রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মমতার মন গলাতে মনমোহনের উদ্যোগ

১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য রাখার একটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু'দেশের মধ্যে বণ্টন করে ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভারত সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্টো তিস্তার কমান্ড এরিয়া তাদের বেশি, এরকম দাবি তুলে বাংলাদেশ তিস্তার পানির সমান ভাগ পেতে পারে না বলে যুক্তি দেখিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ভারত তিস্তা ব্যারেজের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দিয়েছিল এবং সর্বশেষ এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে হঠকারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল (নয়াদিগন্ত, ৬ মে ২০০৮)। এই যখন পরিস্থিতি তখন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছিলেন নদীর উপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগি হবে। এ কারণেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশের স্বার্থ এতে করে কতটুকু রক্ষিত হবে? 'নদীর উপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যা' কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ভারতের বর্তমান অবস্থানটা আমরা জানি না। শেষ পর্যন্ত কী মমতার দাবির কাছে নতি স্বীকার করে আমরা একটা সমঝোতা করতে যাচ্ছি? এতে করে কী বাংলাদেশের হিস্যা এখন কমে যাবে? ধারণা করছি চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমরা বিস্তারিত জানতে পারবো। কিন্তু ততদিনে তো করার কিছুই থাকবে না। আন্তর্জাতিকভাবে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর, হুট করে সেই চুক্তি বাতিল করা যায় না। এতে আন্তর্জাতিক আসরে একটি দেশের (এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ) ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষেই ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়। অতীতে বিএনপি সরকারও পারেনি। তারা চুক্তির সমালোচনা করেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার নিয়ে যে চুক্তি হবে আগামীতে তা নিয়েও কথা আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় আমরা এ ধরনের কথা শুনেছিলাম। আমরা রাজি হয়েছিলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে সুপেয় পানির জন্য একটি শোধনাগার নির্মাণ করতে ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারতকে প্রত্যাহার করে নেয়ার। কিন্তু এতে করে, অর্থাৎ ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের ফলে মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতাধীন চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার ইরি সেচ হুমকির মুখে থাকবে। ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে নদীর নিচু এলাকায় বাংলাদেশের নদী ও তীরবর্তী বিশাল অংশ শুকিয়ে যাবে। প্রত্যাহারকৃত পানি দিয়ে ভারত তার সেচ প্রকল্পগুলো শুরু করতে পারবে। এই বর্ষাকালেও ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরাতন মহাসড়কের শুভপুর ব্রিজ এলাকায় ফেনী নদীর প্রশস্ততা ১০০ মিটারের কমে নেমে এসেছে। শীতকালে পানি তলানিতে গিয়ে পেঁৗছবে। সৃষ্টি হবে বালুচরের।
মমতা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থেই চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মতি দিলেন না। মমতার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার পানির উপর নির্ভরশীল অঞ্চলে মমতার পক্ষে মিছিল হয়েছে। এতে করেই বোঝা যায় কেন মমতা চুক্তি স্বাক্ষরে তার সম্মতি দেননি। মমতা রাজনীতি করেন। বিধানসভা নির্বাচনে তিনি তাদের ভোট পেয়েছেন। সামনে উপনির্বাচন এবং পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার জন্য এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মমতার এই পিছুটান। এখন মমতাকে রাজি করাবে কে? আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জিকে ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও প্রটোকল অনুযায়ী একজন প্রধানমন্ত্রী একজন মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন না। তবে 'রাজনীতির স্বার্থে' অনেক সময় প্রটোকলের বাইরেও যেতে হয়। শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন। কেননা তিনি জানেন মমতকে তার প্রয়োজন রয়েছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানে মমতাকে প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশের। কেননা মমতা ভারতের কেন্দ্রীয় ইউপিএ সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখেন। মন্ত্রিসভায় জাতীয় কংগ্রেসের বাইরে সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, প্রয়োজনে তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে শেখ হাসিনা কলকাতা যেতেও রাজি। এটি কোন সরকারি সূত্র নয়। সংবাদটির সত্যতাও যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একজন দূতকে পাঠাতে পারেন কলকাতায়। আর ভারতের অভিজ্ঞতা বলে 'কোনো আমলাকে' দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কোনো উপদেষ্টা নয়, বরং 'একজন রাজনীতিবিদ'ই পারেন সমাধানের পথ খুঁজতে। আমরা মমতা ব্যানার্জিকেও বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাতে পারি। তাকে দেখাতে পারি পানির অভাবে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। আমার বিশ্বাস, মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করানো আমাদের জন্য কোনো কঠিন কাজ হবে না আগামীতে। 
ড. তারেক শামসুর রেহমান 
অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com


0 comments:

Post a Comment