শীতের মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবনা এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কেমন যাবে এবার । গ্রীষ্মের দিনগুলো। শীতেও মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্যাসের অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়নি। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সরকার একাধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও চলতি গ্রীষ্মে এর ফল পাওয়া যাবে না। উপরন্তু রয়েছে বোরো মৌসুমে সেচ সরবরাহ অব্যাহত রাখা, যেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। সেচের জন্য এবার ২০ হাজারের বেশি পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে, যার জন্য প্রয়োজন হবে ১ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বলা হচ্ছে এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াটএ কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং বিদ্যুৎ উপদেষ্টা।
ইতিমধ্যে ব্যাপক হারে লোডশেডিং শুরু না হলেও, ধারণা করছি অচিরেই আমরা এটা প্রত্যক্ষ করব। সাধারণত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ধরা হয় সেচ মৌসুম। এবার বোরো মৌসুমে সারাদেশে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উফশী জাতের ৩৯ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর, হাইব্রিড ৮ লাখ হেক্টর এবং বাকি ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের ধান চাষ করা হবে। সুতরাং শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি যে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। ধার ভরসা ওই কয়লা। কেননা গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ধীরে ধীরে কমে আসবে। বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে (কয়লাভিত্তিক) ভারতের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
চট্টগ্রাম ও খুলনায় কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি)-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। এতে ব্যয় হবে বাংলাদেশী মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমদানি করা কয়লা দিয়ে এ কেন্দ্র দুটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। অথচ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫টি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সক্ষম। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় ৬টি কয়লা স্তর (১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরে) পাওয়া গেছে, যার মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লাখনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ভূপৃষ্ঠ হতে ৬৪০ মিটার থেকে ১ হাজার ১৫৮ মিটার গভীরতায় ৭টি কয়লা স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১ হাজার ৫৩ মিলিয়ন টন। এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুদের উন্নয়নের কাজ আরম্ভ হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লাখনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে কয়লা মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন (বাংলাদেশ)। খনির মেয়াদকালের মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ীর কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনিতে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এ কয়লাখনির দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ ৩ কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এ খনিটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫-২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত।
এসব কয়লাখনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে- আর তা হচ্ছে কয়লা আমরা তুলব কীভাবে? ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতির প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এ পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে প্রচুর মানুষ বাস করেন। সমস্যা হচ্ছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেকে জমি হারাবেন। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষি জমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে ২ হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসিত করতে হবে। এ কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এখানে ১ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প চালু হলে প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন। এশিয়া এনার্জির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, তা এখনও দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে।
তারা কয়লানীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছে। আগামীতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত- এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে করে ভারতের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এ কয়লা আমদানির ওপর তা কোন প্রভাব ফেলবে কিনা, আমরা তা জানি না। বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দুটো সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে, তা তুলে নেবে কিভাবে? চুক্তিটি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। এটা ভালো হয় যদি তা সংসদে উত্থাপন করা হয়। এতে করে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হল। এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এটা জানার সুযোগ পাবেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটোর জন্য যে কয়লার প্রয়োজন, তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কিনা? দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কিনা? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোন ‘তৃতীয় পক্ষ’-এর উপস্থিতি রয়েছে কিনা?
ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি ‘আশার আলো’। কিন্তু যেহেতু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এ চুক্তি যেন আমাদের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে না দাঁড়ায়। একই সঙ্গে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষদের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগিদার তারাও। তাদের পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের ‘হক’ তাদের আছে। এ ‘হক’ থেকে তাদের আমরা বঞ্চিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রায় মানোন্নয়ন করা। দেশে ইতিমধ্যে একটি ‘জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলাটাও জরুরি। তবে এটা ঠিক বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার না করে কেন ভারতীয় কয়লা আমদানি করব- এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে, যেখানে সারাবিশ্বে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৯ শতাংশ কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ, সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১২ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট, তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোন ‘বিকল্প’ নেই। গ্যাস সম্পদ ফুরিয়ে আসছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সেক্ষেত্রে কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এ কয়লা সম্পদকে ব্যবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। আমরা চাই এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চাই। কিন্তু পরনির্ভরশীল হতে চাই না।
পুরোপুরি গরম পড়তে এখনও কিছুটা সময় বাকি। বিদ্যুৎ সংকট রাজনীতিতে উষ্ণতা ছড়াবে। এমনিতে বছরের শুরুতেই হরতাল দিয়ে ‘রাজনীতির যাত্রা’ শুরু হয়েছে। বিরোধী দল ইস্যু খুঁজছে। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ বন্ধ হয়েছে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিদ্যুতের ঘাটতি যখন বাড়বে, লোডশেডিং যখন নিত্যদিনের ব্যাপারে পরিণত হবে, বিরোধী দল এটাকে ইস্যু করবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই ‘লোড ম্যানেজমেন্ট’-এর বিষয়টি বেশ জরুরি। বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার জন্য সচিবালয়ে এসি ব্যবহার না করা, মন্ত্রিপাড়ায়ও লোডশেডিং করা জরুরি। মোদ্দাকথা যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তার সদ্ব্যবহার যেন আমরা করতে পারি। বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবেই। এটা মেনে নিয়েই গ্রীষ্মে একটি সুষ্ঠু ‘লোড ম্যানেজমেন্ট’ আমাদের দরকার।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
