রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর: কিছু প্রশ্ন

মনমোহন সিং ঢাকায় আসছেন। দিনক্ষণ একরকম ঠিক। ইতোমধ্যে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি বিশেষ টিম ঢাকা সফর করে গেছেন। সরকারের দুজন উপদেষ্টা নয়াদিলি্ল সফর করে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে যেসব চুক্তি হবে, তা একরকম চূড়ান্ত করে এসেছেন। তাদের এই সফর নিয়ে মিডিয়ায় কিছু কিছু গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে। ড. গওহর রিজভী পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তার নয়াদিলি্ল সফরের একটা যুক্তি থাকলেও অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের নয়াদিলি্ল সফরের যুক্তি কি? দেখা যাচ্ছে ড. মসিউর রহমান ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশকিছু চুক্তির ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বিশেষ করে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল মুখ্য। তিনি ট্রানজিট নিয়ে যে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, অনেকেই তার সমালোচনা করেছেন। এমনকি নয়াদিলি্ল সফরের পর তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারেও যে মন্তব্য করেছেন, তাও তাকে বিতর্কিত করেছে। তিনি বলেছেন, তিস্তা নদীর ওপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগি করা হবে। তার এই বক্তব্য স্পষ্ট নয় এবং অতীতে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশ যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, তার পরিপন্থী। এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ড. রহমান আশা করছেন এতে করে দুদেশ প্রায় সমান সমান পানি পাবে। এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে যেতে পারে। কেননা তিস্তার ওপর নির্ভরশীল জমি ও জনসংখ্যার হিসাব নিয়ে একটা ফাঁক থেকে যেতে পারে। ড. মসিউর রহমানের কাছে এ ধরনের তথ্য আছে কি না আমি জানি না। এ ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনায় বাংলাদেশের কী পরিমাণ জমি ও জনসংখ্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাও গোপন রাখা হয়েছে। তবে মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের সঙ্গে এই তিস্তার পানি চুক্তির একটা যোগ আছে। তিস্তার পানি বণ্টন পশ্চিমবঙ্গের বিগত বিধান সভার নির্বাচনের আগে একটা ইস্যু হয়ে গিয়েছিল। মমতা ব্যানার্জি তার একাধিক বক্তৃতায় (নির্বাচনের আগে) হুমকি দিয়েছিলেন তিস্তার পানি বণ্টনে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করার। এখন একটি চুক্তি হবে। কিন্তু চুক্তির বিস্তারিত আমরা জানতে পারবো কি না, এটা আমি নিশ্চিত নই। চুক্তি কোনো খারাপ কিছু নয়। চুক্তি হওয়াটা প্রয়োজন। তিস্তা কেন, দুদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটা ঐকমত্যে পেঁৗছানো দরকার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের স্বার্থ ঠিকমতো রক্ষিত হচ্ছে না। অভিযোগ আছে এবং পত্রপত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে গঙ্গার পানি চুক্তি (১৯৯৬) করেও আমরা চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছি না। ৩০ বছর মেয়াদি ওই চুক্তিটি হয়েছে বটে। কিন্তু যদি পানি নেই, তাহলে চুক্তি করে লাভ কী হবে? টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যখন আমরা সোচ্চার, তখন আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা গেল বছর টিপাইমুখ গিয়েছিলেন। হেলিকপ্টারে ঘুরলেন। জানালেন তারা কিছুই দেখতে পাননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কথা যখন পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে, তখন মিজোরামের মানুষ ওই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করছিল। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আমাদের বারবার আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। ভারতের উচ্চমহল থেকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু আমরা বা নেপাল ও ভুটান এখনো ট্রানজিট পায়নি। ভারত থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আমরা ভারতীয় হেভি ট্রাক চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করছি। ওই রাস্তা দিয়ে ভারতীয় হেভি ট্রাক যাচ্ছে কোন ধরনের শুল্ক না দিয়েই। আর আমরা বছরের পর বছর গুণতে থাকবো সুদ। বলা হয়েছিল বিদ্যুৎ আসবে ভারত থেকে। কই সেই বিদ্যুৎ? ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা ভারতে থাকলেও, তা নানা ট্যারিফ ও প্যারা ট্যারিফের কারণে ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। জানা গেছে আগামী ৩ বছরের জন্য ভারত শুল্কমুক্ত আরো ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২২৪টি পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করার অনুমতি চেয়েছে। অথচ ভারতে বাংলাদেশি ৬১টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশের অনুমতির কথা রয়েছে, যা দীর্ঘসূত্রতার জন্য আটকে আছে।
সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সিমেন্টের ওপর অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। জানা গেছে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কথা (দিনকাল, ১৭ মে)। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পোন্নত। এ জন্য বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারত সেই সুবিধা বাংলাদেশে কখনই দেয়নি। এ ক্ষেত্রে মমতা বা প্রণব মুখার্জির মতো নেতারা কোনোদিন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কেননা তারা বাঙালি হয়েও স্বার্থ দেখেছে ভারতের। অথচ আমাদের নেতৃবৃন্দ বারবার ভারতীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। বলতে দ্বিধা নেই শুধু ভারতের কারণেই সার্ক ঠিকমত বিকশিত হতে পারছে না। এর মূল কারণ মূলত ভারতীয় দ্বিপাক্ষিক নীতি। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্দ্র প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন যে তার অপসারণের পেছনে ভারতের হাত ছিল। যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ভারত নেপালের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব খাটায়। ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থা নেপাল অত্যন্ত সক্রিয়। শ্রীলংকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা প্রভাকরণকে তারাই সৃষ্টি করেছিল। আসলে ভারত তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তথা দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে চায়। অর্থনীতিতে অনেক বড় শক্তি ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য দূরীকরণের তথা উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এই প্রভাব বিস্তার রাজনীতির কারণেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় 'বন্ধুশূন্য' হতে যাচ্ছে। ক্ষমতা বাণিজ্য, প্রণব মুখার্জি- এরা সবাই মূলত ওই প্রভাব বিস্তারের রাজনীতিকেই সমর্থন করছেন। সুতরাং আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিজয়ী মমতাকে ফোন করে যত আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেন না কেন, এই আঞ্চলিক সহযোগিতা কোনোদিনই প্রতিষ্ঠিত হবে না, যতদিন না ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেই সাহায্য ও সহযোগিতা মস্নান হয়ে গেছে ভারতের প্রভাব বিস্তারের মনোভাবের কারণে। ফেলানি যেন একটুকরা বাংলাদেশ। যখন লাশ হয়ে ঝুলে থাকে ফেলানিরা, তখন ভারতের 'বন্ধুত্ব' নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে এ দেশের জনগণের। বাংলাদেশকে তারা কিভাবে দেখে, ফেলানির ঝুলে থাকা লাশ এর বড় প্রমাণ। তাই মমতা ব্যানার্জি যখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজয়ী হন, তখন আমাদের উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মানুষ সেখানে পরিবর্তন চেয়েছে। আর এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আদৌ কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হবে না। যারা সম্পর্ক উন্নত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন তৎকালীন ভারতীয় সরকারের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তখন মমতা এর প্রচ- বিরোধিতা করেছিলেন। মমতা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে 'মোস্ট আনপ্রেডিকটেবল পারসন', যার ওপর আস্থা রাখা যায় না। যে কোনো সময় তিনি ভোল পাল্টাতে পারেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তার অাঁতাত, কতদিন স্থায়ী হয়, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন। মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা করার কিছু নেই। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় একাধিক চুক্তি হবে। কিন্তু এর একটি ব্যাপারেও সংসদে আলোচনা হলো না। সমগ্র জাতিকে অন্ধকারে রেখে চুক্তিগুলো করা হচ্ছে। সংসদীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য এখানেই যে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে। বিরোধী দল তাদের মতামত দেবে। ডিবেট হবে। কিন্তু কৈ সেই ডিবেট? বিরোধী দল সংসদে যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি আছে। তারপরও তাদের সংসদে যাওয়া উচিত, যাতে করে তারা প্রসঙ্গগুলো করতে পারেন। জাতিকে জানাতে পারেন চুক্তিগুলো সম্পর্কে।
মনমোহন সিং ঢাকায় আসছেন। তিনি আমাদের অতিথি। আমরা অতিথিকে অবশ্যই সম্মান জানাবো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি যদি তিনি করেন, তাহলে বাংলাদেশিদের কাছে তিনি বিতর্কিত নেতা হিসেবেই থেকে যাবেন। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই।
বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু ভারত তার নিজ স্বার্থে একের পর এক চুক্তি করবে এবং যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না, ভারত সরকারের এই মনোভাব দুদেশের বন্ধুত্বকে কখনো আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। সাময়িক সুবিধা তাতে পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সুবিধা তাতে পাওয়া যাবে না।
 
যায় যায় দিন, শনিবার ২৭ আগস্ট ২০১১ ১২ ভাদ্র ১৪১৮ ২৬ রমজান।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
আন্তর্জাতিক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ..

0 comments:

Post a Comment