যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ একটি মেসেজ দিল এখন। নয়া মুখ্যমন্ত্রীর মুসলমানবিরোধী নানা বক্তব্যের কারণে মুসলমানরা এখন সেখানে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকবেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টির নেতা ও সাবেক বিধানসভার সদস্য মোহাম্মদ সামী খুন হয়েছেন। এটা একটা স্পষ্ট বার্তা। কট্টরপন্থিদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন মুসলমান নেতারা। বলা ভালো, উত্তরপ্রদেশের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ হচ্ছেন মুসলমান। এবারে ৪০৩টি আসনের বিধানসভায় ২৫ জন হচ্ছেন মুসলমান বিধায়ক। বিজেপি ৩১২টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। বিজেপি একজন মুসলমানকেও প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়নি। তবে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ একজন মুসলমান বিজেপি নেতাকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন সাবেক ক্রিকেটার মহসিন রেজা। বিশ্বজুড়েই এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছে। ইউরোপে মুসলমান তথা ইসলামবিদ্বেষী একটি মনোভাব সেখানকার নির্বাচনী রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প স্বয়ং এই ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবকে উসকে দিয়ে এক ধরনের ‘শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছেন। মোদির ভারতে আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়ে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতিকে তিনি উসকে দিলেন। এই হিন্দুত্ববাদ হবে তার ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ট্রাম্পকার্ড। এটা স্পষ্ট, তিনি যোগী আদিত্যনাথকে আগামীতে ব্যবহার করবেন। চলতি বছরই ছত্তীশগড়, গুজরাট, রাজস্থান, হিমাচল ও মধ্যপ্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এসব নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি যোগী আদিত্যনাথকে ব্যবহার করবেন। মোদি-অমিত শাহ-আদিত্যনাথ জুটি আগামীতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। এখন আদিত্যনাথের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাম জন্মভূমি আন্দোলন নতুন একটি মাত্রা পাবে। দায়িত্ব গ্রহণের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তিনি অযোধ্যায় রামায়ণ মিউজিয়াম গড়তে ২০ একর জমি বরাদ্দ করেছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় আদিত্যনাথ বলেছিলেন, ‘রাজ্যের সমাজবাদী পার্টির সরকার উন্নয়ন করেছে শুধু কবরস্থানগুলোর। কিন্তু বিজেপি সরকার এলে রামমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করবে। গত জুন মাসে তিনি রামমন্দিরের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, যেখানে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থাপনা ভেঙে ফেলা থেকে কেউ আটকাতে পারেনি, তো মন্দির তৈরি কে আটকাবে।’ একজন কট্টরপন্থী হিন্দু নেতা যখন ক্ষমতায় থাকার আগেই রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং তিনি ও তার দল যখন ক্ষমতায় যায়, তখন একটা আশঙ্কা থাকেই। উত্তরপ্রদেশ সরকার যদি বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, তাতে বিতর্ক শুধু বাড়াবেই না, বরং সাম্প্রদায়িক সম্মতি বিনষ্ট করবে। ভারতের রাজনীতিতে বহুত্ববাদের চর্চা দীর্ঘদিন ধরেই স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভারত এই বহুত্ববাদের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসছে। হিন্দুত্ববাদ ও যোগী আদিত্যনাথের ‘পুরো পৃথিবীতে গেরুয়া ঝা-া উড়ানোর’ সিদ্ধান্ত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় কিছু হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। আদিত্যনাথ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে এখন উসকে দিতে পারেন। কট্টরপন্থি চিন্তা-চেতনা আরও বাড়তে পারে। উত্তরপ্রদেশ থেকেই মোদি তার নয়া ভারতের যাত্রা শুরু করলেন। ২০১৯ সালের পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন তার টার্গেট, সন্দেহ নেই তাতে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ছত্তীশগড়, গুজরাট, রাজস্থান, হিমাচল ও মধ্যপ্রদেশে। এসব রাজ্যে বিজেপি কী করে সেটাই দেখার বিষয়। যে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হয়ে গেল, সেখানে বিজেপির সাফল্যে মোদি খুশি। তার সামনে আছে ২০২২ সালের ভারত, যখন ভারত রাষ্ট্রটির বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৭৫ বছরে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে তার দল বিজেপি পেয়েছিল ৩২৫ আসন, গোয়ায় ১৪, উত্তরখ-ে ৫৭ আর মণিপুরে ২২। পাঞ্জাবে কোনো আসন পায়নি বিজেপি। এই ৫টি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র পাঞ্জাবেই কংগ্রেস সরকার গঠন করতে পেরেছে। বিজেপি সরকার গঠন করেছে উত্তরপ্রদেশ, গোয়া, উত্তরখ- ও মণিপুরে। এর মধ্যে গোয়া