চুক্তিটি অদূর ভবিষ্যতে ভারত তার স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। চুক্তিতে যে ভাষা ও বক্তব্য রয়েছে, তার মাধ্যমে অতি কৌশলে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট আদায় করে নিল। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আমরা আমাদের দক্ষতা দেখাতে পারিনি। ভারতের দক্ষ আমলারা কৌশলে আমাদের কাছ থেকে ট্রানজিট আদায় করে নিল। যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাদের চেয়ে দু’জন উপদেষ্টার (ড. মসিউর রহমান ও ড. গওহর রিজভী) ব্যক্তিগত ও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা কাজ করেছে বেশি। কেননা তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা তারা বাস্তবায়ন করেছেন মাত্র।
এখন যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা আসলে কী? ভারত কী চায়? ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। যদিও জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ এখনও দরিদ্র সেখানে (২০১০)। ভারতের কোন কোন রাজ্যে দরিদ্র্যতা এত বেশি যে, প্রায়ই সেখানে কৃষকরা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আÍহত্যা করে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় তখন ৯৪০ ডলার (বর্তমান) থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ (বর্তমানে মাত্র ২ ভাগ)। এই যে ভারত, এ ভারত আমাদের উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতা নিয়ে (মমতাও এ থেকে বাদ যান না)। এ মানসিকতা বোঝানোর জন্য আমি রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশের সম্পর্কের বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। দেশ দুটো এখন স্বাধীন। বেলারুশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে আÍপ্রকাশ করে। রাশিয়ার যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে বেলারুশে। বেলারুশ রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরশীল। Druzhba ev Friendship পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া তেল সরবরাহ করে বেলারুশকে। বেলারুশ আবার এই তেলের একটি অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশে বিক্রি করে। এ তেল সরবরাহ নিয়ে ২০০৯ সালে দেশ দুটোর মধ্যে যে তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘ as War ’ হিসেবে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেংকো বরাবরই রাশিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে শংকিত। ইতিমধ্যে দেশ দুটো একটি ‘Customs Union’ গঠন করেছে এবং একটি ‘টহরড়হ ঝঃধঃব’ চুক্তিতেও দেশ দুটো স্বাক্ষর করেছে। রাশিয়ার নেতারা মনে করেন রাশিয়ার ন্যাচারাল অধিকার রয়েছে তার পাশের দেশ বেলারুশে। রাশিয়ার নেতারা এটাকে বলছেন ‘ Zone of Privileged Interst’। অর্থাৎ তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এলাকা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ এ তত্ত্বের প্রবক্তা। মূল কথা হচ্ছে, রাশিয়ার পাশের দেশ বেলারুশে রাশিয়ার স্বার্থ রয়েছে। বেলারুশকে এ ‘রাশিয়ার স্বার্থ’কে স্বীকার করে নিতে হবে। রাশিয়ার এটা স্বাভাবিক অধিকার।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ‘Zone of Privileged Interst’ এর ধারণাটি আমাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে বাংলাদেশে। ভারতের সঙ্গে স্বার্থ মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘সাত বোন’ রাজ্যের উন্নয়ন। ভারতের এ সাতটি রাজ্য (আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল) মূলত মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। সেখানে উন্নয়নও হচ্ছে না। দারিদ্র্য ও অশিক্ষার হারও বেশি। এখন ‘সাত বোন’ রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুবই জরুরি। গুজরাল ডকট্রিনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘সাত বোন’ রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গুজরাল (ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) লন্ডনের দি রয়াল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে বক্তৃতা দেয়ার সময় গুজরাল তার ওই মতবাদ তুলে ধরেছিলেন। ওই মতবাদে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা, চট্টগ্রাম পোর্ট ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। এটা ছিল মূলত ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’-এর সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত রূপ। ইন্ডিয়া ডকট্রিনের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে ভারতের স্বার্থ নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে তৃতীয় কোন দেশকে এ অঞ্চলের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা। এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভারতই ভূমিকা রাখবে, অন্য কোন দেশ নয়Ñ এটাই ইন্ডিয়া ডকট্রিনের মূল কথা।
‘গুজরাল ডকট্রিন’-এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘সাত বোন রাজ্যের’ উন্নয়নের কথা বলা হলেও ভারত ধীরে ধীরে এ মতবাদ নিয়ে এগিয়ে গেছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার বাংলাদেশ সফরের সময় (জানুয়ারি ১৯৯৭) নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়, ভারত ও বাংলাদেশ ৪টি দেশ নিয়ে (ভুটান ও নেপালকে সঙ্গে নিয়ে) একটি উপআঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলবে। এ উপআঞ্চলিক সহযোগিতাকে তখন বলা হয়েছিল উন্নয়নের চতুর্ভুজ বা ঝSouth Asian Growth Quadrangle (SAGQ)। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত চারদেশীয় পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে ঝঅছে গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, ঝঅছে-এ সারা ভারতবর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যকে। দীর্ঘদিন উন্নয়নের চতুর্ভুজ নিয়ে তেমন কিছু শোনা না গেলেও মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এ ধারণাটি আবার সামনে চলে এলো। যে সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে, তার মাঝে উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি বাদে বাকিগুলো আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর একটিতেও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। বাংলাদেশের স্বার্থ যেসব ক্ষেত্রে জড়িত ছিল (যেমনÑ তিস্তাসহ সব নদীর পানিবণ্টন চুক্তি, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত, ৪৬টি পণ্যের পরিবর্তে ৪৮০টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ইত্যাদি), সেসব ক্ষেত্রে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হল না। ফলে ভারত সম্পর্কে এ দেশের জনগণের এক অংশের যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তাতে আদৌ কোন পরিবর্তন আসবে না। ভারতের নেতৃবৃন্দের এ কর্তৃত্ববাদী আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। জাতিসংঘ সনদের ২নং এবং ৪.১ নং ধারায় যে সমতা ও সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে, এর আলোকেই আমরা ভারতের সঙ্গে স্থায়ী দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু ভারত যদি একতরফাভাবে ও নিজস্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাতে বিতর্কের মাত্রা বাড়বেই। ভারতের নেতৃবৃন্দের ‘মাইন্ড সেটআপ’-এ পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ‘ছোট’ দেশ হতে পারে, কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের দেশ এটি। বাংলাদেশও অনেক কিছু ভারতকে দিতে পারে। ট্রানজিট সুবিধা কেন সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু ভারত ও বাংলাদেশের জন্য? এটা উš§ুক্ত হোক। বহুপাক্ষিক যোগাযোগ ব্যবস্থার আলোকে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও ট্রানজিট চাই। মনমোহন সিংয়ের এ সফর প্রমাণ করে জাতীয় স্বার্থের বাইরে ভারত এক পাও এগোয় না। অথচ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে চাই না। পার্থক্যটি এখানেই।
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com 

0 comments:

Post a Comment