বাংলাদেশ চল্লিশ বছরে পা দিয়েছে, স্বাধীনতা ঘোষণার চল্লিশ বছর। সময়টা একেবারে কম নয়। কিন্তু আমরা কি এমন বাংলাদেশকে চেয়েছিলাম? চৌধুরী আলম, ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার নিখোঁজ ১০ মাস ধরে। তাঁর খবর আমরা জানি না। গত ১০ এপ্রিল নিখোঁজ হয়েছিলেন মুফতি আমিনীর ছেলে মাওলানা হাসানাত! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বললেন, তারা মাওলানা হাসানাতকে অপহরণ করেননি। তাকে পাওয়া গেল ১১ দিন পর চোখ বাঁধা অবস্থায়। কে তাকে অপহরণ করেছিল? কেনই বা পুলিশ চৌধুরী আলম কিংবা মাওলানা হাসানাতের অপহরণকারীর খোঁজ বের করতে পারবে না? গত ২০ এপ্রিল সংবাদপত্র যারা পাঠ করেছেন, তারা দেখেছেন একটি ছবি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে চ্যাংদোলা করে ৮ জন পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালে জনাব চৌধুরী বললেন, তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী। তার সঙ্গে এ কেমন আচরণ? এটা কি কোনো সভ্য দেশের চিত্র? অপরাধ যদি কেউ করে থাকে, তার শাস্তি অবশ্যই হবে। কিন্তু মাওলানা হাসানাত কি কোনো অপরাধ করেছিলেন? সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, তিনি ১৯৭১ সালে বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কোনো অপরাধ করেননি। কোর্ট এটা দেখবে। কিন্তু তাই বলে তার মতো একজন জনপ্রতিনিধিকে চ্যাংদোলা করে, অসুস্থ শরীরে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়া হবে? কোনো সভ্য দেশে কি এটা সম্ভব?
আমরা বারবার সাংবিধানিক গুরুত্বের দোহাই দিই। কোনো অসাংবিধানিক শক্তি যাতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে না পারে, সংবিধান সংশোধন কমিটির নেতারা সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংবিধান এখন ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে ফেরত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ মুহূর্তে দেশ কোন সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত নই। একটি খসড়া সংবিধান নিয়ে সংবিধানের জন্য গঠিত সংশোধন কমিটি কাজ করছে। তারপরও ধরে নেই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিগুলো যা ছিল, তাই থেকে যাবে। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে (এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে)।’ এখন এই ধারাটি যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে কি বলা যায় চৌধুরী আলম, মাওলানা হাসানাত কিংবা ছাত্র লিমন পঙ্গু হয়ে যে আজীবন বেঁচে থাকবে—তাদের ‘মৌলিক মানবাধিকার’ নিশ্চিত হয়েছে? চৌধুরী আলম কিংবা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দু’জনই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। যেখানে প্রশাসনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে তাদের প্রতি এই অমানবিক আচরণের ব্যাখ্যা কী! এখানে কি সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে না? সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬(১) ধারায় বলা আছে ‘এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ এখানেও প্রশ্ন এসে যায় সংবিধানের ২৬(১) ধারার পরিপন্থী আইন তো আছে, যে আইন দ্বারা বিরোধীপক্ষকে দমন করা হচ্ছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে অসুস্থ শরীর নিয়ে যখন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, যখন তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, তার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে, তখন সংবিধানের ২৭ ধারাও লঙ্ঘিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ১০ মাস ধরে আমরা জানি না চৌধুরী আলম বেঁচে আছেন কি না। তিনি আইনের ‘সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ এই সুবিধাটুকু পাননি। তার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১নং ধারাও (আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার) লঙ্ঘিত হয়েছে। সংবিধানের ৩৫(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ক্ষেত্রে তো এই ধারা লঙ্ঘন করে তাঁকে অত্যাচার করা হয়েছে। মাওলানা হাসানাতকে যখন সাদা পোশাকধারীরা প্রকাশ্যে রাস্তা থেকে তুলে নেয়, তখনও সংবিধানের ৩৬নং ধারা লঙ্ঘিত হয়, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সে প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি।
আমরা ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এ নিয়ে তোড়জোড়ও কম নয়। অথচ ওই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে প্রস্তাবনার বক্তব্যের মিল কতটুকু? আইনের শাসন ও মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে তো মানবাধিকার সংস্থাগুলোই প্রশ্ন তুলছে এখন। এইচএসসির ছাত্র ঝালকাঠির রাজাপুরের লিমন র্যাবের গুলিতে আহত হয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। লিমনের মা মামলা করলেও ১৬ দিন পর তা নথিভুক্ত হয়েছে। এ নিয়ে ৫টি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দোষীরা আদৌ শাস্তি পাবে, তা নিশ্চিত হতে পারছি না। একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন মহাজোটের শরিক দলের একজন এমপি। এর বিরোধিতা করেছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। লিমনের ঘটনায় স্বয়ং র্যাবপ্রধান স্বীকার করেছেন, লিমন সন্ত্রাসী ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘উপরের নির্দেশে’ শেষ পর্যন্ত লিমনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। র্যাবের নামে এই যে অত্যাচার, অপহরণ তা খোদ সংগঠনটিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত করেছে। র্যাবের অনেক ভালো কাজ আছে। সন্ত্রাস দমনে র্যাবের প্রয়োজনীয়তা—এটাও নিশ্চয়ই আমরা অস্বীকার করব না। কিন্তু লিমনের মতো একজন সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের সন্তান যখন চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে যায় ‘একটি ভুলের কারণে’, তার মাসুল কে দেবে? আমরা তো এ জন্য এই দেশটি স্বাধীন করিনি। আমাদের পূর্বসূরিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন তার এক লেখায় ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চেয়েছিলেন। আজ এত বছর পর অসুস্থ নির্মল সেনের ওই কথা ধরেই বলতে ইচ্ছে করছে ‘আমি বেঁচে থাকার স্বাভাবিক গ্যারান্টি চাই’। র্যাব এখন এক ভয়ংকর সংগঠনের নাম। একটা দেশে এ ধরনের সংগঠন থাকলে বহির্বিশ্বে ওই দেশটির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। আফ্রিকার আইভরিকোস্টে শেষ পর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান গবাগো গ্রেফতার হয়েছেন। সেখানে তিনি একটি ‘ব্যক্তিগত বাহিনী’ গঠন করেছিলেন, যারা আজ মানবতার অপরাধে অপরাধী। আরব বিশ্বের ইয়েমেন ও সিরিয়াতে ‘বালতাগি’রা (baltagi) অত্যন্ত ক্ষমতাবান। এরা গুণ্ডা, আইন মানে না এবং সরকারের সমর্থক। সিরিয়াতে দেখা গেছে—এসব ‘বালতাগি’ এসেছে অষধরুিবধহ গ্রোত থেকে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এই গোত্রের লোক। ইয়েমেনেও এই ‘বালতাগি’রা প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহর গ্রোত্র থেকে এসেছে। রুয়ান্ডা ও বরুন্ডিতে যে গণহত্যা হয়েছিল, তাতে বিশেষ এক গোত্রের লোক অংশ নিয়েছিল। এদের আজ হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হচ্ছে। র্যাবকে নিয়ে তাই আমার অনেক চিন্তা। এদের অনেক ভালো কাজ, তাদের অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে শুধু ‘লিমনের মতো’ ঘটনার কারণে। র্যাবের কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্বের দরবারে আমরা অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমি এ জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেইনি। র্যাবের যে সদস্য এ অপরাধটি করেছে, তার বিচার হোক। লিমনকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক। আমার বিশ্বাস র্যাব যদি এ কাজটি করে, তাহলে সংস্থাটি আস্থা ফিরে পাবে।