আর মণিপুরে কোয়ালিশন সরকার। তাই পরবর্তী ৫টি বিধানসভার নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। চিন্তা করা যায়, ১৯৮৪ সালের লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। ১৯৮৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮টিতে। আর ১৯৯১ সালে বিজেপি পায় ১১৭টি। ১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০টিতে। ওই সময় স্বল্প সময়ের জন্য বিজেপি সরকারও গঠন করেছিল (১৬ মে ১৯৯৭-২৮ মে ১৯৯৭)। তবে ১৯৯৮ সালের দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিজেপি সরকার গঠন করেছিল। সেই বিজেপি এখন ক্ষমতায়। স্বপ্ন দেখছে ২০১৯ ও ২০২৪ সালেও ক্ষমতায় থাকার। তাই হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিতে ‘প্রমোট’ করছে বিজেপি এবং মোদি। তিনি নতুন ভারতের ‘উত্থান’ ঘটাতে চান। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বিজেপির সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথাই বলেছিলেন। আর তাই বেছে নিয়েছেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। কিন্তু কতটুকু সফল হবেন মোদি? ভারতের সমাজব্যবস্থায় ধনী ও গরিবের মধ্যে যে বৈষম্য, তা কি তিনি কমিয়ে আনতে পারবেন? আর যদি না পারেন, তাহলে তার নয়া ভারতের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়বে। হিন্দুত্ববাদ প্রচার ও তা উসকে দিয়ে তিনি সাময়িক সুবিধা পাবেন বটে এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও তিনি ও তার দল বিজয়ী হতে পারে। কিন্তু ভারতে এক তরুণ প্রজন্মের জন্ম হচ্ছে। এরা উচ্চশিক্ষিত। আধুনিকমনস্ক। এদের কাছে ধর্মীয় উগ্রবাদ কতটুকু আবেদন রাখবে, সেটা একটা প্রশ্ন। তিনি উন্নয়নকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, কিন্তু যদি বৈষম্য কমিয়ে আনা না যায়, তাহলে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় মানুষ খুশি হবে না। বিশ্বর ৭ম বড় দেশ হচ্ছে ভারত। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর দেশ হচ্ছে ভারত। জোহানেসবার্গে অবস্থিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ’-এর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ভারতের শত শত কোটিপতি সে দেশের সম্পদের শতকরা ৫৪ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ জাপানে এসব কোটিপতি নিয়ন্ত্রণ করে মোট সম্পদের মাত্র ২২ ভাগ। ভারতের সম্পদের ৫৩ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। এই সংখ্যা ২০০০ সালে ছিল মাত্র ৩৬ দশমিক ৮ ভাগ। ক্রেডিট সুইস আরেকটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, জনগোষ্ঠীর শতকরা ৫ ভাগ সম্পদের ৬৮ দশমিক ৬ ভাগের মালিক। অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলছে, ভারতে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। একদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে জনগোষ্ঠীর মাঝে সম্পদ বণ্টনের ব্যাপারে বৈষম্য মোদির নয়া ভারতের ধারণাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিতে পারে। তবে এটা বলাই যায়, যোগী আদিত্যনাথের নিযুক্তি ভারতে ধর্মীয় উন্মাদনাকে উসকে দিতে পারে আবার। যোগী আদিত্যনাথ রামমন্দির নির্মাণের উদ্যোক্তাদের একজন। আর এটি নির্মিত হবে বাবরি মসজিদ এলাকায়ই। পাঠকমাত্রই জানেন ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় অবস্থিত বাবরি মসজিদকে ভেঙে দিয়েছিল। বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন সহস্রাধিক ব্যক্তি। এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল পাক-ভারত বাংলাদেশ উপমহাদেশে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেখানে একটি রামমন্দির প্রতিষ্ঠারও ঘোষণা দিয়েছিল। আর এসএস ভজরং পার্টি ও বিজেপি এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। দীর্ঘদিন এই বিষয়টি আলোচনায় না এলেও আদিত্যনাথের নিযুক্তির পর এই বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির স্থাপন করা হবে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু আদিত্যনাথ ক্ষমতাসীন হওয়ায় এক ধরনের ‘উত্তেজনা’ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম হলো। যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরুন স্কোয়ামির মন্তব্য এখনে প্রণিধানযোগ্য। অরুন স্কোয়ামি লিখেছেন, (ইস্ট এশিয়ান ফোরাম ২১ মার্চ) হিন্দুত্ববাদ ও মুসলিমবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ২০১৯ সালের পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে এটা বড় প্রভাব ফেলবে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। হিন্দুত্ববাদ আবার নতুন অবয়বে ফিরে এসেছে ভারতে। ধর্মনিরপেক্ষবাদ এখন এক রকম পরিত্যক্ত বলেই মনে হয়।
Daily Amader Somoy
03.04.2017
স্যার,ভোটের রাজনীতি সবখানেই এক। তবে আদিত্যনাত এখন সরকার প্রধান হয়ে কি করেন তা দেখতে হয়তোবা আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
ReplyDelete