মিসরে তিন দর্শকের একনায়ক হোসনি মোবারকের পতনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কতটুকু? দীর্ঘ ১৮ দিন কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে অবস্থান নিয়ে হাজার হাজার মিসরবাসি হোসনি মোবারকের পতন ঘটিয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের ছটি দাবীর একটি দাবীও পূরণ হয়নি। মিসরবাসী এই গণঅভু্যত্থানকে অভিহিত করেছিল জবাড়ষঁঃরড়হ ২.০ হিসেবে। সামাজিক নেটওয়ার্ক 'ফেসবুক' আর 'টুইটার' যে সমাজে কত বড় পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে জবাড়ষঁঃরড়হ ২.০ তার বড় প্রমাণ। আন্দোলনকারীদের প্রথম দাবি ছিল একটি -বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া। কিন্তু তা হয়নি। একটি সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল হুসেইন তানতাবি এই সামরিক কাউন্সিলের প্রধান। তার সাথে আছেন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সামি হাফেজ আনানসহ নূ্যনতম ছ'জন সেনা ও বিমান বাহিনীর ঊধর্্বতন কর্মকর্তা। মিসরে যে ঘটনা ঘটেছে, তাকে সামরিক পরিভাষায় আমরা বলতে পারি ঝড়ভঃ ঈড়ঁঢ়-ফব-বঃধঃ অর্থাৎ ভদ্রজনিত সামরিক অভু্যত্থান। গেল শুক্রবার অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি তাহরিব স্কোয়ার জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। কয়েক লক্ষ মানুষ সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিল। শুধু মানুষ আর মানুষ। তখনই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল হোসনি মোবারকের ভাগ্য। যদিও তার মাত্র কয়েকদিন আগেই হোসনি মোবারক জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন তিনি কিছু ক্ষমতা নবনিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্টের হাত ছেড়ে দিচ্ছেন। তবে ক্ষমতায় থাকবেন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।। কিন্তু বিপস্নবীরা ছিলেন অনড়। তাদের দাবি ছিল একটাই হোসনি মোবারকের ক্ষমতা ত্যাগ। শেষ পর্যন্ত তার বিশ্বস্ত সেনাবাহিনীই তাকে বাধ্য করলো ক্ষমতা ছেড়ে দিতে। কিন্তু তাতে করে কী মিসরের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে?
মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব বিশ্বের ইতিহাস সাক্ষী দেয় সেনাবাহিনী একবার ক্ষমতা নিলে, সহজে ক্ষমতা ছাড়ে না। সিরিয়ায় ছাড়েনি। ইরাকেও ছাড়েনি দীর্ঘদিন। সেনাবাহিনী সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করেছিল ১৯৬৩ সালে। জেনারেল আসাদ ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। ২০০০ সালে তার স্বাভাবিক মৃতু্যর পর তার ছেলে বাসার আল আসাদ এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। সুদানে জেনারেল ওমর হাসান আল বসির ক্ষমতায় আছেন ১৯৮৯ সাল থেকে। গাদ্দাফি লিবিয়াতে আছেন ৪২ বছর। ইয়েমেনে আলী আবদুলস্নাহ সালেহ আছেন ৩২ বছর ধরে। তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচু্যত জইন আল আবেদিন বেন আলী ছিলেন ২৩ বছর। আলজেরিয়াতে বুতেফ্লিকাও আছেন ১৩ বছর ধরে। আর মিসরে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় সেই ১৯৫২ সাল থেকেই। কোন আরব দেশেই প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হয়নি। সেনাবাহিনীর ঊধর্্বতন জেনারেলরা বছরের পর বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
এখানে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার জন্ম হয়নি। বিকশিত হয়নি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
মিসরের রাজনীতি বুঝতে হলে এ অঞ্চলের উত্থান-পতনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বুঝতে হবে। সেনাবাহিনী আরব বিশ্বের রাজনীতিতে একটি শক্তি। তিউনিশিয়ায় সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ায় পতন ঘটে জইন আল আবেদিন বেন আলীর, যিনি নিজেও সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ছিলেন। আজ সেনাবাহিনী হোসনি মোবারকের পাশে না দাঁড়ানোর ফলে তাকে সরে যেতে হয়। হোসনি মোবারক এখন ক্ষমতায় নেই। মিসরে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকাকে নিশ্চিত করেছিলেন কর্ণেল গামাল আবদুন নাসের। নাসের সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্রি অফিসার্স ক্লাব গঠন করেছিল ১৯৪৯ সালে। এই ফ্রি অফিসার্স ক্লাবের উদ্যোগেই ১৯৫২ সালে সামরিক অভু্যত্থান পরিচালিত হয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেলরা রাজনৈতিক সংগঠনও জন্ম দিয়েছেন। ১৯৫২-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সালে গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। ১৯৭১ সালে সাদাত গঠন করেছিলেন আরব সোশ্যালিষ্ট ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে সাদাত এটাকে ভেঙ্গে গঠন করেছিলেন 'নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন'। আর মোবারক গঠন করেছিলেন 'ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি'। মিসরে একমাত্র ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি' ক্যাডার ভিত্তিক পার্টি। নাসের থেকে শুরু করে হোসনি মোবারক, যিনি এক সময় বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন, তারা নিজ স্বার্থে দল গঠন করেছেন। এখানে সঠিক অর্থে কোন রাজনৈতিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দল গঠিত হয়নি। ক্ষমতায় থাকার জন্যই তারা দল করেছেন। সেখানে সুবিধাবাদীদের ভিড় হয়েছে। সেই রানী মৌমাছি তত্ত্বের মত। একটি রানী মৌমাছিকে কেন্দ্র করে যেমনি একটি মৌচাকের সৃষ্টি হয়; ঠিক তেমনি একজন জেনারেলকে কেন্দ্র করেই সুবিধাভোগীরা 'ক্ষমতার চাক'-এর জন্ম দিয়েছিলেন। নাসের এ থেকে আরব জাতীয়তাবাদের কথা বলে একটা দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারকের কোন দর্শন ছিল না। তিউনিসিয়ায় একই ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সেনাবাহিনীও একটি সুবিধা ভোগী শ্রেণীকে কেন্দ্র করে বেন আলী দীর্ঘদিন তার ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। আলজেরিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বেনবেলস্নাকে ১৯৬৫ সালে এক সামরিক অভু্যত্থানে কর্ণেল বুমেদিয়েন উৎখাত করেছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে তার স্বাভাবিক মৃতু্যর আগ পর্যন্ত তিনি এককভাবেই দেশটি শাসন করে গেছেন এবং ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্য একটি দলও গঠন করেছিলেন। বলা ভালো দেশটি একদলীয় শাসনে পরিচালিত হয়েছে দীর্ঘদিন এবং ১৯৮৯ সালে গণভোটে সংবিধানে পরিবর্তন এনে বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকার ক্ষমতার উৎস ওই সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায় এবং সংবিধান পরিবর্তন করে তিনি তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এখন শোনা যাচ্ছে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য তার ভাইকে তিনি প্রস্তুত করছেন। আর লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফি আছেন ১৯৬৯ সাল থেকে। এখানে এক অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা তিনি প্রবর্তন করেছেন। যেখানে রাজনৈতিক দলের কোন ভূমিকা নেই। সেনাবাহিনী হচ্ছে তার ক্ষমতার মূল উৎস।
তাই দেখা যাচ্ছে আরব বিশ্বে সেনাবাহিনীই হচ্ছে মূল শক্তি। গত ছয় দশকের রাজনীতি নিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে আমরা মূলত তিনটি ধারা লক্ষ্য করবো। ১৯৫২ সালে মিসরে নাসেরের উত্থানের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ, ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে আরব বিশ্বের দেশগুলোর পরাজয় আর ১৯৭৯ সালে ইরানী ইসলামিক বিপস্নব যার ঢেউ বয়ে যায় পুরো আরব বিশ্বে। এখন তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপস্নব-এর মধ্য দিয়ে চতুর্থ একটি ধারা সূচিত হল, যেখানে সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এটাই হচ্ছে 'পিপলস পাওয়ার' জনতার শক্তি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে তা কোন বাধাই মানে না। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। প্রতিটি বিপস্নবের যেমনি একটি প্রেক্ষাপট আছে তেমনি আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক গণজাগরণের একটি প্রেক্ষাপট আছে। তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ আছে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েও বেকার। এই তরুণ সমাজ আজ একটি শক্তি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আলজেরিয়ায় মোট জনগোষ্ঠীর ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ হচ্ছে তরুণ, যাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। লিবিয়ায় এই সংখ্যা ৪৭.৪ ভাগ, মিসরে ৫২.৩ ভাগ, সিরিয়ায় ৫৫.৩, জর্দানে ৫৪.৩ ইয়েমেনে ৬৫.৪ তিউনেসিয়ায় ৪২.১ ভাগ। অন্যান্য আরব বিশ্বের অবস্থা মোটামুটি এককে এদের জন্য সরকার নূ্যনতম চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। কিন্তু সরকারের সাথে সংশিস্নষ্ট ব্যক্তিরা অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। একমাত্র তেলসমৃদ্ধ কয়েকটি দেশ (সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, আরব আমিরাত) বাদে বাকি আরব বিশ্বের ব্যক্তিগত খাতে জিডিপির পরিমাণ কম। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা, অর্থাৎ পিপিপি (চঁৎপযধংরহম চড়বিৎ চধৎরঃু) হিসাবে এই জিডিপি বের করা হয়েছে। যেখানে কাতারে এই জিডিপির পরিমাণ ৬৬.৯ (সৌদি আরবে ২২.৯, কুয়েতে ৪০.৬ আরব আমিরাতে ২৭.২) সেখানে মিসরে এর পরিমাণ মাত্র ৫.৯, তিউনেসিয়ায় ৪.৮, আলজেরিয়ায় ৮.২, সিরিয়ায় ৪.৭, জর্দানে ৫.২ ও ইয়েমেনে মাত্র ২.৯। এ থেকে দরিদ্রতার একটি চিত্র পাওয়া যায়। আরব বিশ্বে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কম। কেননা তারা দরিদ্র। তেল- সমৃদ্ধ কয়েকটি আরব দেশ বাদে প্রতিটি আরব বিশ্বে মূলত দুটি শ্রেণীর জন্ম হয়েছে। একটি ধনী, অপরটি একেবারেই গরিব। এরাই তিউনিসিয়ার বিপস্নবকে সম্পন্ন করেছে, আর কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে গণজমায়েতের আয়োজন করে সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। সম্ভবত একই ধরনের ইতিহাস লিখিত হবে আলজেরিয়া ও ইয়েমেনের।
এখন মিসরে কী হতে যাচ্ছে বলা মুসকিল। মিসরে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকাকে প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রশংসা করলেও সেনাবাহিনী যদি দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করে, তাহলে বিতর্ক কম হবে। আর সেনাবাহিনী যদি তার পূর্বসূরীদের মত ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা বাড়াবেই। সেনাবাহনীকে ক্ষমতায় রাখতেই ইসরাইল চাইবে। এ ক্ষেত্রে ফিল্ড মার্শাল তানতারির একটি বক্তব্য বিবেচনায় নেয়া যায়।
তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু দীর্ঘদিনের গড়া সেনা স্টাবলিসমেন্ট সহজে ভেঙ্গে যাবার নয়। মিসরে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ একটা ভূমিকা থাকবেই। প্রথমত, আন্তর্জাতিক জনমতের চাপে একটি নির্বাচন দিতে হবে সামরিক কাউন্সিলকে। এক্ষেত্রে সামরিক কাউন্সিলের প্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি নিজেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। অথবা বিকল্প হিসেবে হোসনি মোবারক কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমানও প্রাথর্ী হতে পারেন। রাজনৈতিক সংস্কার যদি আনা না যায় তাহলে সেই পুরনো নিয়োমে সরকারি প্রাথর্ীদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দ্বিতীয়ত, মিসরের ২১০ মিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সেখানে সেনাবাহিনী ১০ থেকে ১৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তেল, দুগ্ধ, বেকারি, পানি, হোটেল ব্যবসা, রিসোর্ট, সিমেন্ট, গাড়ী উৎপাদন শিল্পে সেনাবাহিনীর বিনিয়োগ রয়েছে। এর ফলে সমাজে সেনাবাহিনীর একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। এই অবস্থান থেকে সেনাবাহিনীকে সারানো যাবে না। তৃতীয়ত, হোসনি মোবারক কতর্ৃক গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটি পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। দলটির প্রভাব ও প্রতিপত্তি রয়ে গেছে। তারাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন নতুন শক্তি হিসাবে। চতুর্থত, দীর্ঘদিনের একনায়কতন্ত্রী শাসনের কারণে সেখানে সত্যিকার অর্থে কোন গণতান্ত্রিক শক্তির জন্ম হয়নি। গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ নয়। হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেছে কিছু তরুণ সংগঠক। সেই অর্থে তাদের কোন দল নেই। মজার ব্যাপার ইসলাম পন্থি, গণতন্ত্রী ও মার্কাসবাদীরা সবাই এই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কোন বিভেদ ছিল না। কোন একক নেতৃত্বেও এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি। এমনকি ইসলামপন্থী ইসলামিক ব্রাদারহুডকে অন্যতম শক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু তারাও এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়নি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরা একক প্রাথর্ী দাঁড় করাবেন না। পঞ্চমত, হোসনি মোবারক বিরোধি আন্দোলনের সময় দু'জন ব্যক্তি এল বারাদি ও আমর মুসা বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এদের দু'জনকে ভবিষ্যৎ মিসরের নেতা হিসেবেও চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এদের কারোর সাথেই মিসরের সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। এল বারাদি থাকেন ভিয়েনাতে। জাতিসংঘের কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু মিসরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তার কোন ভূমিকা নেই। অন্যদিকে আমর মুসা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিগত দিনগুলোতে ক্ষমতাসীনদের আশেপাশেই তিনি ছিলেন। মিসরের সাধারণ মানুষের কাছে এরা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবেন সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। ষষ্ঠ, ইসলামিক ব্রাদারহুড একটি পুরনো সংগঠন। দলটি নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও দলটির একটি বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে জানান হয়েছে তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলশ্রুতিতে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এই দলটির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে মিসরে আদৌ গণতন্ত্র বিকশিত হবে কী না।
মিসরে একটি পরিবর্তন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু যেতে হবে অনেকদূর। সংবিধান সংশোধনটা জরুরী। সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি কমিটি গঠিত হলেও, কমিটির কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। সংবিধান সংশোধন না করে সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে করে মিসরে সমাজ ব্যবস্থা যা ছিল তাই থেকে যাবে। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ পুরনো সবকিছুই রয়ে গেছে। মোবারকের পতনের পর ১২ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে অনেক ছবি। তাহরির স্কোয়ার প্রায় খালি, ঝাড়-দার পরিষ্কার করছে স্কোয়ারটি। পস্নাকার্ড হাতে এক ব্যক্তির ছবি ছাপা হয়েছে। পস্নাকার্ডে ইংরেজিতে লেখা 'ঞড় ফধু সু ৎবধষ ইরৎঃযফধু- ও ধস ভৎবব'_ আজকে আমার সত্যিকার জন্মদিন, আমি স্বাধীন। পস্নাকার্ডের এই বক্তব্য বলে দেয় মিসরবাসীর বিশ্বাসের কথা। কিন্তু সত্যিই কী মিসরবাসী মুক্ত হয়েছেন, নাকি শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে? মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাই প্রশ্ন থাকবেই।
[লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব বিশ্বের ইতিহাস সাক্ষী দেয় সেনাবাহিনী একবার ক্ষমতা নিলে, সহজে ক্ষমতা ছাড়ে না। সিরিয়ায় ছাড়েনি। ইরাকেও ছাড়েনি দীর্ঘদিন। সেনাবাহিনী সিরিয়ায় ক্ষমতা দখল করেছিল ১৯৬৩ সালে। জেনারেল আসাদ ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। ২০০০ সালে তার স্বাভাবিক মৃতু্যর পর তার ছেলে বাসার আল আসাদ এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। সুদানে জেনারেল ওমর হাসান আল বসির ক্ষমতায় আছেন ১৯৮৯ সাল থেকে। গাদ্দাফি লিবিয়াতে আছেন ৪২ বছর। ইয়েমেনে আলী আবদুলস্নাহ সালেহ আছেন ৩২ বছর ধরে। তিউনিসিয়ায় ক্ষমতাচু্যত জইন আল আবেদিন বেন আলী ছিলেন ২৩ বছর। আলজেরিয়াতে বুতেফ্লিকাও আছেন ১৩ বছর ধরে। আর মিসরে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় সেই ১৯৫২ সাল থেকেই। কোন আরব দেশেই প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হয়নি। সেনাবাহিনীর ঊধর্্বতন জেনারেলরা বছরের পর বছর ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
এখানে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার জন্ম হয়নি। বিকশিত হয়নি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
মিসরের রাজনীতি বুঝতে হলে এ অঞ্চলের উত্থান-পতনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বুঝতে হবে। সেনাবাহিনী আরব বিশ্বের রাজনীতিতে একটি শক্তি। তিউনিশিয়ায় সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ায় পতন ঘটে জইন আল আবেদিন বেন আলীর, যিনি নিজেও সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ছিলেন। আজ সেনাবাহিনী হোসনি মোবারকের পাশে না দাঁড়ানোর ফলে তাকে সরে যেতে হয়। হোসনি মোবারক এখন ক্ষমতায় নেই। মিসরে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকাকে নিশ্চিত করেছিলেন কর্ণেল গামাল আবদুন নাসের। নাসের সেনাবাহিনীর মধ্যে ফ্রি অফিসার্স ক্লাব গঠন করেছিল ১৯৪৯ সালে। এই ফ্রি অফিসার্স ক্লাবের উদ্যোগেই ১৯৫২ সালে সামরিক অভু্যত্থান পরিচালিত হয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেলরা রাজনৈতিক সংগঠনও জন্ম দিয়েছেন। ১৯৫২-৫৬ সালে নাসের গঠন করেছিলেন 'লিবারেশন র্যালি'। ১৯৫৭-৭০ সালে গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ইউনিয়ন'। ১৯৭১ সালে সাদাত গঠন করেছিলেন আরব সোশ্যালিষ্ট ইউনিয়ন। ১৯৭৯ সালে সাদাত এটাকে ভেঙ্গে গঠন করেছিলেন 'নিউ ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন'। আর মোবারক গঠন করেছিলেন 'ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি'। মিসরে একমাত্র ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি' ক্যাডার ভিত্তিক পার্টি। নাসের থেকে শুরু করে হোসনি মোবারক, যিনি এক সময় বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন, তারা নিজ স্বার্থে দল গঠন করেছেন। এখানে সঠিক অর্থে কোন রাজনৈতিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে দল গঠিত হয়নি। ক্ষমতায় থাকার জন্যই তারা দল করেছেন। সেখানে সুবিধাবাদীদের ভিড় হয়েছে। সেই রানী মৌমাছি তত্ত্বের মত। একটি রানী মৌমাছিকে কেন্দ্র করে যেমনি একটি মৌচাকের সৃষ্টি হয়; ঠিক তেমনি একজন জেনারেলকে কেন্দ্র করেই সুবিধাভোগীরা 'ক্ষমতার চাক'-এর জন্ম দিয়েছিলেন। নাসের এ থেকে আরব জাতীয়তাবাদের কথা বলে একটা দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আনোয়ার সাদাত কিংবা হোসনি মোবারকের কোন দর্শন ছিল না। তিউনিসিয়ায় একই ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সেনাবাহিনীও একটি সুবিধা ভোগী শ্রেণীকে কেন্দ্র করে বেন আলী দীর্ঘদিন তার ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। আলজেরিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বেনবেলস্নাকে ১৯৬৫ সালে এক সামরিক অভু্যত্থানে কর্ণেল বুমেদিয়েন উৎখাত করেছিলেন। এরপর ১৯৭৮ সালে তার স্বাভাবিক মৃতু্যর আগ পর্যন্ত তিনি এককভাবেই দেশটি শাসন করে গেছেন এবং ক্ষমতাকে নিয়মসিদ্ধ করার জন্য একটি দলও গঠন করেছিলেন। বলা ভালো দেশটি একদলীয় শাসনে পরিচালিত হয়েছে দীর্ঘদিন এবং ১৯৮৯ সালে গণভোটে সংবিধানে পরিবর্তন এনে বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকার ক্ষমতার উৎস ওই সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায় এবং সংবিধান পরিবর্তন করে তিনি তৃতীয়বারের মত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এখন শোনা যাচ্ছে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য তার ভাইকে তিনি প্রস্তুত করছেন। আর লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফি আছেন ১৯৬৯ সাল থেকে। এখানে এক অদ্ভুত শাসন ব্যবস্থা তিনি প্রবর্তন করেছেন। যেখানে রাজনৈতিক দলের কোন ভূমিকা নেই। সেনাবাহিনী হচ্ছে তার ক্ষমতার মূল উৎস।