সংবিধান সংশোধন হচ্ছে। একটি সংবিধান সংশোধিত হতেই পারে। সব দেশেই হয়। কিন্তু কোনো সরকারই এককভাবে তা করে না। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই সংবিধানটি সংশোধিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তাতে তো তা একদলীয় হয়ে পড়ছে। যদি সর্বশেষ জনমতের পরিসংখ্যান আমরা নেই, তাহলে আমরা দেখব প্রদত্ত ভোটের ৩২.৪৫ ভাগ পেয়েছে বিএনপি (আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮.০৬ ভাগ)। আর জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে ৪.৬০ ভাগ। এখন ৩২ দশমিক ৪৫ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দলটির সংবিধান সংশোধনীতে যদি কোনো ভূমিকা বা বক্তব্য না থাকে, তাহলে সেই সংশোধিত সংবিধান কি গ্রহণযোগ্য হবে? না, অবশ্যই হবে না। সংবিধান সংশোধন কমিটি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিল, তারা জামায়াতকে মতবিনিময় সভায় ডাকবে না এবং ডাকেওনি। তাহলে এই সিদ্ধান্ত কী ৪ দশমিক ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হলো না? যুদ্ধাপরাধীর বিচার সবাই চায়, যদি তা নিরপেক্ষ হয়। কিন্তু জোর করে কাউকে কাউকে যুদ্ধাপরাধী বানানো কি ঠিক?
আমরা চল্লিশ বছর পার করেছি। জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। দরিদ্রতা বেড়েছে। বেড়েছে ভূমিহীনদের সংখ্যা। এক সময় প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের পাঠানো অর্থ ছিল আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উত্স। আজ তাতে ভাটা পড়ছে। আমাদের সামনে অনেক সমস্যা। জ্বালানি সঙ্কট, খাদ্যাভাব ও বেকার সমস্যা আমাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে (বারবার ব্যয় বৃদ্ধি ঘটিয়ে) আমাদের পদ্মা সেতু দরকার, নাকি বিদ্যুত্ দরকার—এটা ভেবে দেখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় বিবেচনায় প্রভাষকদের নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো যাবে, নাকি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে আমরা নিয়োগ দেব—এটা ভেবে দেখতে হবে। এককভাবে আমরা দেশ পরিচালনা করব, নাকি সবার মতামত নিয়ে সংসদকে শক্তিশালী করে আমরা দেশ পরিচালনা করব—এটাও ভাবনার বিষয়। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য সংসদকে অকার্যকর করেছে। সংসদে সরকারি দলের এমপিরা বলছেন, আর তাদের এমপিরাই তা শুনছেন। সরকারের সমালোচনা করছেন না কেউ। এর নাম আর যাই হোক, সংসদীয় রাজনীতি নয়। অনেকটা সময় আমরা পার করেছি। যে রাজনীতি পরস্পর পরস্পরকে ‘শত্রু’ মনে করে, যে রাজনীতি বিদ্বেষের জন্ম দেয়, সে রাজনীতি আমরা চাই না। এ জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
আমরা বারবার সাংবিধানিক গুরুত্বের দোহাই দিই। কোনো অসাংবিধানিক শক্তি যাতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে না পারে, সংবিধান সংশোধন কমিটির নেতারা সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করে সংবিধান এখন ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে ফেরত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ মুহূর্তে দেশ কোন সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত নই। একটি খসড়া সংবিধান নিয়ে সংবিধানের জন্য গঠিত সংশোধন কমিটি কাজ করছে। তারপরও ধরে নেই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিগুলো যা ছিল, তাই থেকে যাবে। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে (এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে)।’ এখন এই ধারাটি যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে কি বলা যায় চৌধুরী আলম, মাওলানা হাসানাত কিংবা ছাত্র লিমন পঙ্গু হয়ে যে আজীবন বেঁচে থাকবে—তাদের ‘মৌলিক মানবাধিকার’ নিশ্চিত হয়েছে? চৌধুরী আলম কিংবা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী দু’জনই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। যেখানে প্রশাসনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে তাদের প্রতি এই অমানবিক আচরণের ব্যাখ্যা কী! এখানে কি সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে না? সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬(১) ধারায় বলা আছে ‘এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ এখানেও প্রশ্ন এসে যায় সংবিধানের ২৬(১) ধারার পরিপন্থী আইন তো আছে, যে আইন দ্বারা বিরোধীপক্ষকে দমন করা হচ্ছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে অসুস্থ শরীর নিয়ে যখন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, যখন তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, তার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে, তখন সংবিধানের ২৭ ধারাও লঙ্ঘিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ১০ মাস ধরে আমরা জানি না চৌধুরী আলম বেঁচে আছেন কি না। তিনি আইনের ‘সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’ এই সুবিধাটুকু পাননি। তার ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১নং ধারাও (আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার) লঙ্ঘিত হয়েছে। সংবিধানের ৩৫(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ কিন্তু সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ক্ষেত্রে তো এই ধারা লঙ্ঘন করে তাঁকে অত্যাচার করা হয়েছে। মাওলানা হাসানাতকে যখন সাদা পোশাকধারীরা প্রকাশ্যে রাস্তা থেকে তুলে নেয়, তখনও সংবিধানের ৩৬নং ধারা লঙ্ঘিত হয়, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সে প্রশ্নের মীমাংসা আজও হয়নি।
আমরা ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চাই। এ নিয়ে তোড়জোড়ও কম নয়। অথচ ওই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে প্রস্তাবনার বক্তব্যের মিল কতটুকু? আইনের শাসন ও মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে তো মানবাধিকার সংস্থাগুলোই প্রশ্ন তুলছে এখন। এইচএসসির ছাত্র ঝালকাঠির রাজাপুরের লিমন র্যাবের গুলিতে আহত হয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। লিমনের মা মামলা করলেও ১৬ দিন পর তা নথিভুক্ত হয়েছে। এ নিয়ে ৫টি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দোষীরা আদৌ শাস্তি পাবে, তা নিশ্চিত হতে পারছি না। একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন মহাজোটের শরিক দলের একজন এমপি। এর বিরোধিতা করেছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। লিমনের ঘটনায় স্বয়ং র্যাবপ্রধান স্বীকার করেছেন, লিমন সন্ত্রাসী ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘উপরের নির্দেশে’ শেষ পর্যন্ত লিমনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। র্যাবের নামে এই যে অত্যাচার, অপহরণ তা খোদ সংগঠনটিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত করেছে। র্যাবের অনেক ভালো কাজ আছে। সন্ত্রাস দমনে র্যাবের প্রয়োজনীয়তা—এটাও নিশ্চয়ই আমরা অস্বীকার করব না। কিন্তু লিমনের মতো একজন সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের সন্তান যখন চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে যায় ‘একটি ভুলের কারণে’, তার মাসুল কে দেবে? আমরা তো এ জন্য এই দেশটি স্বাধীন করিনি। আমাদের পূর্বসূরিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশের। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন তার এক লেখায় ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চেয়েছিলেন। আজ এত বছর পর অসুস্থ নির্মল সেনের ওই কথা ধরেই বলতে ইচ্ছে করছে ‘আমি বেঁচে থাকার স্বাভাবিক গ্যারান্টি চাই’। র্যাব এখন এক ভয়ংকর সংগঠনের নাম। একটা দেশে এ ধরনের সংগঠন থাকলে বহির্বিশ্বে ওই দেশটির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। আফ্রিকার আইভরিকোস্টে শেষ পর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান গবাগো গ্রেফতার হয়েছেন। সেখানে তিনি একটি ‘ব্যক্তিগত বাহিনী’ গঠন করেছিলেন, যারা আজ মানবতার অপরাধে অপরাধী। আরব বিশ্বের ইয়েমেন ও সিরিয়াতে ‘বালতাগি’রা (baltagi) অত্যন্ত ক্ষমতাবান। এরা গুণ্ডা, আইন মানে না এবং সরকারের সমর্থক। সিরিয়াতে দেখা গেছে—এসব ‘বালতাগি’ এসেছে অষধরুিবধহ গ্রোত থেকে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এই গোত্রের লোক। ইয়েমেনেও এই ‘বালতাগি’রা প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহর গ্রোত্র থেকে এসেছে। রুয়ান্ডা ও বরুন্ডিতে যে গণহত্যা হয়েছিল, তাতে বিশেষ এক গোত্রের লোক অংশ নিয়েছিল। এদের আজ হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হচ্ছে। র্যাবকে নিয়ে তাই আমার অনেক চিন্তা। এদের অনেক ভালো কাজ, তাদের অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে শুধু ‘লিমনের মতো’ ঘটনার কারণে। র্যাবের কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্বের দরবারে আমরা অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। আমি এ জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেইনি। র্যাবের যে সদস্য এ অপরাধটি করেছে, তার বিচার হোক। লিমনকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক। আমার বিশ্বাস র্যাব যদি এ কাজটি করে, তাহলে সংস্থাটি আস্থা ফিরে পাবে।
সংবিধান সংশোধন হচ্ছে। একটি সংবিধান সংশোধিত হতেই পারে। সব দেশেই হয়। কিন্তু কোনো সরকারই এককভাবে তা করে না। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই সংবিধানটি সংশোধিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তাতে তো তা একদলীয় হয়ে পড়ছে। যদি সর্বশেষ জনমতের পরিসংখ্যান আমরা নেই, তাহলে আমরা দেখব প্রদত্ত ভোটের ৩২.৪৫ ভাগ পেয়েছে বিএনপি (আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৪৮.০৬ ভাগ)। আর জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে ৪.৬০ ভাগ। এখন ৩২ দশমিক ৪৫ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দলটির সংবিধান সংশোধনীতে যদি কোনো ভূমিকা বা বক্তব্য না থাকে, তাহলে সেই সংশোধিত সংবিধান কি গ্রহণযোগ্য হবে? না, অবশ্যই হবে না। সংবিধান সংশোধন কমিটি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিল, তারা জামায়াতকে মতবিনিময় সভায় ডাকবে না এবং ডাকেওনি। তাহলে এই সিদ্ধান্ত কী ৪ দশমিক ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হলো না? যুদ্ধাপরাধীর বিচার সবাই চায়, যদি তা নিরপেক্ষ হয়। কিন্তু জোর করে কাউকে কাউকে যুদ্ধাপরাধী বানানো কি ঠিক?
আমরা চল্লিশ বছর পার করেছি। জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। দরিদ্রতা বেড়েছে। বেড়েছে ভূমিহীনদের সংখ্যা। এক সময় প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের পাঠানো অর্থ ছিল আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উত্স। আজ তাতে ভাটা পড়ছে। আমাদের সামনে অনেক সমস্যা। জ্বালানি সঙ্কট, খাদ্যাভাব ও বেকার সমস্যা আমাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে (বারবার ব্যয় বৃদ্ধি ঘটিয়ে) আমাদের পদ্মা সেতু দরকার, নাকি বিদ্যুত্ দরকার—এটা ভেবে দেখতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলীয় বিবেচনায় প্রভাষকদের নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো যাবে, নাকি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে আমরা নিয়োগ দেব—এটা ভেবে দেখতে হবে। এককভাবে আমরা দেশ পরিচালনা করব, নাকি সবার মতামত নিয়ে সংসদকে শক্তিশালী করে আমরা দেশ পরিচালনা করব—এটাও ভাবনার বিষয়। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য সংসদকে অকার্যকর করেছে। সংসদে সরকারি দলের এমপিরা বলছেন, আর তাদের এমপিরাই তা শুনছেন। সরকারের সমালোচনা করছেন না কেউ। এর নাম আর যাই হোক, সংসদীয় রাজনীতি নয়। অনেকটা সময় আমরা পার করেছি। যে রাজনীতি পরস্পর পরস্পরকে ‘শত্রু’ মনে করে, যে রাজনীতি বিদ্বেষের জন্ম দেয়, সে রাজনীতি আমরা চাই না। এ জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
[১ মে ২০১১]
0 comments:
Post a Comment