পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এখন মমতা ব্যানার্জি। দীর্ঘ বছর ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টকে পরাজিত করে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রীর আসনটি ‘দখল’ করতে সমর্থ হলেও এ থেকে আমাদের উত্ফুল্ল হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। কেননা মমতা কেন্দ্রের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। এখন জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে আছেন। এক সময় বিজেপির সঙ্গেও ছিলেন। কেন্দ্রে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ’র (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) মিত্র ছিলেন মমতা। অনেকদিন থেকেই ক্ষমতার আশপাশে আছেন। আমাদের নেতা-নেত্রীরা যখনই নয়াদিল্লি যান, তখন দু’ব্যক্তির সঙ্গে অবশ্যই তারা দেখা করেন। তাদের একজন প্রণব মুখার্জি, অপরজন মমতা ব্যানার্জি। আমাদের নেতা-নেত্রীদের ধারণা তাদের দু’জনের সঙ্গে দেখা করলে, পদ্মার ইলিশ, মিষ্টি আর সিরামিকের উপহার সামগ্রী নিয়ে গেলে তারা বাংলাদেশের সমস্যার ‘সমাধান’ করে দেবেন।
অতীতে জ্যোতি বসু যত দিন জীবিত ছিলেন, তিনি ছিলেন আমাদের আরেকটা ‘ভরসার স্থান’। কিন্তু বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান কী হয়েছে, আমরা তা সবাই জানি—আমাদের সমস্যা এখানেই। যেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদ অনুসরণ করে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারছি না, সেখানে আমরা ভরসা করছি কখনও জ্যোতি বসুর ওপর, কখনও প্রণব, কখনও মমতার ওপর। কিন্তু আমরা ভুলে যাই তারা রাজনীতি করেন সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। মমতা বা প্রণব বাবু বাংলায় কথা বললেও মূলত এরা ভারতীয়। ভারতের স্বার্থটা আগে। জ্যোতি বসু তো কমিউনিস্ট ছিলেন। আদি বাড়ি বাংলাদেশে। কমিউনিস্টরা সাধারণত নিপীড়িত ও শোষিত মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ায় বলে বলা হয়। কেননা তত্ত্বগতভাবে তারা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু বাংলাদেশের কোন সমস্যাটা সমাধান করে দিয়েছেন জ্যোতি বসু? একটিও নয়। অথচ জ্যোতি বসুর নাম শুনলেই আমরা গদগদ হয়ে গেছি। কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ অমানবিকভাব তার লাশ ঝুলিয়ে রাখল কয়েক ঘণ্টা, সেদিন কি মমতা এর প্রতিবাদ করেছিলেন? তিনি তো তখন কেন্দ্রের মন্ত্রী, ইউপিএ জোটের শরিক। মমতা প্রতিবাদ করেননি। বাংলাদেশের মানুষদের মূল্যবোধের প্রতি সহমর্মিতাও দেখাননি। কারণ তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতি করেন, যেখানে বাংলাদেশকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। বাংলাদেশের স্বার্থ তাই ভারতীয় নেতাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি। যশোরের মেয়ে মমতা। তার জন্ম যশোরে হয়নি বটে, কিন্তু বাবার বাড়ি ছিল যশোরে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় তার পূর্বপুরুষ চলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। তিনি যে ধরনের নেত্রী, তাতে কেন্দ্র সরকার তার কথা শুনতে বাধ্য। কিন্তু বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে মরুময়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুধু ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে, মমতা কি এ ব্যাপারে কোনো দিন কোনো কথা বলেছেন? কেউ কি সে কথা বলে?