ইতিমধ্যে ব্যাপক হারে লোডশেডিং শুরু না হলেও, ধারণা করছি অচিরেই আমরা এটা প্রত্যক্ষ করব। সাধারণত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ধরা হয় সেচ মৌসুম। এবার বোরো মৌসুমে সারাদেশে ৪৮ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উফশী জাতের ৩৯ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর, হাইব্রিড ৮ লাখ হেক্টর এবং বাকি ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের ধান চাষ করা হবে। সুতরাং শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি যে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। ধার ভরসা ওই কয়লা। কেননা গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ধীরে ধীরে কমে আসবে। বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে (কয়লাভিত্তিক) ভারতের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
চট্টগ্রাম ও খুলনায় কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি)-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। এতে ব্যয় হবে বাংলাদেশী মুদ্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আমদানি করা কয়লা দিয়ে এ কেন্দ্র দুটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। অথচ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫টি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সক্ষম। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় ৬টি কয়লা স্তর (১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরে) পাওয়া গেছে, যার মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লাখনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে ভূপৃষ্ঠ হতে ৬৪০ মিটার থেকে ১ হাজার ১৫৮ মিটার গভীরতায় ৭টি কয়লা স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে। কয়লা এলাকার বিস্তৃতি প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার এবং মোট আনুমানিক মজুদের পরিমাণ ১ হাজার ৫৩ মিলিয়ন টন। এখানে কয়লা স্তরের গভীরতা বেশি হওয়ায় তা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক হবে কিনা, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ফলে এ মজুদের উন্নয়নের কাজ আরম্ভ হয়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কয়লাখনি বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখানে কয়লা মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা এশিয়া এনার্জি কর্পোরেশন (বাংলাদেশ)। খনির মেয়াদকালের মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। ফুলবাড়ীর কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলার কথা, যা ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ খনিতে বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১৫ মিলিয়ন টন। এ কয়লাখনির দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণে) এবং প্রস্থ ৩ কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিমে)। এ খনিটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫-২৭০ মিটার গভীরে অবস্থিত।
এসব কয়লাখনি নিয়ে আমাদের দেশে একটি বড় বিতর্ক চলছে- আর তা হচ্ছে কয়লা আমরা তুলব কীভাবে? ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে, নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে? উন্মুক্ত পদ্ধতির প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এ পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড বা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তুললে তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ। এতে ঝুঁকিও বেশি। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। অল্প জমিতে প্রচুর মানুষ বাস করেন। সমস্যা হচ্ছে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তুলতে হলে অনেকে জমি হারাবেন। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে, এর প্রায় ৮০ শতাংশই কৃষি জমি। প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে প্রকল্পকালে ২ হাজার ৩০০ আদিবাসীসহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসিত করতে হবে। এ কাজটি ১০ বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এখানে ১ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প চালু হলে প্রতিবছর জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ সংযোজন হতে পারে। প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপিতে অবদান রাখবে প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ফুলবাড়ীর জনগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিরোধিতা করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন। এশিয়া এনার্জির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল, তারও বিরোধিতা করছে একটি জাতীয় কমিটি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, তা এখনও দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে।
তারা কয়লানীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছে। আগামীতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত- এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে করে ভারতের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে, তাহলে এ কয়লা আমদানির ওপর তা কোন প্রভাব ফেলবে কিনা, আমরা তা জানি না। বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দুটো সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে, তা তুলে নেবে কিভাবে? চুক্তিটি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। এটা ভালো হয় যদি তা সংসদে উত্থাপন করা হয়। এতে করে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হল। এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এটা জানার সুযোগ পাবেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটোর জন্য যে কয়লার প্রয়োজন, তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কিনা? দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কিনা? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোন ‘তৃতীয় পক্ষ’-এর উপস্থিতি রয়েছে কিনা?
ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি ‘আশার আলো’। কিন্তু যেহেতু দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এ চুক্তি যেন আমাদের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে না দাঁড়ায়। একই সঙ্গে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষদের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগিদার তারাও। তাদের পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের ‘হক’ তাদের আছে। এ ‘হক’ থেকে তাদের আমরা বঞ্চিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রায় মানোন্নয়ন করা। দেশে ইতিমধ্যে একটি ‘জাতীয় কমিটি’ গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলাটাও জরুরি। তবে এটা ঠিক বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার না করে কেন ভারতীয় কয়লা আমদানি করব- এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে, যেখানে সারাবিশ্বে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৯ শতাংশ কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ, সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১২ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার মেগাওয়াট, আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট, তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোন ‘বিকল্প’ নেই। গ্যাস সম্পদ ফুরিয়ে আসছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সেক্ষেত্রে কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এ কয়লা সম্পদকে ব্যবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। আমরা চাই এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চাই। কিন্তু পরনির্ভরশীল হতে চাই না।
পুরোপুরি গরম পড়তে এখনও কিছুটা সময় বাকি। বিদ্যুৎ সংকট রাজনীতিতে উষ্ণতা ছড়াবে। এমনিতে বছরের শুরুতেই হরতাল দিয়ে ‘রাজনীতির যাত্রা’ শুরু হয়েছে। বিরোধী দল ইস্যু খুঁজছে। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ বন্ধ হয়েছে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিদ্যুতের ঘাটতি যখন বাড়বে, লোডশেডিং যখন নিত্যদিনের ব্যাপারে পরিণত হবে, বিরোধী দল এটাকে ইস্যু করবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই ‘লোড ম্যানেজমেন্ট’-এর বিষয়টি বেশ জরুরি। বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার জন্য সচিবালয়ে এসি ব্যবহার না করা, মন্ত্রিপাড়ায়ও লোডশেডিং করা জরুরি। মোদ্দাকথা যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তার সদ্ব্যবহার যেন আমরা করতে পারি। বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবেই। এটা মেনে নিয়েই গ্রীষ্মে একটি সুষ্ঠু ‘লোড ম্যানেজমেন্ট’ আমাদের দরকার।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment