সারা আরব বিশ্বই এখন অশান্ত। গেল জানুয়ারিতে তিউনেসিয়ায় বেকার কম্পিউটার গ্রাজুয়েট মোহাম্মদ বওউকুজিজির আÍহত্যার ঘটনা যে ‘ঢেউ’ সৃষ্টি করেছিল, তার রেশ এখনও আছে। তিউনেসিয়ায় বেন আলীর পতন হয়েছে। মিসরের হোসনি মোবারক এখন অন্তরীণ। লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। বাহরাইনে সৌদি সেনাবাহিনী প্রবেশ করে সংখ্যালঘু সরকারকে আপাতত টিকিয়ে রেখেছে বটে, কিন্তু অসন্তোষ সেখানে আছে। এই অসন্তোষ আছে ইয়েমেনে, আলজেরিয়ায়, সিরিয়ায় কিংবা জর্ডানেও। সারা আরব বিশ্বে হঠাৎ করে গণবিােভের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই গণবিােভকে সংগঠিত করছে তরুণ সমাজ, যারা ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে একের পর এক পরিবর্তন ডেকে আনছে আরব বিশ্বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ‘প্রাগ-বসন্তের’ কথা জানেন। জানেন ‘ভেলভেট বিপ্লব’-এর কথাও। ১৯৬৮ সালের ‘প্রাগ-বসন্ত’ সাবেক চেকোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্যোগ (ডুবচেকের নেতৃত্বে) ব্যর্থ করে দিয়েছিল। সেদিন সোভিয়েত ট্যাংক চেকোস্লাভিয়ার রাজধানী প্রাগে নেমেছিল। এর পর ১৯৮৯, সেই চেকোস্লাভাকিয়াতেই নাট্যকার ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল পূর্ব ইউরোপের প্রতিটি রাষ্ট্রে। একে একে পতন ঘটেছিল পূর্ব ইউরোপের প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক সরকারের, ইতিহাসে যা চিহ্নিত হয়ে আছে ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’ হিসেবে। এই ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’ একটি বড় পরিবর্তন এনেছিল পূর্ব ইউরোপে। সেখানে সমাজতন্ত্রের বদলে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র চালু হয়েছে। এর ঠিক ২২ বছর পর সারা আরব বিশ্বে শুরু হয়েছে পালাবদল। আরব লীগভুক্ত ২২টি দেশে কোথাও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র নেই। সেখানে রয়েছে একনায়কতান্ত্রিক শাসন। গণতন্ত্রসূচকে এ দেশগুলোর অবস্থান অনেক নিচে। (যেমন ১৬৭টি দেশের মাঝে লিবিয়ার অবস্থান ১৫৮, সুদানের ১৫১, সিরিয়ার ১৫৩, ইয়েমেনের ১৪৬)। দুর্নীতিতেও এরা সেরা (১৭৮টি দেশের মাঝে মিসরের অবস্থান ১৩৮, লিবিয়ার ১৪৬, আলজেরিয়ার ১০৫, ইরাকের ১৭৫ ও মৌরিতানিয়ার ১৪৩)। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই এসব দেশে। ১৯৬টি দেশের মাঝে ইয়েমেনের অবস্থান ১৭৩, তিউনেসিয়ার ১৮৬, সিরিয়ার ১৭৮, সুদানের ১৬৫ ও লিবিয়ার ১৯৩। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পরিবর্তনটা কেন প্রয়োজন ছিল আরব বিশ্বে? ‘প্রাগ বসন্ত’ চেকেস্লোভাকিয়ার সমাজব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি বটে, কিন্তু পরিবর্তন এসেছিল ‘ভেলভেট রেভ্যুলেশন’-এর মধ্য দিয়ে। আজ আরব বিশ্বও সেই পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। ইতিমধ্যে ‘জেসমিন বিপ্লব’ ও ‘রেভ্যুলেশন ২.০’ তিউনেসিয়া ও মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছে। ইতিহাসের এটাই অনিবার্যতা। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ঐতিহাসিক জ্যাকব বুরচার্ডের মতে, ইতিহাসের শিা হচ্ছে, কোন শক্তি যখন উন্নয়ন বা নতুন সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সে শক্তির পতন অনিবার্য। আরব বিশ্বে এমনটিই হয়েছে। শাসকচক্র সেখানে যুগের সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তরুণ সমাজ ছিল বেকার। এদের জন্য কর্মসংস্থান করা যায়নি। সারা আরব বিশ্বে ২৫ বছরের নিচে যে জনগোষ্ঠী তা মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক (মিসরে ৫২.৩ ভাগ, সিরিয়ায় ৫৫.৩ ভাগ, ইয়েমেনে ৬৫.৪ ভাগ, তিউনেসিয়ায় ৪২.১ ভাগ, লিবিয়ায় ৪৭.৪ ভাগ)। এই জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান করা যায়নি। এরাই আজ ‘আরব বসন্ত’-এর নেতৃত্ব দিচ্ছে, এই আরব বিপ্লব আমাদের জন্য অনেক চিন্তার কারণ।
এক. আরব বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তরুণ সমাজ, যাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এদের একটা বড় অংশ বেকার। পরিকল্পনাহীনভাবে আমরা গ্রাজুয়েট তৈরি করছি। কিন্তু চাকরির সংস্থান করতে পারছি না। ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সঙ্গে আরও দুটো মেরিটাইম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আমরা প্রতিষ্ঠাকরেছি। হাজার হাজার মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরোচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোচ্ছে লাখ লাখ। এ সমাজে আমাদের এত মাস্টার্স ডিগ্রিধারীর প্রয়োজন নেই। শিাব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত তারা বিষয়টি চিন্তা করেন না। উচ্চশিা সীমিত হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বাজার উপযোগী শিাব্যবস্থা। সেদিকে না গিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য আমাদের সন্তানদের আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি। এরা পাস করে সমাজের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেকার থাকছে। এরা যে কোন সরকারের জন্যই একটি ‘থ্রেট’, যেমনটি আমরা আরব বিশ্বে ল্য করি।
দুই. এই তরুণ সমাজকে প্রশিণ দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থান করা যায়। এ জন্য দরকার সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। আমলা নির্ভর আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, তাতে আমলারা ‘বাজার অনুসন্ধান’ এ বিদেশে সফরে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু সেই ‘বাজার’ আজও সৃষ্টি হয়নি। লিবিয়া থেকে হাজার হাজার কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। সরকার প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। এটা নিয়েও কথা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ৫০ হাজার টাকা কোন সমাধান নয়। এদের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। -এ জন্য দরকার বড় বিনিয়োগ।
তিন. অর্থনীতি কোন আশার কথা বলে না। মুখ থুবড়ে পড়ছে অর্থনীতি (যুগান্তর, ৬ এপ্রিল)। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে অস্থিরতা আর বৈশ্বিক প্রোপট এ অস্থিরতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতির এ নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের আশংকাÑ সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি, তারল্য সংকট, বিনিয়োগে বেহাল অবস্থা, প্রকট অবকাঠামো সমস্যা, নাজুক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, দুর্নীতির উচ্চমাত্রা আর চাঁদাবাজির কারণে অধোগতিতে চলবে অর্থনীতির ধারা (ওই)। অর্থনীতির এই অবস্থা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে।
চার. শেয়ারবাজার কেলেংকারি নিয়ে সরকার একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সঙ্গে তারা অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেছে। এই রিপোর্টটি আদৌ কোনদিন প্রকাশিত হবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি রুলও ইস্যু হয়েছে। এই শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হয়েছে, তা আর বলার অপো রাখে না। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে শেয়ারের সূচক যখন ৬০০ পয়েন্ট নিচে নেমে গিয়েছিল, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না যে একটি শক্তিশালী অসাধু চক্র এর সঙ্গে জড়িত। সরকার কি তার দায় এড়াতে পারে? ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে শেয়ার মার্কেটে। এদের অসন্তোষ সরকারের জন্য কোন শুভ সংবাদ নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন মতায়, তখনও শেয়ারবাজার কেলেংকারি হয়েছিল। তখন তদন্ত কমিটি ৩৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু তাদের একজনেরও বিচার হয়নি। ২০১১ সালেও তদন্ত কমিটি কিছু দোষী ব্যক্তিকে কারসাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কী! না হলে অসন্তোষ বাড়বেই।
পাঁচ. উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেেিত সরকার সংবিধান পরিবর্তনের ল্েয একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকলেও, বিএনপি তাতে অংশ নেয়নি। জাতীয় কমিটি বিএনপির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখানেও সেই ‘বিরোধ’ রয়ে গেল। সংবিধান একটি জাতির, এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়। এখানে বিশেষ করে এ ধরনের জাতীয় প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের ন্যূনতম ঐকমত্য প্রয়োজন। চল্লিশ বছরে পা দিয়েও আমাদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করল জাতি হিসেবে আমরা আজও বিভক্ত। বর্তমান প্রোপটে সরকার যদি একক উদ্যোগে সংবিধান সংশোধন করে, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়াবে মাত্র।