নির্বাচনে বিজয়ের পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে ফোন করেছিলেন। এ কথাটা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের কাছ থেকে আমরা শুনিনি। তিনি ব্রিফিংও করেননি। আমরা জানলাম মমতা ব্যানার্জির মুখ থেকে (‘বাংলাদেশ থেকে হাসিনাদির ফোন পেয়েছি’)। প্রধানমন্ত্রী কি এটা করতে পারেন! প্রটোকল কি তাকে অনুমতি দেয়? একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী কী পারেন অন্য কোনো দেশের প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কি জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালসের অতি সম্প্রতি নির্বাচনে বিজয়ী মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন? না, জানাননি। কেননা প্রটোকল অনুযায়ী তিনি তা পারেন না। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী তা করলেন। তারপর শুনুন মমতা কী বলেছেন। মমতার ভাষায় ‘মনে হচ্ছে যেন দুই বাংলা এক হয়ে গেল’ (কালের কন্ঠ, ১৪ মে, পৃ.-১০)। কী ভয়ঙ্কর কথা! ‘দুই বাংলা এক হয়ে গেল’! কী বোঝাতে চাচ্ছেন মমতা? আমাদের প্রধানমন্ত্রী ফোনে শুভেচ্ছা জানাবেন আর ভারতের নেতারা বলবেন ‘দুই বাংলা এক হয়ে গেল’—এটা তো আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি! আমরা তো এ জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম করিনি। এ জন্য তো লাখ লাখ লোক মারা যায়নি।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে আমরা পা দিয়েছি। এই চল্লিশ বছরে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের সঙ্গে আমাদের যত সমস্যা বেড়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের এ সমস্যা নেই। গত ১৬ মে ছিল ফারাক্কা দিবস। পানির ন্যায্য হিস্যা ও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ফারাক্কা মিছিল করেছিলেন মওলানা ভাসানী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেই নয়াদিল্লি ছুটে গিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন (১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে)। কিন্তু যতটুকু পানি আমাদের পাওয়ার কথা সে পানি চুক্তি স্বাক্ষরের পর কোনো দিনই আমরা পাইনি। অথচ ওই চুক্তি নিয়ে কত ‘অর্জনের’ কথা বলা হয়। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও কোনো খবর নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যখন আমরা সোচ্চার, তখন আমাদের সংসদ সদস্যরা ‘প্রমোদ বিহারে’ গেলেন, হেলিকপ্টারে ঘুরলেন, জানালেন তারা কিছুই দেখতে পাননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কথা যখন পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে, তখন মিজোরামের মানুষ ওই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করছে। ভারতীয় নেতারা আমাদের ‘ঘুম পাড়ানির গান শুনিয়ে’ আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু আমরা, বা নেপাল ও ভুটান এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারত থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আমরা ভারতীয় হেভি ট্রাক চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করছি। ওই রাস্তা দিয়ে ভারতীয় হেভি ট্রাক যাবে কোনো ধরনের শুল্ক না দিয়েই। আর আমরা বছরের পর বছর গুনতে থাকব সুদ। বলা হয়েছিল বিদ্যুত্ আসবে ভারত থেকে। কৈ সেই বিদ্যুত্? ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা ভারতে থাকলেও তা নানা ট্যারিফ ও প্যারা-ট্যারিফের কারণে ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। জানা গেছে, আগামী ৩ বছরের জন্য ভারত শুল্কমুক্ত আরও ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২২৪টি পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করার অনুমতি চেয়েছে। অথচ ভারতে বাংলাদেশী ৬১টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশের অনুমতির কথা রয়েছে, যা দীর্ঘসূত্রতার জন্য আটকে আছে। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সিমেন্টের ওপর অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। জানা গেছে, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কথা (দিনকাল, ১৭ মে)। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পোন্নত। এ জন্য বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারত সেই সুবিধা বাংলাদেশকে কখনই দেয়নি। এক্ষেত্রে মমতা বা প্রণব মুখার্জির মতো নেতারা কোনো দিন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াননি। কেননা তারা বাঙালি হয়েও স্বার্থ দেখেছে ভারতের। অথচ আমাদের নেতারা বারবার ভারতীয় ‘বাঙালি বাবুদের’ দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, শুধু ভারতের কারণেই সার্ক ঠিকমত বিকশিত হতে পারছে না। এর মূল কারণ, মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতি। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্দ প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন যে, তার অপসারণের পেছনে ভারতের হাত ছিল। যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ভারত নেপালের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব খাটায়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নেপালে অত্যন্ত সক্রিয়। শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা প্রভাকরণকে তারাই তৈরি করেছিল। আসলে ভারত তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তথা দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে চায়। অর্থনীতিতে অনেক বড় শক্তি ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্রতা দূরীকরণে তথা উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এই আধিপত্যবাদী নীতির কারণেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বন্ধুশূন্য’ হতে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি, প্রণব মুখার্জি—এরা সবাই মূলত এই আধিপত্যবাদী নীতিরই সমর্থন করছেন। সুতরাং আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতাকে ফোন করে যত আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেন না কেন, এই আঞ্চলিক সহযোগিতা কোনো দিনই প্রতিষ্ঠিত হবে না—যতদিন না ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেই সাহায্য ও সহযোগিতা অর্থহীন হয়ে গেছে ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে। ফেলানী যেন এক টুকরা বাংলাদেশ। যখন লাশ হয়ে ঝুলে থাকে ফেলানীরা তখন ভারতের ‘বন্ধুত্ব’ কোথায় প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে এ দেশের জনগণের। বাংলাদেশকে তারা কীভাবে দেখে, ফেলানীর ঝুলে থাকা লাশ এর বড় প্রমাণ। তাই মমতা ব্যানার্জি যখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজয়ী হন, তখন আমাদের উত্সাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মানুষ সেখানে পরিবর্তন চেয়েছে। আর সেই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আদৌ কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হবে না। যারা সম্পর্ক উন্নত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন তত্কালীন ভারতীয় সরকারের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তখন মমতা এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন। মমতা হচ্ছেন ভারতীয় রানজীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রেডেকটিবল পার্সন’, যার ওপর আস্থা রাখা যায় না। যে কোনো সময় তিনি ভোল পাল্টাতে পারেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তার আঁতাত কতদিন স্থায়ী হয়, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন। মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা করার কিছু নেই।
নির্বাচনে বিজয়ের পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে ফোন করেছিলেন। এ কথাটা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের কাছ থেকে আমরা শুনিনি। তিনি ব্রিফিংও করেননি। আমরা জানলাম মমতা ব্যানার্জির মুখ থেকে (‘বাংলাদেশ থেকে হাসিনাদির ফোন পেয়েছি’)। প্রধানমন্ত্রী কি এটা করতে পারেন! প্রটোকল কি তাকে অনুমতি দেয়? একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী কী পারেন অন্য কোনো দেশের প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতে? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কি জার্মানির রাইনল্যান্ড ফালসের অতি সম্প্রতি নির্বাচনে বিজয়ী মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন? না, জানাননি। কেননা প্রটোকল অনুযায়ী তিনি তা পারেন না। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী তা করলেন। তারপর শুনুন মমতা কী বলেছেন। মমতার ভাষায় ‘মনে হচ্ছে যেন দুই বাংলা এক হয়ে গেল’ (কালের কন্ঠ, ১৪ মে, পৃ.-১০)। কী ভয়ঙ্কর কথা! ‘দুই বাংলা এক হয়ে গেল’! কী বোঝাতে চাচ্ছেন মমতা? আমাদের প্রধানমন্ত্রী ফোনে শুভেচ্ছা জানাবেন আর ভারতের নেতারা বলবেন ‘দুই বাংলা এক হয়ে গেল’—এটা তো আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি! আমরা তো এ জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম করিনি। এ জন্য তো লাখ লাখ লোক মারা যায়নি।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে আমরা পা দিয়েছি। এই চল্লিশ বছরে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের সঙ্গে আমাদের যত সমস্যা বেড়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আমাদের এ সমস্যা নেই। গত ১৬ মে ছিল ফারাক্কা দিবস। পানির ন্যায্য হিস্যা ও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ফারাক্কা মিছিল করেছিলেন মওলানা ভাসানী। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসেই নয়াদিল্লি ছুটে গিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন (১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে)। কিন্তু যতটুকু পানি আমাদের পাওয়ার কথা সে পানি চুক্তি স্বাক্ষরের পর কোনো দিনই আমরা পাইনি। অথচ ওই চুক্তি নিয়ে কত ‘অর্জনের’ কথা বলা হয়। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও কোনো খবর নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যখন আমরা সোচ্চার, তখন আমাদের সংসদ সদস্যরা ‘প্রমোদ বিহারে’ গেলেন, হেলিকপ্টারে ঘুরলেন, জানালেন তারা কিছুই দেখতে পাননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কথা যখন পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে, তখন মিজোরামের মানুষ ওই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করছে। ভারতীয় নেতারা আমাদের ‘ঘুম পাড়ানির গান শুনিয়ে’ আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু আমরা, বা নেপাল ও ভুটান এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারত থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আমরা ভারতীয় হেভি ট্রাক চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করছি। ওই রাস্তা দিয়ে ভারতীয় হেভি ট্রাক যাবে কোনো ধরনের শুল্ক না দিয়েই। আর আমরা বছরের পর বছর গুনতে থাকব সুদ। বলা হয়েছিল বিদ্যুত্ আসবে ভারত থেকে। কৈ সেই বিদ্যুত্? ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা ভারতে থাকলেও তা নানা ট্যারিফ ও প্যারা-ট্যারিফের কারণে ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। জানা গেছে, আগামী ৩ বছরের জন্য ভারত শুল্কমুক্ত আরও ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২২৪টি পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করার অনুমতি চেয়েছে। অথচ ভারতে বাংলাদেশী ৬১টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশের অনুমতির কথা রয়েছে, যা দীর্ঘসূত্রতার জন্য আটকে আছে। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সিমেন্টের ওপর অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। জানা গেছে, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা ধরনের সুবিধা পাওয়ার কথা (দিনকাল, ১৭ মে)। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পোন্নত। এ জন্য বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারত সেই সুবিধা বাংলাদেশকে কখনই দেয়নি। এক্ষেত্রে মমতা বা প্রণব মুখার্জির মতো নেতারা কোনো দিন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াননি। কেননা তারা বাঙালি হয়েও স্বার্থ দেখেছে ভারতের। অথচ আমাদের নেতারা বারবার ভারতীয় ‘বাঙালি বাবুদের’ দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, শুধু ভারতের কারণেই সার্ক ঠিকমত বিকশিত হতে পারছে না। এর মূল কারণ, মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতি। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্দ প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন যে, তার অপসারণের পেছনে ভারতের হাত ছিল। যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ভারত নেপালের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব খাটায়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নেপালে অত্যন্ত সক্রিয়। শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা প্রভাকরণকে তারাই তৈরি করেছিল। আসলে ভারত তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই পার্শ্ববর্তী দেশগুলো তথা দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে চায়। অর্থনীতিতে অনেক বড় শক্তি ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্রতা দূরীকরণে তথা উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এই আধিপত্যবাদী নীতির কারণেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বন্ধুশূন্য’ হতে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি, প্রণব মুখার্জি—এরা সবাই মূলত এই আধিপত্যবাদী নীতিরই সমর্থন করছেন। সুতরাং আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতাকে ফোন করে যত আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেন না কেন, এই আঞ্চলিক সহযোগিতা কোনো দিনই প্রতিষ্ঠিত হবে না—যতদিন না ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেই সাহায্য ও সহযোগিতা অর্থহীন হয়ে গেছে ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে। ফেলানী যেন এক টুকরা বাংলাদেশ। যখন লাশ হয়ে ঝুলে থাকে ফেলানীরা তখন ভারতের ‘বন্ধুত্ব’ কোথায় প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে এ দেশের জনগণের। বাংলাদেশকে তারা কীভাবে দেখে, ফেলানীর ঝুলে থাকা লাশ এর বড় প্রমাণ। তাই মমতা ব্যানার্জি যখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজয়ী হন, তখন আমাদের উত্সাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মানুষ সেখানে পরিবর্তন চেয়েছে। আর সেই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আদৌ কোনো উন্নতি পরিলক্ষিত হবে না। যারা সম্পর্ক উন্নত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন তত্কালীন ভারতীয় সরকারের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তখন মমতা এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন। মমতা হচ্ছেন ভারতীয় রানজীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রেডেকটিবল পার্সন’, যার ওপর আস্থা রাখা যায় না। যে কোনো সময় তিনি ভোল পাল্টাতে পারেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তার আঁতাত কতদিন স্থায়ী হয়, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন। মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা করার কিছু নেই।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
তথ্যসুত্রঃ আমার দেশ। রোববার, ২২ মে ২০১১
0 comments:
Post a Comment