রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শেখ হাসিনার চীন সফর ও দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কের বিষয়টি এখন সামনে চলে এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অতিসম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে চীনের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে যথেষ্ট। প্রথমত, চীনের আপত্তি সত্ত্বেও তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার ওয়াশিংটন সফর। দ্বিতীয়ত, ওয়াশিংটন সফর শেষ করে এসে দালাই লামার তিব্বতের স্বায়ত্তশাসন দাবি ও সিনচিয়াং প্রদেশের মুসলমান উইগুরদের দাবি দাওয়ার প্রতি সমর্থন ছুড়ে দেওয়া। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের 'পারমাণবিক সম্পর্ক' এবং সেই সঙ্গে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের 'জুনিয়র পার্টনার' বা 'কৌশলগত মিত্র' বানানোর উদ্যোগ। চতুর্থত, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি পুতিনের নয়াদিলি্ল সফর ও ভারতের সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর। প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনের স্বার্থ লঙ্ঘিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে এবং চীন মনে করছে, ওয়াশিংটনের একটি হাত রয়েছে এসব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আপত্তি সত্ত্বেও দালাই লামাকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানানোয়। স্পষ্টতই সত্তরের দশকের শুরুতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বেইজিং সফরের মধ্য দিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের যে ভিত্তি রচিত হয়েছিল, আজ ৪০ বছর পর সেই সম্পর্ক ফিকে হয়ে আসছে। ১৯৫৬ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামনে রেখে জর্জ কেন্মান যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন (Theory of Containment), আজ নতুন আঙ্গিকে চীনকে 'ঘিরে ফেলার' তত্ত্ব রচনা করতে পারে ওয়াশিংটন। একদিকে তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে তাইওয়ানকে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো, অন্যদিকে অস্ত্র ও পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে তৈরি করার মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন নতুন একটি Containment Policy রচনা করতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র আগামী দিনে এ ক্ষেত্রে পালন করবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ভারতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের চিন্তাধারায় সাম্প্রতিক সময়ে বড় পরিবর্তন এসেছে। ওবামা খুব শিগগিরই ভারত সফরে আসছেন। এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। সিনেটর কেরি ভারতের পরমাণু কর্মসূচি সমর্থন করেছিলেন। কেরি বুশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়েছিলেন। এখন ওবামা বুশ প্রণীত নীতি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। বুশের আমলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। এখন ওবামার আমলেও তিনি দ্বিতীয়বার ওয়াশিংটন সফর করলেন ২০০৯ সালের নভেম্বরে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের এটা ধারাবাহিকতা মাত্র।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে একটা প্রশ্ন তাই থাকবেই যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এখন ভিন্ন চোখে দেখতে চাইছে কেন? এ প্রশ্নের সত্যতার জন্য বারাক ওবামার একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। গত ২৪ নভেম্বর ২০০৯ হোয়াইট হাউসে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ওবামার আলোচনার পর ওবামা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের ভূমিকা উল্লেখ করেছিলেন এভাবে_'In Asia, Indian Leadership is expanding prosperity and the security across the region. And the United States welcomes and encourages India's Leadership role in helping to shape the rise of a stable, peaceful and prosperous Asia' (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৫ নভেম্বর, ২০০৯)। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে, এশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে ভারতের নেতারা একটি বড় ভূমিকা রাখছেন। আর ওবামার কথায় ভারতের এই ভূমিকাকে যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহিত করছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে নিরাপত্তার সমস্যাটিকে যেভাবে দেখছে, ভারতও ঠিক একইভাবে দেখছে এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যাটিকে মোকাবিলা করতে চায়। এ অঞ্চলে উভয় দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র এখন তার স্বার্থকে এগিয়ে নিতে ভারতকে মিত্র হিসেবে দেখছে।
এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রচিত হয়েছে আফগানিস্তান তথা মধ্য এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরকে ঘিরে। প্রতিটি ক্ষেত্রে চীন একটি ফ্যাক্টর। চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে ভারতও। চীনের ভূমিকাকে এ অঞ্চলে সঙ্কুচিত করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ এক। যদিও ওবামার চীন সফরের পর একটা ধারণার জন্ম হয়েছে, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের আরো উন্নতি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে যাচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের কোনো তুলনা হয় না (চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির তিন ভাগের এক ভাগ, প্রতিরক্ষা বাজেট ছয় ভাগের এক ভাগ, চীনের মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ ভাগের এক ভাগ); কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার ঋণী। ইরানে চীনের স্বার্থ (চীনের বিনিয়োগ সব সেক্টর মিলিয়ে ৫০ বিলিয়ন ডলার) যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি মাথাব্যথার কারণ। তাই সমগ্র ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়েছে ভারতের মতো শক্তির। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিয়ে আলোচনার আগে আফগানিস্তান নিয়ে দুই কথা বলা প্রয়োজন। ২০০১ সালের অক্টোবরের পর থেকে ২০০৯ সালের শেষ দিন পর্যন্ত আফগানিস্তানে অনেক রক্ত ঝরেছে। হামিদ কারজাই দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট 'নির্বাচিত' হয়েছেন সত্য, কিন্তু আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটো বাহিনীর গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ানো যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাইবে, আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ুক। এতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। নিউজউইকের সম্পাদক ফরিদ জাকারিয়া ওয়াশিংটন পোস্টে (২৩ নভেম্বর, ২০০৯) জেনারেল ম্যাকক্রিস্টানোর একটি গোপন দলিলের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ফরিদ জাকারিয়া লিখেছেন : 'Increasing Indian influence in Afganistan is likely exacerbate regional tensions and encourage Pakistani countermeasures|' ফরিদ জাকারিয়া আরো লিখেছেন, 'India is the hegemony of South Asia with enormous influence throughout the sub-continent'। তাঁর মূল্যায়নে কোনো মিথ্যা নেই। আফগানিস্তানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মতৎপরতা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র ভারতের 'রাজনৈতিক প্রভাব' যে বাড়ছে, তা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই ওবামা প্রশাসন যদি আফগানিস্তানে ভারতকে বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ দেয়, তাহলে তা একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত হানতে বাধ্য। অন্যদিকে ভারতীয় মহাসাগরঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়ছে, যা পেন্টাগনের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে থাকবে। চীন এ অঞ্চলজুড়ে যে 'মুক্তার মালা' বা 'String of Pearls'-এর নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে বেলুচিস্তানের গাওদার বন্দর (যা চীন তৈরি করে দিচ্ছে), দক্ষিণ চীন সাগর থেকে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীনের রপ্তানি লাভ তেলের ৮০ ভাগ মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে। গাওদারের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার হাসবানতোতা, মিয়ানমারের সিটওয়ে ও কাইয়াসুকে রয়েছে চীনা নেভির ঘাঁটি। কোকো দ্বীপপুঞ্জ ব্যবহার করতে পারে চীনা নৌবাহিনী। চীন শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। চীন যুদ্ধবিমান দিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকারকে বিদ্রোহী তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ শেষ' করতে সাহায্য করেছিল। মজার ব্যাপার, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের রেশ ধরে এ অঞ্চলে চীন-ইরান-রাশিয়ার ঐক্য গড়ে উঠেছিল। তারা রাজাপাকসের সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনা নেভির উপস্থিতিকে ভারতও খুব সহজভাবে নেয়নি। প্রতিপক্ষ ভারতীয় নৌবাহিনীও এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী। মুম্বাই, কারওয়ার, কোচি, বিশাখাপত্তম, পোর্ট রেয়ারে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ঘাঁটি। সেই সঙ্গে সিসিলি, মাদাগাস্কার, মৌরিতুসে ভারতীয় নৌবাহিনী বন্দর সুবিধা পায়। আর দিয়াগো গার্সিয়াতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ঘাঁটি। তুলনামূলক বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখানে কিছুটা দুর্বল। এ কারণেই তার ভারতীয় নৌবাহিনীর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ইরানের ওপর চাপ বাড়াতে এই বেলুচিস্তান একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে ভবিষ্যতে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও বাংলাদেশ খুব একটা বড় ভূমিকা পালন করে না। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো। চীন বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে অনেকেরই। নেপালের প্রেসিডেন্টও চীন গিয়েছিলেন। চীনে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেও। তাই চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তার 'বন্ধু' খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে দেখতে হবে এ আলোকেই।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
[সূত্রঃ কালের কণ্ঠ, ১৯/০৩/১০]

0 comments:

Post a Comment