ছয়. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের জন্য একটি ‘গলার কাঁটা’। বিশ্বব্যাপীই খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি অসাধু চক্র, যারা উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের (চাল, তেল, চিনি, আটা) মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘হুমকিও’ এখানে ব্যর্থ। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চমূল্য সরকারের জন্য বড় হুমকি।
সাত. অর্থনীতির মন্দার কারণে কৃচ্ছ্রসাধন যেখানে জরুরি, সেখানে সরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটছে। চাকরির েেত্র (এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও) ‘প্রায়োরিটি’ পাচ্ছে সরকারি দলের লোকেরা। পদ্মা সেতু নির্মাণ এখন ঝুঁকির মুখে। বিদ্যুৎ যেখানে ‘প্রায়োরিটি’, সেখানে অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সর্বশেষ একটি প্রকল্পে দেশ নিররমুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ছাত্রলীগকে (কালের কণ্ঠ, ২১ এপ্রিল), যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আলোকে দেশে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।
বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক সুবিধাভুগিতা, রাজনৈতিকভাবে একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা আরব বিশ্বে ‘বিপ্লবের’ জš§ দিয়েছে, ‘আরব বসন্ত’-এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। ‘আরব বসন্ত’ থেকে শিা নেয়ার আছে অনেক কিছু। আমরা এ থেকে আদৌ কোন শিা নেব কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
এক. আরব বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তরুণ সমাজ, যাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এদের একটা বড় অংশ বেকার। পরিকল্পনাহীনভাবে আমরা গ্রাজুয়েট তৈরি করছি। কিন্তু চাকরির সংস্থান করতে পারছি না। ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সঙ্গে আরও দুটো মেরিটাইম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আমরা প্রতিষ্ঠাকরেছি। হাজার হাজার মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরোচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোচ্ছে লাখ লাখ। এ সমাজে আমাদের এত মাস্টার্স ডিগ্রিধারীর প্রয়োজন নেই। শিাব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত তারা বিষয়টি চিন্তা করেন না। উচ্চশিা সীমিত হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বাজার উপযোগী শিাব্যবস্থা। সেদিকে না গিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য আমাদের সন্তানদের আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি। এরা পাস করে সমাজের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেকার থাকছে। এরা যে কোন সরকারের জন্যই একটি ‘থ্রেট’, যেমনটি আমরা আরব বিশ্বে ল্য করি।
দুই. এই তরুণ সমাজকে প্রশিণ দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থান করা যায়। এ জন্য দরকার সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। আমলা নির্ভর আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, তাতে আমলারা ‘বাজার অনুসন্ধান’ এ বিদেশে সফরে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু সেই ‘বাজার’ আজও সৃষ্টি হয়নি। লিবিয়া থেকে হাজার হাজার কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। সরকার প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। এটা নিয়েও কথা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ৫০ হাজার টাকা কোন সমাধান নয়। এদের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। -এ জন্য দরকার বড় বিনিয়োগ।