তাই দেখা যাচ্ছে আরব বিশ্বে সেনাবাহিনীই হচ্ছে মূল শক্তি। গত ছয় দশকের রাজনীতি নিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে আমরা মূলত তিনটি ধারা লক্ষ্য করবো। ১৯৫২ সালে মিসরে নাসেরের উত্থানের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ, ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে আরব বিশ্বের দেশগুলোর পরাজয় আর ১৯৭৯ সালে ইরানী ইসলামিক বিপস্নব যার ঢেউ বয়ে যায় পুরো আরব বিশ্বে। এখন তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপস্নব-এর মধ্য দিয়ে চতুর্থ একটি ধারা সূচিত হল, যেখানে সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এটাই হচ্ছে 'পিপলস পাওয়ার' জনতার শক্তি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে তা কোন বাধাই মানে না। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। প্রতিটি বিপস্নবের যেমনি একটি প্রেক্ষাপট আছে তেমনি আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক গণজাগরণের একটি প্রেক্ষাপট আছে। তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ আছে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েও বেকার। এই তরুণ সমাজ আজ একটি শক্তি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আলজেরিয়ায় মোট জনগোষ্ঠীর ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ হচ্ছে তরুণ, যাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। লিবিয়ায় এই সংখ্যা ৪৭.৪ ভাগ, মিসরে ৫২.৩ ভাগ, সিরিয়ায় ৫৫.৩, জর্দানে ৫৪.৩ ইয়েমেনে ৬৫.৪ তিউনেসিয়ায় ৪২.১ ভাগ। অন্যান্য আরব বিশ্বের অবস্থা মোটামুটি এককে এদের জন্য সরকার নূ্যনতম চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। কিন্তু সরকারের সাথে সংশিস্নষ্ট ব্যক্তিরা অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। একমাত্র তেলসমৃদ্ধ কয়েকটি দেশ (সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, আরব আমিরাত) বাদে বাকি আরব বিশ্বের ব্যক্তিগত খাতে জিডিপির পরিমাণ কম। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা, অর্থাৎ পিপিপি (চঁৎপযধংরহম চড়বিৎ চধৎরঃু) হিসাবে এই জিডিপি বের করা হয়েছে। যেখানে কাতারে এই জিডিপির পরিমাণ ৬৬.৯ (সৌদি আরবে ২২.৯, কুয়েতে ৪০.৬ আরব আমিরাতে ২৭.২) সেখানে মিসরে এর পরিমাণ মাত্র ৫.৯, তিউনেসিয়ায় ৪.৮, আলজেরিয়ায় ৮.২, সিরিয়ায় ৪.৭, জর্দানে ৫.২ ও ইয়েমেনে মাত্র ২.৯। এ থেকে দরিদ্রতার একটি চিত্র পাওয়া যায়। আরব বিশ্বে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কম। কেননা তারা দরিদ্র। তেল- সমৃদ্ধ কয়েকটি আরব দেশ বাদে প্রতিটি আরব বিশ্বে মূলত দুটি শ্রেণীর জন্ম হয়েছে। একটি ধনী, অপরটি একেবারেই গরিব। এরাই তিউনিসিয়ার বিপস্নবকে সম্পন্ন করেছে, আর কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে গণজমায়েতের আয়োজন করে সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। সম্ভবত একই ধরনের ইতিহাস লিখিত হবে আলজেরিয়া ও ইয়েমেনের।
এখন মিসরে কী হতে যাচ্ছে বলা মুসকিল। মিসরে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকাকে প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রশংসা করলেও সেনাবাহিনী যদি দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করে, তাহলে বিতর্ক কম হবে। আর সেনাবাহিনী যদি তার পূর্বসূরীদের মত ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা বাড়াবেই। সেনাবাহনীকে ক্ষমতায় রাখতেই ইসরাইল চাইবে। এ ক্ষেত্রে ফিল্ড মার্শাল তানতারির একটি বক্তব্য বিবেচনায় নেয়া যায়।
তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু দীর্ঘদিনের গড়া সেনা স্টাবলিসমেন্ট সহজে ভেঙ্গে যাবার নয়। মিসরে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ একটা ভূমিকা থাকবেই। প্রথমত, আন্তর্জাতিক জনমতের চাপে একটি নির্বাচন দিতে হবে সামরিক কাউন্সিলকে। এক্ষেত্রে সামরিক কাউন্সিলের প্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি নিজেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। অথবা বিকল্প হিসেবে হোসনি মোবারক কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমানও প্রাথর্ী হতে পারেন। রাজনৈতিক সংস্কার যদি আনা না যায় তাহলে সেই পুরনো নিয়োমে সরকারি প্রাথর্ীদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। দ্বিতীয়ত, মিসরের ২১০ মিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, সেখানে সেনাবাহিনী ১০ থেকে ১৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। তেল, দুগ্ধ, বেকারি, পানি, হোটেল ব্যবসা, রিসোর্ট, সিমেন্ট, গাড়ী উৎপাদন শিল্পে সেনাবাহিনীর বিনিয়োগ রয়েছে। এর ফলে সমাজে সেনাবাহিনীর একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। এই অবস্থান থেকে সেনাবাহিনীকে সারানো যাবে না। তৃতীয়ত, হোসনি মোবারক কতর্ৃক গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটি পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। দলটির প্রভাব ও প্রতিপত্তি রয়ে গেছে। তারাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন নতুন শক্তি হিসাবে। চতুর্থত, দীর্ঘদিনের একনায়কতন্ত্রী শাসনের কারণে সেখানে সত্যিকার অর্থে কোন গণতান্ত্রিক শক্তির জন্ম হয়নি। গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ নয়। হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেছে কিছু তরুণ সংগঠক। সেই অর্থে তাদের কোন দল নেই। মজার ব্যাপার ইসলাম পন্থি, গণতন্ত্রী ও মার্কাসবাদীরা সবাই এই আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কোন বিভেদ ছিল না। কোন একক নেতৃত্বেও এই আন্দোলন পরিচালিত হয়নি। এমনকি ইসলামপন্থী ইসলামিক ব্রাদারহুডকে অন্যতম শক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু তারাও এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়নি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরা একক প্রাথর্ী দাঁড় করাবেন না। পঞ্চমত, হোসনি মোবারক বিরোধি আন্দোলনের সময় দু'জন ব্যক্তি এল বারাদি ও আমর মুসা বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এদের দু'জনকে ভবিষ্যৎ মিসরের নেতা হিসেবেও চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এদের কারোর সাথেই মিসরের সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। এল বারাদি থাকেন ভিয়েনাতে। জাতিসংঘের কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু মিসরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তার কোন ভূমিকা নেই। অন্যদিকে আমর মুসা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিগত দিনগুলোতে ক্ষমতাসীনদের আশেপাশেই তিনি ছিলেন। মিসরের সাধারণ মানুষের কাছে এরা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবেন সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। ষষ্ঠ, ইসলামিক ব্রাদারহুড একটি পুরনো সংগঠন। দলটি নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও দলটির একটি বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। দলটির পক্ষ থেকে জানান হয়েছে তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলশ্রুতিতে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। এই দলটির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে মিসরে আদৌ গণতন্ত্র বিকশিত হবে কী না।
মিসরে একটি পরিবর্তন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু যেতে হবে অনেকদূর। সংবিধান সংশোধনটা জরুরী। সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি কমিটি গঠিত হলেও, কমিটির কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। সংবিধান সংশোধন না করে সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাতে করে মিসরে সমাজ ব্যবস্থা যা ছিল তাই থেকে যাবে। শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ পুরনো সবকিছুই রয়ে গেছে। মোবারকের পতনের পর ১২ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে অনেক ছবি। তাহরির স্কোয়ার প্রায় খালি, ঝাড়-দার পরিষ্কার করছে স্কোয়ারটি। পস্নাকার্ড হাতে এক ব্যক্তির ছবি ছাপা হয়েছে। পস্নাকার্ডে ইংরেজিতে লেখা 'ঞড় ফধু সু ৎবধষ ইরৎঃযফধু- ও ধস ভৎবব'_ আজকে আমার সত্যিকার জন্মদিন, আমি স্বাধীন। পস্নাকার্ডের এই বক্তব্য বলে দেয় মিসরবাসীর বিশ্বাসের কথা। কিন্তু সত্যিই কী মিসরবাসী মুক্ত হয়েছেন, নাকি শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে? মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাই প্রশ্ন থাকবেই।
[লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
0 comments:
Post a Comment