তিন. অর্থনীতি কোন আশার কথা বলে না। মুখ থুবড়ে পড়ছে অর্থনীতি (যুগান্তর, ৬ এপ্রিল)। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে অস্থিরতা আর বৈশ্বিক প্রোপট এ অস্থিরতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতির এ নাজুক পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের আশংকাÑ সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি, তারল্য সংকট, বিনিয়োগে বেহাল অবস্থা, প্রকট অবকাঠামো সমস্যা, নাজুক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, দুর্নীতির উচ্চমাত্রা আর চাঁদাবাজির কারণে অধোগতিতে চলবে অর্থনীতির ধারা (ওই)। অর্থনীতির এই অবস্থা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে।
চার. শেয়ারবাজার কেলেংকারি নিয়ে সরকার একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে। সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সঙ্গে তারা অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগ দাবি করেছে। এই রিপোর্টটি আদৌ কোনদিন প্রকাশিত হবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি রুলও ইস্যু হয়েছে। এই শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হয়েছে, তা আর বলার অপো রাখে না। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে শেয়ারের সূচক যখন ৬০০ পয়েন্ট নিচে নেমে গিয়েছিল, তখন বুঝতে কারও বাকি থাকে না যে একটি শক্তিশালী অসাধু চক্র এর সঙ্গে জড়িত। সরকার কি তার দায় এড়াতে পারে? ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে শেয়ার মার্কেটে। এদের অসন্তোষ সরকারের জন্য কোন শুভ সংবাদ নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন মতায়, তখনও শেয়ারবাজার কেলেংকারি হয়েছিল। তখন তদন্ত কমিটি ৩৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু তাদের একজনেরও বিচার হয়নি। ২০১১ সালেও তদন্ত কমিটি কিছু দোষী ব্যক্তিকে কারসাজির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু আদৌ বিচার হবে কী! না হলে অসন্তোষ বাড়বেই।
পাঁচ. উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেেিত সরকার সংবিধান পরিবর্তনের ল্েয একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকলেও, বিএনপি তাতে অংশ নেয়নি। জাতীয় কমিটি বিএনপির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখানেও সেই ‘বিরোধ’ রয়ে গেল। সংবিধান একটি জাতির, এটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির নয়। এখানে বিশেষ করে এ ধরনের জাতীয় প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের ন্যূনতম ঐকমত্য প্রয়োজন। চল্লিশ বছরে পা দিয়েও আমাদের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করল জাতি হিসেবে আমরা আজও বিভক্ত। বর্তমান প্রোপটে সরকার যদি একক উদ্যোগে সংবিধান সংশোধন করে, তাহলে তা বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়াবে মাত্র।
ছয়. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের জন্য একটি ‘গলার কাঁটা’। বিশ্বব্যাপীই খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এখানে রয়েছে একটি অসাধু চক্র, যারা উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্যের (চাল, তেল, চিনি, আটা) মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘হুমকিও’ এখানে ব্যর্থ। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চমূল্য সরকারের জন্য বড় হুমকি।
সাত. অর্থনীতির মন্দার কারণে কৃচ্ছ্রসাধন যেখানে জরুরি, সেখানে সরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ঘটছে। চাকরির েেত্র (এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও) ‘প্রায়োরিটি’ পাচ্ছে সরকারি দলের লোকেরা। পদ্মা সেতু নির্মাণ এখন ঝুঁকির মুখে। বিদ্যুৎ যেখানে ‘প্রায়োরিটি’, সেখানে অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সর্বশেষ একটি প্রকল্পে দেশ নিররমুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ছাত্রলীগকে (কালের কণ্ঠ, ২১ এপ্রিল), যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার আলোকে দেশে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।
বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক সুবিধাভুগিতা, রাজনৈতিকভাবে একক কর্তৃত্ব করার প্রবণতা আরব বিশ্বে ‘বিপ্লবের’ জš§ দিয়েছে, ‘আরব বসন্ত’-এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। ‘আরব বসন্ত’ থেকে শিা নেয়ার আছে অনেক কিছু। আমরা এ থেকে আদৌ কোন শিা নেব কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
[দৈনিক যুগান্তর ২৪ এপ্রিল ২০১১]
0 comments:
Post a Comment